২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হয়েছিলেন আল নাহিয়ান খান, সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। সাড়ে তিন মাস পর তাঁরা ‘ভারমুক্ত’ হন। তারপর গত প্রায় তিন বছর তাঁরা দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় টাকার বিনিময়ে নেতা বানানো, স্বেচ্ছাচারিতা, সম্মেলন না করে ঢাকায় বসে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিভিন্ন জেলা কমিটি গঠনসহ নানা অভিযোগে সমালোচিত হয়েছেন তাঁরা। গত চার মাসে তাঁরা নিয়মবহির্ভূত ‘চিঠি’র মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিকে কেন্দ্রীয় নেতা বানিয়েছেন। এসব অভিযোগ মাথায় নিয়েই আজ মঙ্গলবার ছাত্রলীগের ৩০তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে বিদায় নিতে যাচ্ছেন নাহিয়ান ও লেখক।
আজ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই সম্মেলন। সম্মেলনের প্রধান অতিথি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক অভিভাবক, আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সম্মেলনের পর ঘোষণা করা হবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নতুন নেতৃত্ব। পাশাপাশি ঘোষণা করা হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ শাখার নতুন কমিটি।
এবার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ২৫৪ জন। তাঁদের মধ্যে ৯৬ জন সভাপতি ও ১৫৮ জন সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী।
ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন হয়েছিল ২০১৮ সালের মে মাসে। একই বছরের ৩১ জুলাই রেজওয়ানুল হক চৌধুরীকে সভাপতি ও গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়।
উন্নয়ন প্রকল্প থেকে চাঁদা দাবিসহ নানা অভিযোগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে রেজওয়ানুল ও রাব্বানীকে পদচ্যুত করা হয়। বিশেষ পরিস্থিতিতে কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি নাহিয়ানকে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও লেখককে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে নাহিয়ান ও লেখককে ‘ভারমুক্ত’ করে দেন সাংগঠনিক অভিভাবক। তাঁরা ‘ভারমুক্ত’ হওয়ার তিন মাসের মাথায় দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়। ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
বিস্তর অভিযোগ
দায়িত্ব পেয়েই নাহিয়ান ও লেখক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি ও ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবেন। সংগঠনকে শক্তিশালী করার প্রত্যয়ও তাঁরা জানিয়েছিলেন। নাহিয়ানের দাবি, তাঁরা ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে কাজ করে গেছেন।
নাহিয়ান-লেখক প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের নির্দেশনা মেনে বহর নিয়ে চলাফেরা এড়িয়ে চলেছেন। তাঁদের সময়কালে ছাত্রলীগকে করোনা মহামারি, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে ত্রাণসহায়তা নিয়ে অসহায়-সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে।
তবে শুরু থেকেই নাহিয়ান-লেখকের বিরুদ্ধে সংগঠনের জেলা মর্যাদার মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি গঠনে ব্যর্থতা, নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখা, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে না যাওয়া, সাংগঠনিক দায়িত্ব বণ্টনে বিলম্বসহ নানা অভিযোগ করে কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি অংশ।
তাদের অভিযোগ, নেতৃত্বে আসার পর থেকেই নাহিয়ান ও লেখক বিলাসবহুল জীবনযাপন শুরু করেন। নাহিয়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছেড়ে নিউমার্কেট এলাকার একটি ফ্ল্যাটে পরিবারসহ ওঠেন। লেখক জগন্নাথ হল ছেড়ে ওঠেন ইস্কাটন গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে। দুটিই অভিজাত ও ব্যয়বহুল ফ্ল্যাট। এ ছাড়া তাঁরা একাধিক দামি গাড়ি ব্যবহার শুরু করেন।
