রাজনীতি, মানব সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, কখনোই নিষিদ্ধ করা যায় না। এটি এক ধরনের জীবন্ত সত্তা, যে সত্তার অস্তিত্ব সামাজিক কাঠামোর মধ্যেই নিহিত। তবে, যখন এটি নিষিদ্ধ হয়, তখন এক নতুন রূপে ফিরে আসে, যেমন এক অদৃশ্য ভূত, যাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা অসম্ভব। নিষিদ্ধ রাজনীতি বা গুপ্ত রাজনীতি, একেবারে অন্য এক প্রকারের ভৌতিক শক্তি, যে শক্তি বাস্তবতা থেকে অদৃশ্য হয়ে চলে যায় কিন্তু তার প্রভাব কখনোই অনুপস্থিত থাকে না। এমন এক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো দল বা ব্যক্তি প্রকাশ্যে দৃশ্যমান না হলেও তাদের কর্মকাণ্ড সমাজের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। এটি রাজনৈতিক হুমকি, এবং এক ধরণের মৃত্যুর অশনি সংকেত, যে সংকেত আসে কিন্তু কখনোই স্পষ্টভাবে অনুভূত হয় না।
রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেই সেটি কোনো এক কাল্পনিক শত্রু হয়ে ওঠে। এটি সঠিকভাবে চিহ্নিত বা বিচার করা যায় না। সমাজের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা এক গভীর ও কালো গর্ত, যেখানে আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু তা আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষত যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা বা একটিভ রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়, তখন তা গুপ্ত রাজনীতির রূপে সমাজে প্রবাহিত হতে শুরু করে। তেমনই, এক ভূত কেবল তখনই সমাজের হৃদয়ে প্রবাহিত হয় যখন কোনো দৃশ্যমান উপাদান নেই। কিন্তু তার উপস্থিতি, তার প্রভাব, সবকিছুই নির্ভরশীল হয় অন্য কোনো শক্তির ওপর। রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কেবল এক শক্তির ওপর চাপ সৃষ্টি করে না, বরং তা সমাজের স্বাভাবিক গতিপথকেও বদলে দেয়। এর পরিণতি ভয়ঙ্কর—সমাজ তখন এক বিভ্রান্তি, এক অরাজকতার মধ্যে ভাসতে থাকে।
গুপ্ত রাজনীতির এই ধরনটি ঠিক এমনই এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করে, যেখানে কেউ আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। যেমন সঙ্গীতের একটি প্রতিধ্বনি, যেখানে সুর হারিয়ে যায়, কিন্তু তার অস্তিত্ব অদৃশ্যভাবে থেকে যায়। এক্ষেত্রে, রাজনৈতিক নেতা বা দলগুলো নিজেদের দায় থেকে পালিয়ে যায়, আর তার ফলশ্রুতিতে আমরা একটি অদৃশ্য ক্ষমতার আধিপত্য দেখতে পাই, যেখানে শাসকের কোনো সঠিক দায়বদ্ধতা থাকে না। সমাজ তখন ক্রমশ একটি কুয়াশাচ্ছন্ন পরিণতির দিকে এগিয়ে চলে, যেখানে কোনো বিচার নেই, কোনো ক্ষমতা নেই, এবং কোনো প্রতিকার নেই। সেজন্যই নিষিদ্ধ রাজনীতি এক “ভৌতিক রাজনীতি” হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।
গণতন্ত্র, যা মানুষের মৌলিক অধিকার, তার সবচেয়ে বড় শত্রু হতে পারে গুপ্ত রাজনীতি। যখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অদৃশ্য হয়ে যায়, তখন গণতন্ত্রের সারা শরীর মৃত্যুশব্দে বিঁধতে শুরু করে, এক অন্তহীন ভয় এবং অস্থিরতার মধ্যে পড়ে যায় পুরো সমাজ। এটি এক অন্ধকার যা কখনোই শেষ হয় না, এক রক্তাক্ত পথ যেখানে ন্যায়বিচার নেই, বিচারের প্রক্রিয়া উধাও হয়ে যায়।
