ঢাকাবৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

গরিব মানুষ হাঁটতে গেলেও তল্লাশি, হাইসা উঠলেই জিজ্ঞাসাবাদ | কলাম

সাজিদ সামী চৌধুরী | সিটিজি পোস্ট
নভেম্বর ৫, ২০২৪ ১:২৫ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

এই নগর যেন এক চলমান রঙ্গমঞ্চ, যেখানে প্রতিদিনই নতুন নতুন চরিত্র আর গল্পের দেখা মেলে। আমি একজন তরুণ সাংবাদিক; নগরের আনাচে-কানাচে ঘুরে, বাজার থেকে যানজট, সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে চায়ের টং পর্যন্ত, সবকিছুতেই কিছু না কিছু রসিকতা আর বাস্তবতার গল্প খুঁজে পাই। এখানে প্রতিটি সংকটই যেন এক বিশেষ দৃশ্য, যেখানে হাসির মাঝেই লুকিয়ে থাকে আমাদের জীবনের টানাপোড়েন।

 

নগরের ব্যস্ত জীবন আর এর গভীর সংকটগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরে যে এক মজার সমান্তরাল পৃথিবী, তা হয়তো আমরা প্রতিদিন দেখতে পাই কিন্তু আসলে বুঝে উঠতে পারি না। একদিকে চাল-ডালের দাম, অন্যদিকে সড়কে যানজটের জ্বালা। তরুণ সাংবাদিক হিসেবে যখন আমি নগরের এইসব সমস্যা নিয়ে স্টোরি করতে শুরু করলাম, তখন নানা চরিত্র, নানা ঘটনা আর নিত্যদিনের জীবন সংগ্রামের বুদ্ধিদীপ্ত ও হাস্যরসাত্মক এক ছবি সামনে উঠে এলো।

 

আমার কাজের শুরুতেই বাজারের দিকে যাই। বাজারের চিত্র মানে এক বিশাল থ্রিলার, যেখানে মুরগির দাম কখনো আকাশছোঁয়া, কখনো নামছে না নামছে না! বেলায়েত মিয়া, আমাদের প্রিয় মুদি দোকানদার, তার দোকানের আড়াল থেকে মাঝেমাঝে এক শ্বাস ছাড়েন আর বলে উঠেন, “দাম তোলার লজিক যে কি, আমাগো মাথায় ধরে না, শুধু গলায় ফাঁস পড়ে।” মানুষের প্রতিদিনের পণ্য কিনতে গিয়ে দরদাম করার দৃশ্য যেন ছোটখাটো এক ড্রামা। প্রতিদিন বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম যেভাবে বাড়ে, তাতে কারো আর নিয়মিত বাঁচার উপায় নেই। বেলায়েত মিয়ার মতো অনেক দোকানদারই হাল ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু কোনো গ্রাহক তার কাছে এসে যদি একটু দরদাম করে, তাহলে তিনি আবার সেই নাটকেরই অংশ হয়ে যান।

 

বাজার থেকে বেরিয়ে ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়ালে দেখা যায়, একেক গাড়ি তো একেকটা ভিন্ন জগতের প্রতিনিধিত্ব করছে। পথে পথে ট্রাফিক পুলিশ যেন নগরের ট্রাফিকের দৈনন্দিন পরিচালক। তারা শৃঙ্খলারক্ষার পাশাপাশি ইচ্ছেমতো গাড়ি থামিয়ে ফাইন করছেন। যানজট নিয়ন্ত্রণের নামে অবস্থা এমন যে, মানুষের জীবন থেকে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় চলে যাচ্ছে রাস্তায় বসে। এতে গাড়ির চালকদের মেজাজ গরম হয়েই আছে। কিন্তু এই গরম মেজাজেও কখনো আবার ছোটখাটো হাসির ঘটনা ঘটে। একদিন এক পাঠাও ড্রাইভার রাকিবকে দেখি, যিনি তার যাত্রীর অভিযোগ শুনে কেবল হেসে বললেন, “ভাই, আমি যদি সাড়ে পাঁচ মিনিটে যানজটের কবলে না পড়ি, তাহলে তো আমার কাজই বৃথা!” রাকিবের এই কথায় এমনই সত্য ও ঠাট্টা লুকানো যে বুঝে উঠতে পারলাম—নগরের এই যানজট আসলে আমাদের জীবনেরই এক ছোটখাটো নিদর্শন, যেখানে আমরা কখনোই শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে পারি না, কেবল মাঝপথে আটকে থাকি।