শেষ দিকে নাহিয়ান ও লেখকের বিরুদ্ধে অভিযোগের মাত্রা বাড়ে। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে—কমিটি বাণিজ্য, সম্মেলন ছাড়া ঢাকায় বসে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে একের পর এক জেলা কমিটি গঠন, আওয়ামী লীগের বিপরীত আদর্শের ব্যক্তিদের দিয়ে বিভিন্ন ইউনিট কমিটি গঠন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সাধারণ সভা না ডাকা ইত্যাদি।
টাকার বিনিময়ে নাহিয়ান ও লেখকের কমিটি গঠনের অভিযোগ নিয়ে একাধিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। একটি জেলা ইউনিটের এক প্রার্থীর কাছ থেকে লেখকের ঘনিষ্ঠ এক নেতার টাকা চাওয়ার অডিও রেকর্ড গত মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়।
টাকার বিনিময়ে কমিটি গঠনের অভিযোগে কয়েকটি জেলায় খোদ স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই বিক্ষোভ করেন। এর মধ্যে সিলেট ও ঠাকুরগাঁও জেলায় বিক্ষোভের ঘটনা গণমাধ্যমে আলোচিত হয়।
বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়ে জেলা কমিটি গঠনের অভিযোগে বিক্ষোভ হয় কক্সবাজারে। সর্বশেষ সম্মেলন ছাড়াই সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গত ৭ নভেম্বর বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পর বিক্ষোভ হয়।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি অংশ বিভিন্ন সময়ে বলেছে, সংগঠনে ‘চেইন অব কমান্ড’ প্রতিষ্ঠায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন নাহিয়ান ও লেখক। এর ফলাফল হিসেবে গত এপ্রিলে ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী-কর্মচারী-হকারদের সংঘর্ষের ঘটনা তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। এই সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে নাহিয়ান ও লেখকের তেমন আগ্রহ ছিল না। তাঁদের ভাবনার কেন্দ্রে ছিল শুধুই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কমিটি গঠন ও ক্ষমতা উপভোগ।
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ দুই বছর। ছাত্রলীগের প্রাথমিক সদস্য হওয়ার বয়সসীমা অনূর্ধ্ব ২৭। কিন্তু গত এক যুগে সংগঠনটিতে এই মেয়াদ ও বয়সসীমার বিষয়টি মানতে দেখা যায়নি।
সর্বশেষ ২০১৯ সালে নাহিয়ান-লেখককে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, তাঁরা রেজওয়ানুল-রাব্বানীর অবশিষ্ট মেয়াদে (১০ মাস) দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু এই কমিটি প্রায় তিন বছরে গড়িয়েছে।
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে বিশেষ বা জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বর্ধিত সভায় অনুমোদন সাপেক্ষে কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যকাল তিন মাস বাড়ানোর সুযোগ আছে। তবে নাহিয়ান-লেখক তেমন কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণ করা ছাড়াই দায়িত্ব পালন করে যান।
মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সম্মেলন আয়োজন নিয়ে নাহিয়ান-লেখকের কোনো আগ্রহ ছিল না। সম্মেলন ঠেকাতে দুজনের নানা তৎপরতা ছিল বলেও অভিযোগ ওঠে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার পর তাঁরা সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করতে বাধ্য হন।
অবশ্য ২১ নভেম্বর মধুর ক্যানটিনে এক সংবাদ সম্মেলনে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন নাহিয়ান ও লেখক। তাঁরা বলেন, বিভিন্ন সময় যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, সেগুলো পুরোপুরি মিথ্যা। তাঁরা ৭৯টি ইউনিট কমিটি করেছেন। অর্থের বিনিময়ে তাঁরা কোনো কমিটি করেননি।
বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে নাহিয়ান ও লেখকের বক্তব্য জানতে গতকাল সোমবার তাঁদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু তাঁরা সাড়া দেননি।
শেষ সময়ে নিয়মবহির্ভূত ‘চিঠি’
