ঢাকাসোমবার, ৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

যুক্তরাষ্ট্র তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে কোনো পক্ষ নেবে না

নিউজ ডেস্ক | সিটিজি পোস্ট
এপ্রিল ১২, ২০২৩ ১:০৫ অপরাহ্ণ
Link Copied!

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষ নেবে না। যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্ব দিচ্ছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উপমুখপাত্র দেশটির এই অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। 

বাংলাদেশও আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার ব্যাপারে অঙ্গীকার করেছে। গত সোমবার রাতে ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের সঙ্গে বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ওই অঙ্গীকার করেন। এর আগে গত বছর এপ্রিলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেনের সঙ্গে বৈঠকে এবং পরবর্তী সময়ে মার্কিন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ঢাকা সফরে বাংলাদেশ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার তুলে ধরেছিল।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের টমাস জেফারসন কক্ষে সোমবার ব্লিনকেন-মোমেন বৈঠকের সময় অন্য একটি কক্ষে ব্রিফিং করছিলেন দপ্তরের মুখ্য উপমুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল। তাঁকে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, বিএনপি আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের দাবি জানাচ্ছে। তবে সরকারি দল বর্তমান সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনড়। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কী হবে?

জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখ্য উপমুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল বলেন, ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বজুড়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নীতিকে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র। আমি এখানে কোনো দলীয় প্রার্থী বা এক দলের বিরুদ্ধে অন্য দলকে সমর্থন জানানোর জন্য অবস্থান করছি না।’

বেদান্ত প্যাটেল জবাবের শুরুতে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক জোরদার করতে চাই এবং জোরদার করার চেষ্টা করছি। এ কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আজ (গতকাল) বৈঠক করছেন।’ শেষে তিনি বলেন, ‘আবার বলছি, আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে সার্বিকভাবে আমাদের সম্পর্ক জোরদার করার অপেক্ষায় আছি।’

সারা বিশ্ব বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে : ওয়াশিংটন ডিসিতে গত সোমবার বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেন, ‘সম্পর্ককে শক্তিশালী ও গভীর করার উপায় খুঁজে বের করার জন্য কাজ চালিয়ে যেতে এবং এর পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

ব্লিনকেন বলেন, ‘আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ যাতে এই অঞ্চল এবং বিশ্বের জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের একটি জোরালো উদাহরণ সৃষ্টি করে সে জন্য অবশ্যই আমরা বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছি। বিশ্ব তাকিয়ে আছে।’

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাপকভাবে বেড়েছে। অর্থনৈতিকভাবে, দুই দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধন, জলবায়ু থেকে স্বাস্থ্য—সব কিছুতেই সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশ যে কাজ করেছে তা বেশ মূল্যবান। ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের অসাধারণ আতিথেয়তার প্রশংসা করেন ব্লিনকেন।

সম্পর্কের পরবর্তী ৫০ বছর নিয়ে ভাবনা মোমেনের : সূচনা বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন তাঁকে বৈঠকের জন্য ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানানোয় ব্লিনকেনকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। মোমেন বলেন, ‘বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বহুমুখী, গতিশীল ও বিস্তৃত সম্পর্ক রয়েছে। গত ৫০ বছরে আমরা সত্যিই ভালো করেছি এবং আমরা আগামী ৫০ বছরের জন্য উন্মুখ হয়ে আছি।’

গত মার্চে স্বাধীনতা দিবসের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পাঠানো চিঠি উদ্ধৃত করে মোমেন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ একসঙ্গে অনেক কিছু অর্জন করেছে।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেন ‘জয় বাংলা’ লিখে চিঠি শেষ করেছেন। এই বিশেষ শব্দগুচ্ছ আমাদের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার এবং মানবিক মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের ৩০ লাখ মানুষের আত্মত্যাগকে নির্দেশ করে। বাইডেনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মোমেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিঠি তিনি নিয়ে এসেছেন। বৈঠক শেষে তিনি ওই চিঠি হস্তান্তর করেন।

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় বাংলাদেশও : ব্লিনকেনের বৈঠকের পর বৈঠক প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বলেছে যে তারা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। অবশ্যই এটি আমাদেরও উদ্দেশ্য। অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের বিষয়ে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।’

মোমেন বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার ছবিযুক্ত ভোটার পরিচয়পত্র, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স প্রবর্তন করেছে। স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে।

অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার করতে হবে বিরোধীদেরও : পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, নির্বাচন একা একা হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, তোমরা আসো। আমরা পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানাই।’