গুপ্ত রাজনীতি এক অশুভ প্রক্রিয়া হিসেবে গণতন্ত্রের চর্চায় শাসকশ্রেণীর দখলদারি আরও গভীর করে দেয়। এটি সাধারণ মানুষের মধ্যে এক অবিশ্বাস সৃষ্টি করে, কারণ যারা দেখায় না, তারা কখনো সত্যিকার দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয় না। এক যুগ্ম প্রক্রিয়া, যা সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিভাজন সৃষ্টি করে, কারণ শাসকরা যখন গোপনীয়তার আড়ালে তাদের কার্যক্রম চালায়, তখন জনগণের বিশ্বাস ক্রমশ ক্ষয়ে যায়।
গুপ্ত রাজনীতি কখনোই সাধারণ বা প্রকাশ্যে দেখা যায় না। এটি এক অদৃশ্য সত্তা, যা আড়াল থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করে, যেমন একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন পথ, যেখানে কোনো আলো প্রবাহিত হয় না। যখন রাষ্ট্র বা সরকার এক্টিভ রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করে, তখন এটি সমাজে এক নতুন শাসনব্যবস্থা সৃষ্টি করে। কেউ যখন গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তখন সে গুপ্তভাবে অথবা নানা রকম কৌশলে ক্ষমতার প্রতি তার আগ্রহ মেটাতে চায়। এই প্রক্রিয়ায় রাজনীতি তখন কেবলমাত্র একটি গোপন অস্তিত্ব হয়ে দাঁড়ায়, যা এক ধরনের বিকৃত চিন্তা এবং অন্ধকার প্রবণতার জন্ম দেয়। ক্ষমতার নতুন মাপকাঠি তৈরি হয়, যেখানে সঠিক বিচার, গণতান্ত্রিক অধিকার বা আইনপ্রয়োগ কিছুই কার্যকর থাকে না।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, গুপ্ত রাজনীতি এক সামাজিক মড়ক তৈরি করে। “The Illusion of Democracy: Political Repression and the Politics of Deception” (Blake, 2017) প্রবন্ধে প্রকাশ পেয়েছে যে, গোপনীয়তা এবং অদৃশ্য শক্তির দ্বারা পরিচালিত রাজনীতি গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশে বৃহত্তর বাধা সৃষ্টি করে। শাসকশ্রেণী যখন জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা তুলে নেয়, তখন তা রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক বিভক্তি সৃষ্টি করে। অন্য একটি গবেষণায় (Smith, 2018), গুপ্ত রাজনীতির মাধ্যমে শাসকেরা জনগণের প্রাকৃতিক অধিকারকে লঙ্ঘন করে, এবং এমনভাবে জনগণকে অজ্ঞতার অন্ধকারে রেখে দেয়, যেখানে তাদের সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় না।
যখন গণতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ—স্বাধীনতা, সুশাসন, ন্যায়বিচার—ধ্বংস হয়, তখন এটি কেবল রাজনৈতিক মৃত্যুর সংকেত দেয় না, এটি এক সমাজের সাংস্কৃতিক এবং নৈতিক মৃত্যুও। গুপ্ত রাজনীতি সমাজের রক্তক্ষরণ করে, যেখানে সবাই নিজেকে নিরাপদ মনে করে না, যেখানে সবাই ভীত। সামাজিক শান্তির পরিবর্তে, এটি এক নতুন যুদ্ধের সূচনা করে, যেখানে শাসকদের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণই একমাত্র অগ্রাধিকার। আর জনগণ, যাদের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই, এক বিপন্ন অস্তিত্ব হয়ে ওঠে, যাদের স্বাধীনতা শুধু নামমাত্র—সামাজিক মৃত্যুর অপেক্ষা।
এই “গুপ্ত রাজনীতি” বা নিষিদ্ধ রাজনীতি তখন এক শত্রু হয়ে ওঠে যা কোনো চিহ্ন ছাড়াই সমাজের মধ্যে বিস্তার লাভ করে। এটি সাধারণ জনগণের মধ্যে এক ভয় এবং উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করে, যেখানে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না, এবং বিশেষত সমাজের মধ্যে বৈষম্য এবং বিভক্তি আরও তীব্র হয়। যে সমাজ এক সময় রাজনৈতিক চর্চা এবং স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে তখন জনমনে অস্থিরতা এবং সন্দেহ প্রবাহিত হয়।