সংগঠনের কোন ইউনিটে কত সদস্যের কমিটি থাকবে, তা সুস্পষ্ট লেখা আছে ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে। সেখানে বলা আছে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ ২৫১ সদস্যবিশিষ্ট। তাঁদের সঙ্গে প্রতিটি সাংগঠনিক জেলার মনোনীত একজন সদস্য ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ মনোনীত ১০১ সদস্য নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হবে। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের সুবিধার জন্য প্রতি বিভাগের জন্য আলাদা উপকমিটি করা যাবে। সহসভাপতিরা উপকমিটির চেয়ারম্যান ও বিভাগীয় সম্পাদকেরা সদস্য সচিব হবেন।
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে ‘চিঠির’ মাধ্যমে নেতা বানানোর কোনো বিধান নেই। কিন্তু শেষ সময়ে নাহিয়ান ও লেখক বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিকে ‘চিঠির’ মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে পদায়ন করেছেন। নেতা বানানোর এই হিড়িকে অনেক ‘বিতর্কিত’ ব্যক্তি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পেয়েছেন।
৩১ জুলাই মধ্যরাতে দুই শতাধিক ব্যক্তিকে ‘চিঠির’ মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নেতা বানান নাহিয়ান ও লেখক। পরদিন থেকে শুরু হয় শোকের মাস আগস্ট। চিঠির মাধ্যমে নেতা হওয়া ব্যক্তিরা ফেসবুকে উচ্ছ্বাস, কৃতজ্ঞতা, অভিনন্দন ও শুভেচ্ছায় মগ্ন হন। এ নিয়ে সংগঠনের ভেতরই সমালোচনা হয়। এরপর আগস্ট মাসে ‘চিঠি’ বিতরণ কিছুটা শ্লথ ছিল। পরের কয়েক মাসে একের পর এক ব্যক্তিকে ‘চিঠির’ মাধ্যমে নেতা বানানো হয়। এসব নেতার মধ্যে এমন ব্যক্তিরাও আছেন, যাঁদের অতীতে ছাত্রলীগে কোনো পদ ছিল না।
‘চিঠির’ মাধ্যমে এভাবে নেতা বানানো নিয়ে ফেসবুকে সমালোচনা-হাস্যরসও হয়েছে। তা সত্ত্বেও গত পাঁচ দিনে সবচেয়ে বেশি চিঠি বিতরণ করা হয়েছে।
গতকাল রাতে ঢাবির শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে চিঠি বিতরণ করেন ছাত্রলীগের কিছু নেতা। যদিও এসব চিঠিতে তারিখের জায়গায় ৩১ জুলাই লেখা রয়েছে। এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার ব্যক্তিকে চিঠির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নেতা বানানো হয়েছে বলে ছাত্রলীগের সূত্রগুলো জানিয়েছে।
চিঠির মাধ্যমে ‘গণহারে’ পদ দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ছাত্রলীগের দুই সহসভাপতি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই দুই নেতা বলেন, অর্থের বিনিময়ে অনেককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কারও কাছে কোনো জবাবদিহি না করে সম্পূর্ণ একক সিদ্ধান্তে কোনো বাছবিচার ছাড়াই চিঠি বিতরণ করেছেন নাহিয়ান ও লেখক। ছিনতাইকারী, মাদকসেবী এবং আওয়ামী লীগের বিপরীত মতাদর্শের পরিবার থেকে আসা ব্যক্তিরাও চিঠির মাধ্যমে পদ পেয়েছেন।
নিয়মবহির্ভূত চিঠির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে পদায়ন প্রসঙ্গে গত ২১ নভেম্বর মধুর ক্যানটিনে এক সংবাদ সম্মেলনে লেখক বলেন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ ৩০১ সদস্যবিশিষ্ট (গঠনতন্ত্রে ২৫১)। এর বাইরে কেন্দ্রীয় কমিটি, জাতীয় কমিটি বা উপকমিটিকেন্দ্রিক গঠনতান্ত্রিক নীতিমালা রয়েছে। বর্ধিত অংশটি কেন্দ্রীয় কমিটির বলে দাবি করেন তিনি। সংশয় থাকলে সাংবাদিকদের ছাত্রলীগের দপ্তর সেলে গিয়ে সঠিক সংখ্যাটি জেনে আসার পরামর্শ দেন লেখক।
লেখকের পরামর্শ অনুযায়ী ছাত্রলীগের দপ্তর সেলে যোগাযোগ করা হয়। সেখান থেকে বলা হয়, কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল জাব্বার রাজ, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক তুহিন রেজা ও উপদপ্তর সম্পাদক মিরাজুল ইসলাম খান চিঠির বিষয়টি দেখছেন। গতকাল তুহিন ও মিরাজুলের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হয়। তবে প্রতিবারই তাঁদের নম্বর ব্যস্ত পাওয়া যায়।
জানতে চাইলে আবদুল জাব্বার রাজ প্রথম আলোকে বলেন, মোট কত চিঠি দেওয়া হয়েছে, তা বলা মুশকিল। তবে অনেকে ভুয়া চিঠিও ফেসবুকে দিয়েছেন। সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তাঁরা এগুলো যাচাই–বাছাই করার সময় পাচ্ছেন না। অবশ্য চিঠি কমিটির বৈধতা কম।