মোমেন বলেন, ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন শুধু সরকারকে দিয়ে হবে না। এ জন্য সব বিরোধী দলকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। তাদের অবশ্যই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার করতে হবে।’ তিনি বলেন, “আমাদের দেশে নির্বাচনে লোকজন মারা যায়। আমরা খুব ‘ইগুয়িস্টিক’। আমরা চাই না, একটা লোকও মরুক।”

পক্ষপাতদুষ্ট পর্যবেক্ষকদের ‘না’ : পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার প্রয়োজনীয় সব কিছু করছে। তবে এ ক্ষেত্রে অন্যদেরও সাহায্য করতে হবে। তিনি বলেন, পর্যবেক্ষক যত খুশি আসুক। তবে তারা কোনোভাবে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ও পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারবেন না।

ভবিষ্যতেও ক্ষমতায় আসবে আওয়ামী লীগ : পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসবে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রায় দেড় কোটি লোককে সস্তায় খাবার দিচ্ছি। প্রায় ৫০ লাখ লোককে বিনা পয়সায় খাবার দিচ্ছি। বিধবা, বেকার তারা এর সুফল পাচ্ছে। তারা খুশি।’

মোমেন বলেন, ‘আমাদের সরকারের কারণে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ খুশি। গরিবরা খুশি। সরকার তাদের সাহায্য করছে। ছাত্রছাত্রীরা খুশি, কারণ হরতাল ধর্মঘট নেই। ব্যবসায়ীরা খুশি, কারণ হরতাল ধর্মঘট না থাকায় তাঁরা ব্যবসা ধুমিয়ে করে যাচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘শিক্ষক, অভিভাবকরা খুশি, কারণ ছেলে-মেয়েগুলো ঠিকমতো স্কুলে যায়। এ জন্য আমরা আশা করি, আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হলে আমরা অবশ্যই আবার জিতে আসব।’

জিহাদি-সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে সরকার : যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেছেন, জিহাদি, সন্ত্রাসী নিয়ন্ত্রণে রেখেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এগুলো আবারও মাথাচাড়া দিক সরকার তা চায় না। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে এগুলো ছিল। যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে পুরোপুরি অবগত।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস : গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করতে বাংলাদেশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) করেনি। আওয়ামী লীগ গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে এক হাজার ২৫১টি দৈনিক পত্রিকা বের হয়। ৪৩টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আছে। তারা খুবই সক্রিয়।’

বিরোধীরা কর্মসূচি পালন করতে পারে : মোমেন বলেন, ‘আমাদের দেশে বিরোধী দলগুলো যখন তখন কর্মসূচি পালন করতে পারে। এ ব্যাপারে আমরা খুব সচেতন। কর্মসূচি নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কেউ সরকারি বা বেসরকারি সম্পদ ধ্বংস করলে আমরা তাকে শাস্তি দেব। কারণ এ ক্ষেত্রে সুরক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের বাধ্যবাধকতা আছে।’

সংখ্যালঘুবিদ্বেষী কিছু লোক আছে : সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, সরকার কোনো অভিযোগ পেলে তাত্ক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেয়। কেউ হিন্দু না আহমদিয়া সম্প্রদায়ের তা এখানে বিবেচ্য নয়। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পূর্ণমাত্রায় আছে। তিনি বলেন, এ দেশে সংখ্যালঘুবিদ্বেষী কিছু লোক আছে। তারা ঝামেলা করতে চায়। কিন্তু সরকার এ ধরনের কোনো বিশৃঙ্খলা সহ্য করে না।

বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সুরক্ষা : পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ‘বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ (আইপি)’ ইস্যু তুলেছে। আমরা এখনো স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি)। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আইপি সুরক্ষা প্রযোজ্য। ২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটবে। বাংলাদেশ এই সুবিধা ২০২৯ সাল পর্যন্ত পাবে।

উন্নয়ন অর্থায়ন চেয়েছে বাংলাদেশ : যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অর্থায়ন প্রসঙ্গ তুলে ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এ খাতে সহযোগিতা চেয়েছে। তখন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, বাংলাদেশে শ্রম ইস্যুতে সমস্যা আছে। শ্রম পরিস্থিতির উন্নয়নে দুটি কমিটি কাজ করছে। বর্তমানে বিশ্বে ১০টি সেরা পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার মধ্যে আটটিই বাংলাদেশে। ১০০টির মধ্যে শীর্ষ ৫০টিই বাংলাদেশে।

রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাওয়ার প্রত্যাশা : পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঘাতক রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠাতে যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। আইনের শাসনের জন্যও এটি প্রয়োজন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে অগ্রাধিকার হিসেবে তুলে ধরে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চেয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে মোমেন বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অনেক কষ্ট হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র পারলে যেন ওই যুদ্ধ বন্ধ করে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল মঙ্গলবার ভোরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মোমেন-ব্লিনকেন বৈঠককে ফলপ্রসূ বলে অভিহিত করেছে।