ঢাকাবুধবার, ১২ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

“তোদের বাপের টাকায় সাংবাদিকতা করি নাকি?”

চবি প্রতিনিধি | সিটিজি পোস্ট
ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৫ ৫:৫৭ অপরাহ্ণ
Link Copied!

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ক্যাম্পাসে চলমান অস্থিরতার মধ্যে এবার সাংবাদিকদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিকেও অনেকে প্রশাসনের “বি টিম” হিসেবে আখ্যায়িতও করছে।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ‘সিটিজি পোস্ট’কে জানান, “শেখ হাসিনা হলের কলাপসিবল গেটের ভেতরে প্রবেশ করে নারী শিক্ষার্থীদের ছবি ও ভিডিও ধারণ করছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (চবিসাস) সাধারণ সদস্য রেদওয়ান আহমদ ও চ্যানেল আই এর ক্যাম্পাস প্রতিনিধি অনিন্দিতা সরকার প্রথা। সেই নারী শিক্ষার্থী জানান, আমি প্রথমে বুঝতে পারি নি ক্যাম্পাসে কি হয়েছে। আমি নীচে নামার পরে দেখি অনেক সাংবাদিক আমাদের দিকে ফোন তাক করে রেখেছে। আমি ঐ সাংবাদিক আপু (প্রথা)-সহ উপস্থিত সকলকে নিষেধ করি আমাদের ছবি বা ভিডিও নিতে। এটা বলার পরেও তারা আমাদের দিকে ক্যামেরা তাক করে রেখেছিলো।”

 

ভুক্তভোগী এ-ও জানান, “এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে আমি তাদের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে নেই এবং জানাই যেনো এই ফোনটা আপনি হল প্রশাসনের কাছ থেকে নিবেন। তখন অবশ্য আমি জানতাম না যে এরা সাংবাদিক। অবশ্য, এরপরেই তারা কনফেস করতে থাকে যে তারা সাংবাদিক। আমি সাংবাদিক শুনে ফেরত দিতে চাইলে পাশ থেকে এক আপু আমাকে বলেন, “আপনি ওদের মুখের কথায় কেনো বিশ্বাস করবেন ওরা সাংবাদিক? আপনি এটা হল প্রশাসনকেই দিবেন। তাঁরা ছবি ভিডিও ডিলিট করে তারপরেই ফোনটা তাদেরকে ফেরত দিবেন। আপনি ফোনটা নিয়ে হলে চলে যান।” আমি হলে চলে যাওয়ার সময় আপুকে ফোনটা দিয়ে যাই নাহয় যেহেতু উনি আমার অপরিচিত সেহেতু আমাকে উনি খুঁজে পেতে কষ্ট হয়ে যাবে। পরবর্তীতে ঐ আপুই উনাদেরকে ফোনটা দিয়েও দেয়। প্রথমে এটুকুই ছিলো কাহিনি।”

 

তিনি আরো জানান, “প্রথমে চলে গেলেও কিছুক্ষণ পর আমি আবার বের হই এনশিওর হওয়ার জন্য যে আসলেই ফোনটা পেয়েছেন কি-না যেহেতু আমি হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিলাম, আমার উপরে একটা দায়ভার চলে আসবে। পরে শিওর হয়ে রিলিভড হই যে ফোনটা পেয়েছেন। কিন্তু আপত্তি জাগে যখন দেখতে পাই, ফোন কেড়ে নেওয়ার ভিডিওটিই ভাইরাল হচ্ছে। সেখানে আমাকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে, যেখানে আমি শুরু থেকেই জুলাই আন্দোলনে ছিলাম। আমাকে হল থেকে বেরও করে দিচ্ছিলো, ঐ সিচুয়েশনেও প্রতিবাদ করে গিয়েছি টিচারদের সাথে। জিরো পয়েন্টে ছাত্রলীগের সাথে আমাদের সমস্যাও হয়েছিলো ; সেখানে আমাকেই এসব ট্যাগ দিচ্ছে। ছেলেরা আজেবাজে কমেন্ট লিখছে।”

 

