রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় পল্টন, মতিঝিল, রমনা ও শাহজাহানপুর থানায় পৃথক চারটি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় ৫৩০ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরাসহ দুই হাজারের বেশি মানুষকে আসামি করা হয়েছে।
গতকাল গ্রেপ্তারকৃতদের ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে পাঠিয়ে সাত দিন করে রিমান্ডের আবেদন জানায় পুলিশ।
আদালত ২৩ জনের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীসহ ৪৪৫ জন নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। জামিন পেয়েছেন আমানউল্লাহ আমান।
এদিকে গতকাল কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিএনপি যদি এখনো শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চায়, তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে বিএনপিকে সমাবেশ করতে হলে অবশ্যই পুলিশ কমিশনারের নির্ধারিত স্থানে করতে হবে। তারা সোহরাওয়ার্দী কিংবা কালশীতে সমাবেশ করুক। কিংবা অন্য কোনো বিকল্প থাকলে বলুক। তাদের পুরোপুরি সহযোগিতা করা হবে। ’
পল্টন থানার ওসি মো. সালাহউদ্দীন মিয়া জানান, নয়াপল্টনে পুলিশের ওপর হামলা ও বিস্ফোরক আইনে রুহুল কবীর রিজভীসহ ৪৭০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার লোকের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মামলা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৪৫০ জন গ্রেপ্তার আছে। মতিঝিল থানায় আরেকটি মামলায় গ্রেপ্তার ২৮ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দেওয়া হয়। পল্টন থানার মামলায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম, উত্তরের আমানউল্লাহ আমান, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ও কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানিকেও আসামি করা হয়েছে। শাহজাহানপুর থানায় ৫২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ২০০ থেকে ২৫০ জনের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইনে আরেকটি মামলা হয়েছে। রমনা থানায় করা মামলায় ১৬৭ জনকে আসামি করা হয়েছে।
নয়াপল্টনের চিত্র : গতকাল নয়াপল্টন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে থমথমে অবস্থা। বিএনপি কার্যালয়ের সামনে ও আশপাশে কয়েক শ পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। দুপুর ১টায় দেখা যায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলছে। নিচতলায় বেশ কয়েকটি পাতিলে আগের দিনের রান্না করা খিচুড়ি পচে গন্ধ বেরোচ্ছে। কাকরাইল মোড়ে ও পুলিশ হাসপাতালের সামনে ব্যারিকেড দিয়ে চলাচল বন্ধ করে রেখেছে পুলিশ। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সাংবাদিক ও জরুরি প্রয়োজনে ওই এলাকার বাসিন্দাদের ছাড়া আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। দুপুর ২টার দিকে এলাকাটিকে ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে সাংবাদিকদের চলাচলও সীমিত করে দেওয়া হয়। ওই সময় পুলিশের ক্রাইম সিন ইউনিট বিএনপির কার্যালয়ে অবস্থান করছিল।
নয়াপল্টন এলাকার প্রতিটি গলির মুখে পুলিশের সতর্ক অবস্থান দেখা গেছে। গলির মুখগুলোও ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করা ছিল। বিএনপি কার্যালয়ের পাশের গলি দিয়ে দুই হিজড়া ঢুকতে চাইলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। পরে দেখা যায়, পুলিশের সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে একজন ব্যারিকেড ডিঙিয়ে আসেন। অন্যজন আসতে পারেননি।
এর আগে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢোকার উদ্দেশে কাকরাইল এলাকায় আসেন বিএনপির বেশ কিছু কর্মী। পুলিশের বাধায় তাঁরা ঢুকতে না পেরে কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড়ে স্লোগান দিতে শুরু করেন। পুলিশ তাঁদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয় এবং তিনজনকে আটক করে পাশের পুলিশ বক্সে নিয়ে যায়।
বিকেল পৌনে ৪টার দিকে আবারও নাইটিঙ্গেল মোড়ে বিএনপির বেশ কিছু কর্মী জড়ো হয়ে মিছিল শুরু করেন। পুলিশ তাঁদের ধাওয়া করে সরিয়ে দেয়। দুপুর ১টার দিকে দেখা যায় কয়েকজন শ্রমিক নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের সামনের প্রধান সড়কের ডিভাইডারের বিদ্যুতের খুঁটিতে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার তার লাগাচ্ছেন।
দুপুর দেড়টার দিকে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার হেঁটে হেঁটে নিরাপত্তার চিত্র দেখছিলেন। কাকরাইল মোড়ে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘গত বুধবারের অভিযানে বিএনপির কার্যালয় থেকে বিপুলসংখ্যক বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। নিরাপত্তার কারণে আমরা কাউকে কার্যালয়ে ঢুকতে দিচ্ছি না। পুরো কার্যালয়ে পুলিশের ক্রাইম সিন ইউনিট আছে। তারা নিরাপদ ঘোষণা করলে কার্যালয়ে প্রবেশ করতে দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। ’
গতকাল বিকেল ৪টার দিকে নয়াপল্টনের রাস্তা জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীরা কার্যালয়ের সামনে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁরা মিছিলে স্লোগান না দিলেও কার্যালয়ে এবং এর আশপাশের সড়কে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ৫টার দিকে ওই এলাকায় খণ্ড মিছিল বের করে ছাত্রলীগ।
ঢাকার মোড়ে মোড়ে পুলিশের তল্লাশি : সকালে সরেজমিনে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা ও গাবতলী এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ঢাকার এই প্রবেশমুখগুলোতে পুলিশের তল্লাশি চৌকি বসানো রয়েছে। কাউকে সন্দেহ হলেই তল্লাশি করা হচ্ছে। গাড়ি থামিয়েও চলছে তল্লাশি।
৪৭ পুলিশ সদস্য আহত : ডিএমপি থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে, গত বুধবারের সংঘর্ষের সময় মতিঝিল বিভাগের ডিসিসহ ৪৭ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে ৩০ জন কাজে ফিরেছেন। ১৭ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে এসআই রবিউলের মুখে চারটি সেলাই করতে হয়েছে। কনস্টেবল মাহফুজ মাথায় আঘাত পেয়ে গুরুতর আহত হন। তাঁর মাথায় ৪০টি সেলাই দেওয়া হয়েছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, সংঘর্ষের ঘটনায় ৪৯ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বললেন : গতকাল কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিএনপি সমাবেশের নামে বিশৃঙ্খলা করলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী চুপ থাকবে না। আমরা সব সময় বলে যাই, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির কথা। কিন্তু ভাঙচুর, বিশৃঙ্খলা করলে তো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী চুপচাপ থাকতে পারে না। তারা শান্তিপূর্ণভাবে কোনো সমাবেশ করলে এখানে কোনো বাধা নেই। ’
এক প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান খান বলেন, বিএনপিকর্মীরা পুলিশের ওপর মারমুখী ছিল। তারা ঢিল ও ইটপাটকেল ছুড়েছিল। সেটি মোকাবেলা করতে গিয়ে আহত হন পুলিশ সদস্যরা। অস্ত্র, গজারি লাঠি দিয়ে পুলিশ বাহিনীকে আহত করে বিএনপি। তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি নাজুক হয়েছে, এটা মনে করি না। সব সময় আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। একগুঁয়েমি ছেড়ে বিএনপির শুভবুদ্ধির উদয় হবে এমনটাই আশা করি। ’