বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবার ৩৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে; ২৮ মাসের মধ্যে যা সর্বনিম্ন।
ইউক্রেইন-রাশিয়ার যুদ্ধাবস্থায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের খরচ বেড়ে যাওয়ার বিপরীতে রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স কমে যাওয়ার কারণে চাপ বাড়তে থাকার মধ্যে রিজার্ভ আরও কমে গেল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, বুধবার দিন শেষে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারে। এর আগে ২০২০ সালের জুনে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৬ বিলিয়ন ডলার।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়।
বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে বাংলাদেশ প্রায় ৪ মাসের আমদানি বিল পরিশোধ করতে পারবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। এরপর তা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০২১ সালের জুনে ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়নে উন্নীত হয়। একই বছরের আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলার।
এরপর কোভিড মহামারীর লকডাউন উঠে দেশে দেশে অর্থনীতি গতিশীল হতে শুরু করলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাড়তে থাকে, যা বাড়িয়ে দেয় পণ্যমূল্যও। এর সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি জাহাজ খরচ বাড়লে পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে। এরমধ্যে গত ফেব্রয়ারিতে ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশেও বৈশ্বিক বাণিজ্যের দায় মেটাতে চাপে পরে।
আমদানি ব্যয় বাড়ার বিপরীতে রপ্তানি ও রেমিটেন্স সেভাবে না বাড়লে ডলারের মজুদে টান পড়ে। এতে করে যুদ্ধ শুরুর চার মাস পর গত জুনে রিজার্ভের পরিমাণ ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
চাহিদা বাড়লে বাংলাদেশ ব্যাংকও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে। পাশাপামি মুদ্রাবাজারে ভারসাম্য ঠিক রাখতে টাকার মান দফায় দফায় কমিয়ে আনা হয়।
গত বছরের অগাস্টে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ছিল ব্যাংকে ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায়, সেখানে গত ১৯ অক্টোবর তা দাঁড়িয়েছে ১০৪ টাকা ৮৭ পয়সা। আর খোলা বাজারে প্রতি ডলার কিনতে খরচ হচ্ছে ১১২ টাকার মত।
এমন প্রেক্ষাপটে ডলার বাঁচাতে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারও সাশ্রয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। গত এপ্রিল থেকে বিলাস পণ্য আমদানি কঠিন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ভোগ্যপণ্য ছাড়া বেশ কিছু পণ্য আমদানিতে ৭৫ থেকে ১০০ শতাংশ নগদ মার্জিন আরোপ করা হয়েছে।
বন্ধ করা হয় আমদানি পণ্যের ঋণপত্র (এলসি) খুলতে ব্যাংক ঋণ সহায়তা। একই সঙ্গে ৩০ লাখের সমপরিমাণ ও এরচেয়ে বেশি অঙ্কের এলসি খোলায় আগে জানানোর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। আমদানি নির্ভর প্রকল্পের খরচে লাগাম টানা হয়।
তারপরও বৈদেশিক বাণিজ্য ও চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি বাড়তে থাকে।
ইতোমধ্যে গত আগস্ট শেষে বাণিজ্যে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ও চলতি হিসাবে দেড় বিলিয়ন ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরও দুটি সূচকেই ঘাটতিতে শেষ করেছে বাংলাদেশ।
যদিও আমদানি কড়াকড়ির এসব উদ্যোগে নতুন এলসি খোলার হার কমে এসেছে। কিন্তু পুরনো এলসির দায় পরিশোধ অব্যাহত থাকায় আমদানি বিল এখনও রপ্তানি ও রেমিটেন্সের মোট পরিমাণের চেয়ে বেশি।
তবে গত ১৬ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংকের বাষিক সাধারণ সভার ফাঁকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সাংবাদিকদের বলেছেন, অক্টোবর শেষে রপ্তানি ও রেমিটেন্সের সমপরিমাণ ডলার দিয়ে আমদানি দায় মেটানো সম্ভব হবে।
অর্থাৎ অক্টোবর মাসে ঘাটতিতে থাকা চলতি হিসাবে নতুন করে ঘাটতি যোগ হবে না বলে তার আশা।
রিজার্ভে টান এবং বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তে থাকার প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক মুদ্রার চাপ সামলাতে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংকের কাছে সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে।
এর মধ্যে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য আলোচনা করতে আগামী ২৭ অক্টোবর বাংলাদেশে আসছে আইএমএফের প্রতিনিধি দল।
এদিকে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে নভেম্বরে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি দায় পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। দুই মাস পরপর পরিশোধ হওয়া আগামী বিল পরিশোধের পর রিজার্ভের পরিমাণ আরও কমে যেতে পারে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এ রকম পরিস্থিতিতে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর রিজার্ভ আরও যাতে কমে না যায় সেদিকে নজর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘সরকারকে রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়াতে টাকার বিনিময় হারে আরেকটু ছাড় দিতে হবে। আর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ঋণ সুদহার বাড়াতে হবে। যেটি সরকার ৯ শতাংশে বেঁধে দিয়েছে। সরকারের কাছে এ দুটি উপায়ই রয়েছে।’’