 

ট্রাফিক পেরিয়ে সিএনজি স্ট্যান্ডে গেলে দেখা যায় আরেক ধরনের কারসাজি। সেখানে চালকেরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছেন, কোথায় বেশি ভাড়া পাওয়া যায়, কেমন করে তারা যাত্রীকে বেশি চার্জ করতে পারেন। এক চালক আব্দুল করিম বলেন, “দাদা, আমরা কমাইয়া নিলে যে দিন চলে না! গ্যাসের দামও তো মাইর খাইতেছে, আর আমরাও।” তার এই কথায় অদ্ভুত এক খামখেয়ালির সুর। নিজেদের জন্য জীবিকা চালাতে গিয়ে তারা নানা অজুহাত খুঁজে পান। সিএনজির চালকদের এই অযৌক্তিক যুক্তির কাছে সাধারণ মানুষ অসহায়ভাবে চুপসে যায়। আর তার মাঝেই সমাজের এক অদৃশ্য বৈষম্যের গল্প বয়ে চলে।

 

এই পুরো আড্ডার মাঝে, হঠাৎ এক কোণ থেকে উঠে এলেন আবদুল খালেক পাগলা। কেউ বলে তিনি পাগল, কেউ বলে বড্ড বুদ্ধিমান। তাঁর মাথার ওপরে ফাটা ছাতা, হাতে লাঠি, চোখে নাকি পৃথিবীটা ভিন্নভাবে দেখা ক্ষমতা। পাগলা বলে উঠলেন, “এই জীবনও এক বিচিত্র খেলা, বোঝো! তোমরা যে গরিব মাইনষ্যের কথা কও, আমি তাদেরই মুলুকের রাজার মতো। বাপ, সবখানে ট্যাক্স, ঘুষ, মালের দাম বাড়ে—এক্কেবারে খেয়াল-খুশির মতো!

 

গরিব মানুষ হাঁটতে গেলেও তল্লাশি, হাইসা উঠলেই জিজ্ঞাসাবাদ। আর বড়লোকেদের লাইগা? আলাদা মাফ আর আলাদা বিচার। ট্রাফিকের লাইন ভেঙে ওরা দিব্যি চলে যায়, আর আমাগো পায়ে দড়ি লাগানো! এইসব নাকি আইন! হাহ, আইন তো তোমরা বানাও, আর গরিবেরে বানাও তারই খেলার পুতুল।

 

আমারে কয় পাগল! আমিই তো দেখি এই শহর, শহরের মানুষ আর তাদের সুখ-দুঃখ। আমার কথাও একদিন কোনো পাগলের মতোই শোনাবে, কিন্তু জানবা, এই শহরের মাটিতে আমি আছি, আর এই মাটির কথা আমি কই!”

 

পাগলা খালেকের কথা শুনে আমরা সবাই চুপসে গেলাম। হাসির ছলে হলেও, তাঁর মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা সত্য যেন একেবারে আমাদের প্রাণ ছুঁয়ে গেল। বুঝলাম, আমাদের জীবনটা একটা বায়স্কোপ। আর এই বায়স্কোপের সবচেয়ে অনন্য দৃশ্যগুলোতে লুকিয়ে থাকা স্মৃতির ক্ষীরে জমানো ভীড়, যেনো এই নগরের অলিগলিতে গড়ে ওঠা প্রেম, চায়ের দোকান।

 

