ঢাকাবৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্ব শর্ত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার — মো.নিজাম উদ্দিন

মো. নিজাম উদ্দিন
অক্টোবর ২, ২০২২ ১০:৫১ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

এক.

নির্বাচন কালীন সরকারটা কেমন হবে -দলীয় নাকি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার?সেটা নির্ভর করে একটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপর।রাজনৈতিক সংস্কৃতি সমৃদ্ধ না হলে দলীয় সরকারের অধীনে কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এখনো এতোটা উন্নতি হয়নি যেখানে এক দলের অধীনে নির্বাচন হবে আর অন্য দল জনগণের ভোটে ক্ষমতায় চলে আসবে।রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভালো হলে দলীয় সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি তো এখনো সেখানে যেতে পারেনি।ভারতে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়।নির্বাচনের এক থেকে তিনমাস পর ভোট গণনা করা হয় এবং এই সময়ে ব্যালট বাক্স গুলো কর্মকর্তাদের কাছে গচ্ছিত থাকে।ভারতে এখন পর্যন্ত এসব বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক দল খুব সিরিয়াস প্রশ্ন তুলেছে তা শোনা যায় না।বাংলাদেশে যদি নির্বাচনের এক থেকে তিনমাস পর ভোট গণনা হয়,কোনো ডিসি এসপির তত্ত্বাবধানে ব্যালট বাক্স গুলো জমা থাকে তাহলে বিষয়টি কেমন হবে?রাজনৈতিক দল গুলো মেনে নিবে?অবশ্যই না।কারণ ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ভালো। সেখানে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গুলো যথেষ্ট স্বাধীন। মুক্ত।বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট শক্তিশালী। বাংলাদেশে যা অকল্পনীয়। এজন্যই বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাস্তবতা অস্বীকারের সুযোগ নেই।তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প নেই এখনো।

 

দুই.

বাংলাদেশের এগারটি সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে কয়টা নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছে সেগুলোই অধিক গ্রহণ যোগ্য নির্বাচন ।তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন গুলোতে ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট দিতে পেরেছে।তখন নির্বাচন ছিল উৎসবের বিষয়। আর এখন নির্বাচন মানেই আতংক। নির্বাচন মানেই ভোট ডাকাতি। কেন্দ্র দখল।ব্যালট ব্যাপার ছিনতাই।ভোট কেন্দ্রে ভয়ে ভোটার শূন্যতা।কৃত্রিম ভোটার লাইন ছোট না হওয়া।মানুষের ভোট দিতে না পারার দীর্ঘশ্বাস।
বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে নামেই হোক নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিকল্প নেই।তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশংসা করতে গিয়ে জাতিসংঘ তার হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট -২০০০ এ উল্লেখ করেছিল-An important advance in new democracy অর্থাৎ নতুন গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রযাত্রা হিসাবে। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটি সুষ্ঠু নির্বাচনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বিকল্প হওয়ায় দেশে বিদেশে অনেক প্রশংসা কুড়িয়ে ছিল।বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ধারণাটি পাকিস্তান তার সংবিধান সংশোধন করে চালু করেছে এবং এর ফলও পাচ্ছে।

 

তিন.

বাংলাদেশের সবচেয়ে গ্রহণ যোগ্য তিনটা নির্বাচনের তিনটাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছে। ১৯৯১,১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচন বাংলাদেশে সবচেয়ে গ্রহণ যোগ্য সংসদ নির্বাচন এবং এ তিনটাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়।আফসোসের বিষয় হলো এত সুন্দর একটা ব্যবস্থা নিজেরা দাঁড় করিয়ে নিজেরাই বাতিল করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা বাস্তবায়ন করে অন্যরা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশের জনগণ এখনো ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে।জীবন দিচ্ছে।গুম হচ্ছে।খুন হচ্ছে।গুলি খাচ্ছে।
ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তত্ত্বাবধায় সরকার ধারনাটা বাতিল করা হয়েছে। তবে আদালত রায়ে বলেছে বাংলাদেশে পরবর্তী আরো দুটো জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু এই অবজারভেশনটা সরকার মানেনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ে আদালতের যুক্তি হলো-তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অনির্বাচিত সরকার এবং কোনো অনির্বাচিত সরকার কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিতে পারেনা।অথচ ২০১৪ সকালে সংসদের তিনশো আসনের মধ্যে একশো চুয়ান্ন জন এমপি ই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হয়ে যায়!অথচ এগুলো নিয়ে তখন খুব একটা কোনো আওয়াজ উঠেনি!তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশে স্বৈরশাসন এবং কর্তৃত্ববাদের জন্য একটা আতংকের নাম।

বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন এখন একটি অবাস্তব এবং কাল্পনিক ধারণা।বর্তমানে দেশে দীর্ঘ একযুগের অধিক সময় যাবত যে রাজনৈতিক সংকট ও সংঘাত চলছে তার একমাত্র সমাধান বাংলাদেশে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটিকে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে সংবিধানে যুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।না হয় বাংলাদেশের রাজনীতির অনিশ্চিত যাত্রা থামানো অসম্ভব হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

(সিটিজি পোস্টের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, সিটিজি পোস্ট কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার সিটিজি পোস্ট নিবে না।)