“এরপরে আমি নীচে যাই, হল প্রশাসনের সাথে কথা বলতে, কারণ আমার মিডিয়া কনসার্ন আছে, আমি সোশ্যাল মিডিয়া পারসনও না, আমার ফ্যামিলিতে জানাজানি হলে সমস্যা হবে। সেখানে কানন স্যার ও আমাদের হাউজ টিউটর আকিক স্যার ছিলেন। স্যারদের পাশেই সাংবাদিকেরা মেয়েদের সাথে কথা বলছিলেন। আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করি, আপনারা কেনো আমার ভিডিও ফেসবুকে ছেড়েছেন? তখন প্রথা আপুকে দেখি আমার ভিডিও করছেন। তখন আমি আপুকে বলি আপু প্লিজ আপনার ক্যামেরাটা নামান। তখন রেদওয়ান নামের একজন সাংবাদিক আমার হাত জোরে চেপে ধরে বলে “একদম চুপ! তোদের বাপের টাকায় সাংবাদিকতা করি নাকি? তোদেরটা খাই নাকি?” কথাটা বলার সময় রেদওয়ান তার হাত একদম আমার মুখের কাছে নিয়ে আসে। তখন উপস্থিত পরিস্থিতি আরো গরম হয়ে যায়। তখন আমি তাকে বলি, “আপনারা আপনাদের মা বোনের ছবি এভাবে তুলতে পারতেন? তুলে ছাড়তে পারতেন?” এসব বলে আমি চলে আসি। আমি পরবর্তীতে, সত্য ঘটনা উল্লেখ করে ফোন নেওয়ার ইস্যটাকে নিয়ে দৈনিক ইনকিলাবের একজন সাংবাদিকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে একটি চিঠিও দিয়েছি। তিনি আমাকে চবিসাস এর সভাপতি বরাবর দরখাস্ত দিতে বলেন। এরপরে শুনি, আমাকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।”

 

চবিসাসের সূত্র মতে, রেদওয়ান আহমদ একাধিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। তিনি বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক, কনজিউমার ইয়ুথ বাংলাদেশ সংগঠনের সভাপতি এবং ঢাকামেইল ও বার্তা২৪-এর ক্যাম্পাস প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন।

 

এদিকে, চবিসাসের আরও কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধেও শিক্ষার্থীদের উত্ত্যক্ত করা ও মৌখিক হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, নৌকা ভাঙচুর করা ছাত্রদলের কয়েকজন ছাত্রের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাংবাদিকদের আলাদা করে শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। শিক্ষার্থীরা ছবি ও ভিডিও ধারণে নিষেধাজ্ঞা দিলেও সাংবাদিকরা বলেন, “আমাদের ক্যামেরা ভালো, সুন্দর ছবি উঠবে।”

 

সংশ্লিষ্ট সূত্র হতে জানা যায়, “ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী হলের ভেতরে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছেন।” তারা জানায়, “সে কিছু করে নাই। সে ঝামেলার সময় ঘটনাস্থলে যায়ও নাই। সে কি হয়েছে দেখতে নীচে এসেছিলো শুধু। এটাই কাল হয়ে যায় তার জন্যে। এমনকি প্রাইভেসি ইস্যুতে কেড়ে নেওয়া ফোনও আরেকজনকে দিয়ে এসেছিলো। এটার সাথে তো তার কোনো সম্পর্ক নেই।”

 

চবিসাস সভাপতি মোহাম্মদ আজহার স্বীকার করেছেন যে রেদওয়ান ভুল করেছেন। তার ভাষায়, “হ্যাঁ, সে ভুল করেছে, অন্যদিকে সরে যায়নি বা চলে যায়নি।” তবে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অনুমতিব্যতীত মেয়েদের হলের ভেতরে নারী শিক্ষার্থীদের ছবি ও ভিডিও ধারণ এবং মৌখিক ও শারীরিক হেনস্তার ব্যাপারে বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি তা এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, “সাংবাদিক তো সিচুয়েশন কভার করবেই। ও ঠিকভাবে নিজেকে প্রেজেন্ট করতে পারেনি।” ফোন কেড়ে নেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ফোন ১০ মিনিট আটকে রেখেছিলো, তারপরে দেওয়া হয়েছে।”

 

সাংবাদিকদের এই ভূমিকা নিয়ে ক্যাম্পাসে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। নারী শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তুলছেন, সাংবাদিকতার নামে কি নারীদের নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হবে? অন্যদিকে, প্রক্টর অধ্যাপক তানভির এম এইচ আরিফের বিতর্কিত মন্তব্য এবং চবিসাস সদস্যদের কর্মকাণ্ড ক্যাম্পাসে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। শিক্ষার্থীদের একাংশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছেন।

 

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি। তবে সাংবাদিকতার নীতিশাস্ত্র ও নৈতিকতার প্রশ্ন সামনে চলে আসায় বিষয়টি তদন্তের দাবি তুলেছেন শিক্ষার্থী ও সচেতন নাগরিকরা।