যেমন, বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের সময়, ছাত্রদল, বিএনপি, ছাত্রশিবির, জামায়াত এবং অন্যান্য দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। এই মুহূর্তে কোন রাজনৈতিক দল তাঁদের সংযোগ স্বীকার করেনি, তবে আন্দোলন সফল হলে সেটি সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক দলগুলো হঠাৎ করেই নিজেদের শেয়ার দাবি করতে শুরু করে। এটি এক ধরনের অদৃশ্য সত্ত্বা হয়ে ওঠে—যে শক্তি সমাজের মধ্যে প্রবাহিত হলেও তার কোনো দৃশ্যমান চিহ্ন ছিল না।
নিষিদ্ধ রাজনীতির সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি হলো—এটি এক অদৃশ্য মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়, যেখানে সমাজ তার আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলে। একটি রাজনৈতিক দল বা সংগঠন যখন প্রকাশ্যে কাজ করতে পারে না, তখন তারা গোপনে অন্য কোনো ছদ্মবেশ ধারণ করে। সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশকে আরও অস্থির করে তোলে, তবে এর পেছনে কেবল ঘৃণা এবং বিভক্তি থাকে। এই বিভক্তি এবং গোপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তখন এক অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর দিকে সমাজকে ঠেলে দেয়। যেখানে সত্যিকার অপরাধী কখনোই ধরাছোঁয়া হয় না, এবং অপরাধের ফলে কোনো ন্যায়বিচার বা প্রতিকার পাওয়া যায় না। যখন কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড আর প্রকাশ্যে আসে না, তখন বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় পৌঁছে যায়।
যখন গণতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ—স্বাধীনতা, সুশাসন, ন্যায়বিচার—ধ্বংস হয়, তখন এটি কেবল রাজনৈতিক মৃত্যুর সংকেত দেয় না, এটি এক সমাজের সাংস্কৃতিক এবং নৈতিক মৃত্যুও। গুপ্ত রাজনীতি সমাজের রক্তক্ষরণ করে, যেখানে সবাই নিজেকে নিরাপদ মনে করে না, যেখানে সবাই ভীত। সামাজিক শান্তির পরিবর্তে, এটি এক নতুন যুদ্ধের সূচনা করে, যেখানে শাসকদের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণই একমাত্র অগ্রাধিকার। আর জনগণ, যাদের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই, এক বিপন্ন অস্তিত্ব হয়ে ওঠে, যাদের স্বাধীনতা শুধু নামমাত্র—সামাজিক মৃত্যুর অপেক্ষা।
এই পরিস্থিতি একটি ভয়ানক শূন্যতা সৃষ্টি করে, যা সামাজিক শৃঙ্খলা এবং ন্যায়ের প্রতি মানুষের আস্থা ধ্বংস করে। একটি রাষ্ট্রের ওপর যখন কোনো দায় বা জবাবদিহি না থাকে, তখন সে রাষ্ট্র ক্রমশ অরাজকতা, অন্ধকার এবং বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যায়। রাজনৈতিক দলগুলি যখন নিজেদের কার্যক্রম গোপনে চালায়, তখন এই সমাজে তার পরিণতি হবে, এক শূন্যতার অবস্থা, যেখানে কেউ আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না।
নিষিদ্ধ রাজনীতি বা গুপ্ত রাজনীতি কেবল ক্ষতির কারণ নয়, বরং এটি একটি মৃত্যু নির্ভর প্রক্রিয়া, যেখানে সমাজ ও রাষ্ট্র উভয়ই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলে। একে হত্যা করার জন্য প্রয়োজন হয় এক গম্ভীর সামাজিক সচেতনতা, যেখানে জনগণ তাদের মৌলিক অধিকার এবং ন্যায়ের প্রতি সচেতন হয়ে উঠবে। তবে, যতদিন না আমরা এই নিষিদ্ধ রাজনীতির ভেতরে প্রবাহিত অন্ধকার শক্তি বুঝতে পারবো, ততদিন আমাদের সমাজ এই ভূত-রাজনীতির জালে আবদ্ধ থাকবে, আর সমাজে ন্যায়বিচারের চূড়ান্ত মৃত্যু ঘটবে।