কক্সবাজার সীমান্ত উপজেলা টেকনাফে অপহরণ ও মুক্তিপণ বাণিজ্য থামছে না রোহিঙ্গা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের। কৃষকরা চাষের জমিতে গেলেই অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ আদায় করছে এসব পাহাড়ি সন্ত্রাসী।
এই ভয়ে কয়েক বছর ধরে প্রায় ৪০০ একর জমিতে চাষ করতে পারছেন না স্থানীয় কৃষকরা। এতে কৃষকদের সংসারে নেমে এসেছে অভাব-অনটন। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে টেকনাফের কয়েকশ পরিবার।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার পর থেকে স্থানীয়দের চাষাবাদের বেশিরভাগ জমিতে রোহিঙ্গাদের বসতি হয়ে গেছে। পাহাড়ের পাদদেশে স্থানীয়দের চাষাবাদের জমিগুলো খালি পড়ে আছে।
এই কৃষি জমিতে ডাকাতের ভয়ে কোনো কৃষক চাষ করতে পারছেন না। হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা, রঙ্গি খালী, পানখালী, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের পশ্চিম মহেশ কালিয়াপাড়া, কম্বন, বাহারছড়া শীলখালী, জুম্মাপাড়াসহ অনেক কৃষিজমি।
স্থানীয়রা জানান ,পাহাড়ের পাদদেশে ক্ষেতখামার করতে গেলেই পাহাড়ে থেকে এসে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। পরে পরিবারের লোকজনের কাছে মোবাইল ফোনে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করে সন্ত্রাসীরা। মুক্তিপণ দিতে না পারলে লাশ হয়ে ফিরতে হয় পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের কবল থেকে। রোহিঙ্গা আসার পর থেকে ক্ষেত-খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্থানীয়দের দিন কাটছে এখন অভাব-অনটনে।
ক্ষেতখামার বন্ধ থাকায় কাঁচা বাজারেও বিরাট প্রভাব পড়েছে। ফসলি জমিতে গেলে প্রতিনিয়ত অপহরণের শিকার হচ্ছেন স্থানীয় চাষিরা। হ্নীলা আলীক আকবর পড়ার স্থানীয় কৃষক কলিলুর রহমান বলেন, আমার ১০-১৫-খানি জমি রয়েছে। ডাকাতের ভয়ে সেখানে চাষ করতে যেতে পারছি না। আমরা এত টাকা কোথায় পাব ডাকাতকে দেওয়ার জন্য।
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি মেম্বার বশির আহমদ বলেন, পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের কারণে চার’শ একর চাষাবাদের জমি খালি রয়েছে। কৃষকরা সেখানে চাষ করতে পারছে না ডাকাতের ভয়ে। রোহিঙ্গা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের তালিকা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানান। জমিতে চাষাবাদ করতে না পেরে ৮০ শতাংশ কৃষিনির্ভর মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে কষ্টে দিনযাপন করছে।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমদ আনোয়ারী জানান, রোহিঙ্গা আসার পর থেকে পাহাড়ি এলাকায় কৃষি কাজ করতে গেলে কৃষকদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। এতে সন্ত্রাসীদের ভয়ে চাষ না করায় অনেক জনের জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। গত ১৫ অক্টোবর মঙ্গলবার কম্বনিয়া পাড়ার পাহাড় সংলগ্ন কৃষি জমিতে কৃষি কাজ করার সময় ২ কৃষককে অপহরণ করা হয়।
বুধবার দিবাগত রাতে এই ২ কৃষক ঘরে ফিরে। অপহৃতদের স্বজনরা গোপনে অপহরণকারীদের সাথে যোগাযোগ করে মুক্তিপণের টাকা দিয়ে দুই জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, মূলত পাহাড়ে অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও স্থানীয় অপরাধীরা এতে জড়িত। এদের ভয়ে এলাকার মানুষ আতঙ্কিত।
উল্লেখ, গত ১৭ সেপ্টেম্বর টেকনাফের হোয়াইক্যং-শামলাপুর সড়কে তিনটি সিএনজি (অটোরিকশা) গতিরোধ করে ড্রাইভারসহ ৮ জন অপহরণের শিকার হলেও পরে স্থানীয় জনতা ও পুলিশ ৩ ড্রাইভার ১ যাত্রীকে উদ্ধার করে। বাকি আরও ৪ জন যাত্রী ডাকাত দলের হাতে রয়ে গেছে। পরে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছে অপহৃত ৪ জন।
এর আগে ১৪ আগস্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক একটি অপহরণ চক্রের হাতে অপহৃত হয়েছেন মুহাম্মদ নুর। অপহৃত মো. নুর হ্নীলা নুর আলী পাড়া এলাকার চৌকিদার মৃত আলী হোছনের ছেলে। তাকেও ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ নিয়ে ৪ দিন পর ছেড়ে দিয়েছে।
হ্নীলা ইউপির চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, স্থানীয় ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা মিলে সাধারণ মানুষকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছে। গত দুদিনে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে এক ছাত্র ও ২ কৃষক ফিরে এসেছেন। পরেরদিন ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে আরও একজন ফিরেছেন। তবে এলাকা ভিত্তিক কমিটি করে প্রশাসনের সহযোগিতায় প্রতিরোধের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
টেকনাফ উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. শফিউল আলম বলেন, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কৃষকদের নিরাপত্তার বিষয়ে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা সভায় অবগত করা হয়েছে। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আছে। কৃষকরা অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। দিন দিন তারা কৃষিকাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। প্রশাসনের সহযোগিতা পেলে আমরা কৃষকদের সরকারিভাবে সহযোগিতা করব।