চায়ের কথা বলতেই চোখে ভাসে টংয়ের আড্ডা বা ঝুপড়ির কথা। ছোট টং দোকানগুলো যেন নগরের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে রাজনীতির থেকে সমাজের সকল বিষয়ে আলোচনা হয়। এক বিকেলে চায়ের দোকানে দাঁড়ালে শুনলাম ভিখারি হানিফের কথা, যিনি জীবনের বঞ্চনা আর সংগ্রামের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বলেন, “আমাদের কথা কেডা শুনবে? গরীবের মুখে কেউ কান দেয় না!” হানিফের এই কথার মাঝে যেমন অভিযোগ আছে, তেমনি আছে নিঃশব্দ মেনে নেওয়া। তার জীবনসংগ্রাম থেকে কেউ কিছু শিখবে না, অথচ তার মুখের কথা যেন আমাদের এই কষ্টের আর সংগ্রামের পথের এক চমৎকার প্রতিচ্ছবি।

 

কটকটে সেমিস্টারের যান্ত্রিকতার ফাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেপুলেরা শান্তি খুঁজতে ভীড় জমায় চায়ের দোকানগুলোতে। আমিও সারথি ছিলাম সেদিন বিশ্রামের আড্ডায়। ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে আছেন রিকশাচালক খালেদ মিয়া, টেম্পু চালক আলম শেখ, আর মুদি দোকানি ছফুরা বেগম। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সবাই আলোচনা করছেন নিজেদের জীবনের ছোট-বড় হতাশার গল্প। শহরের কোণায় কোণায় ঘুরে বেড়ানো আর প্রতিদিনের দিনযাপন নিয়ে এদের একেকজনের জীবনে রয়েছে নানা ধরনের টানাপোড়েন। কিন্তু তাতে কি! এভাবেই তো কাটে জীবনের প্রতিটি সকাল।

 

খালেদ মিয়া একটু হতাশা মাখা কণ্ঠে বললেন, “দেখেন, মামা, এই শহরে তো আমাদের মত মানুষজনরে কেউ কয় না। কাজ করি তো দিনরাত, পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ব্যথা হয়। কই? পকেটে কয় টাকা রাখি? সবই যায় বাজারের কামে।” তার কথা শুনে ছফুরা বেগম মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁরে খালেদ ভাই, কয়দিন আগে তো আমি মাছ কিনতে গেলাম, দোকানদার কইলো, এক সের মাছ কিনতে গেলে দেড়শো লাগবে! তাও আবার ছোট ইলিশ!” ছফুরা একটু রেগেই বললেন।

 

আলম শেখ হালকা হাসি দিলেন। তিনি বললেন, “আরে আপা, মাছের দাম নিয়াই যদি আফনে এমন বলেন, তয় ট্রাফিকগুলান কী অবস্থা দেখছেন? আমগো টেম্পু চালাইতে গেলেও মামার লাইগা মাসে মাসে টাকা দিতে হয়। কইলেন না হয় খালাস পাইতে, কিন্তু টাকা না দিলে জেল খাইতে যাব।”

 

সবাই একটু হেসে উঠল আলমের কথা শুনে, তবে সেই হাসির পেছনে ছিল তিক্ত অভিজ্ঞতা আর দুঃখের মিশ্রণ। সবার জীবনেই কিছু না কিছু সমস্যা। এক পাশে বসা ছিল পাঠাও চালক সাইফুল। সে একটু চুপচাপ ছিল। সাইফুল খুব তরুণ, এই কাজ শুরু করেছে পরিবার চালানোর জন্য। ক্লাস শেষ করে ফাঁকা সময়টা শহরের পথে পাঠাও চালিয়ে কিছু টাকা উপার্জন করে সে।

 

“বড়দের কথা শুনলে বুঝি, আমাদের আসলেই কিছু করার নাই,” সাইফুল বলেন। “আমরা জানি, প্রতিদিন একটু বেশি আয় করার চেষ্টা করি। কিন্তু ব্যাটারি চালানো বাইক আর পথের খরচ এত বেশি যে আমরা যা পাই তা দিয়ে কিচ্ছু করা যায় না।” সাইফুলের চোখে হতাশা।

 

এদিকে দোকানের কোণে একজন গৃহপরিচারিকা নুরজাহান বেগম। তিনি এসে দাঁড়ান, বলেন, “দেখেন ভাই, আপনাদের কথা শুনলে মনে হয়, সবাই কম-বেশি আমাদের মতই। আমি যেসব বাড়িতে কাজ করি, তারা খালি কই মাসে একবার রান্নাঘর পরিষ্কার করো। মাইনের কথা বললে, সবাই এমনভাবে তাকায়, যেন আমি টাকা চুরি করছি!”

 

ওদিকে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ান মকবুল সর্দার একদম চুপ থাকতে পারেননি। তিনিও একটু ঘাড় উঁচু করে বলেন, “আমার বেতন ভাই মাস শেষেও বাড়ে না। অথচ কাজ করি বাড়ির সব দরজা পাহারা দিতে। একটাও ছুটি পাই না, তাও আমার মত দারোয়ানের কথা কেউ শুনতে চায় না।”

 

একপাশে বসা ভিখারী করিমউদ্দিন মিয়া সবার কথায় কিছুক্ষণ চুপচাপ শুনে অবশেষে বলে উঠলেন, “আরে ভাই, তোমাদের মতো মানুষের কথা না শুনলে কাদের কথা শোনে এই শহর? আমার মতন মানুষ তো খালি দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ায়। আমাদেরও তো বাঁচতে হয়। এই শহরে গরিব মানুষ কি মানুষ না?”

 

সবার কথায় যেন ক্ষোভের জোয়ার উঠে আসে। জীবনযাত্রার এই নিত্য সমস্যা, ট্রাফিকের ঘুষ, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি—সব যেন তাদের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে। এখানে রিকশাচালক থেকে গৃহপরিচারিকা, দোকানি থেকে দারোয়ান, সবার জীবনের গল্প আলাদা হলেও তাদের চাহিদাগুলো খুবই সাধারণ: একটা সম্মানজনক জীবনযাত্রা।

 

শেষে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আলম বললেন, “এইসব কথা কইয়া আর কি হবে, মামা? আমরা তো আমাদের মত করেই বাঁচতে শিখে গেছি। তবে সত্যি বলতে, এই শহরে আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে রাস্তায় নামছি, নিজেরাই নিজের যন্ত্রণা ভাগাভাগি করি।”

 

শহরের ছোট্ট চায়ের দোকানে বসা এই মানুষগুলোর গল্পে যেন জীবনের রঙিন বৃত্তে সব মিশে গেছে। কিন্তু তাদের দুঃখ-কষ্টের এই আলাপ যেন কখনোই শহরের বড় ভবনগুলোর ভেতরকার শক্ত দেওয়াল ভেদ করে পৌঁছাতে পারে না।

 

এভাবে বিভিন্ন মানুষের নানা অভিজ্ঞতা আর আলাপ শুনতে শুনতে বুঝে গেলাম, আমাদের জীবনের প্রতিটি সংকট, প্রতিটি ছোট-বড় সমস্যা যেন এক টুকরো ঠাট্টার সুরে মিশে থাকে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সড়কে যানজট, বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতি—সব কিছু নিয়েই মানুষ কেবল মজা করে বলে, কিন্তু মনের ভেতরে কষ্ট থাকে। আমরা যখন কোনো সমস্যার সমাধান খুঁজে পাই না, তখন তার প্রতি একটা ঠাট্টার সুর মিশিয়ে দিই, যেন সেটা আমাদের জীবনকে এতটা ভারী মনে না হয়।

 

এই গল্পগুলো শুধু দৈনন্দিন জীবন নয়, বরং এই শহরের গভীর বাস্তবতা। হাঁসফাঁসের মধ্যে হাসি, আর হাসির ভেতর বিষণ্নতা—নগরীর প্রতিটি সংকটে আমি সেই দ্বন্দ্বের খোঁজ পাই। দিনের শেষে যখন শহরের আলো নিভে আসে, তখন মনে হয়, এই অগণিত মানুষ আর তাদের ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্নই আমাদের শহরের আসল চালিকা শক্তি। তারা কেবল প্রতিদিন বেঁচে থাকে না, বরং নিজেদের গল্প দিয়ে আমাদের এই নগরকে এক অদৃশ্য শক্তিতে বেঁধে রাখে।