অপরাধের জন্য আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম বর্তমান বা সাবেক প্রেসিডেন্ট হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন রাজনীতিতে এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। সাবেক পর্নো তারকাকে মুখ বন্ধ রাখার জন্য টাকা দেওয়ার মামলায় ৩৪টি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন ট্রাম্প। মার্কিন আইনে কাউকে মুখ বন্ধ রাখার জন্য টাকা দেওয়াকে হাশ মানি বলা হয় যা বেআইনি নয়, তবে টাকাটা দিতে গিয়ে ব্যবসায়িক রেকর্ডে জালিয়াতি করেছেন ট্রাম্প। এজন্য নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের আইনে ফেঁসে যান তিনি।
আগামী ১১ জুলাই ট্রাম্পের সাজা ঘোষণা করবেন আদালত। এর ঠিক চার দিন পরই রিপাবলিকান পার্টির দলীয় কনফারেন্সে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে ট্রাম্পকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত করার কথা। ঐতিহাসিক এ রায়ের পরিণতি কী তা তাৎক্ষণিকভাবে অত্যন্ত অস্পষ্ট। এ রায় ট্রাম্পকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর অযোগ্য করবে কিনা তা নিয়ে কারও কারও মনে প্রশ্ন রয়ে গেছে। তবে বিশ্লেষকরা অনেকেই বেশ আগে থেকেই বলছেন, আদালতে অভিযুক্ত এমনকি দণ্ডিত হলেও সংবিধান অনুযায়ী একজন ব্যক্তি নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন। মার্কিন সংবিধানে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের জন্য যোগ্যতার প্রয়োজনীয়তা অপেক্ষাকৃত কমই। তাদের কমপক্ষে ৩৫ বছর বয়সী, দেশের মাটিতে জন্মগ্রহণকারী মার্কিন নাগরিক এবং কমপক্ষে ১৪ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী হতে হবে। অপরাধের রেকর্ড থাকা প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঠেকানোর কোনও বিধান নেই। একজন ব্যক্তি এমনকি কারাগারে থেকেও প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। এসব মাথায় রেখেই হয়তো তার প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের প্রচারকর্মীরা এক বিবৃতিতে ভোটারদের মনে করিয়ে দিয়েছে, ট্রাম্পকে পরাজিত করার একমাত্র উপায় ব্যালট বাক্স, আদালত নয়।
ম্যানহাটন আদালতের সাবেক প্রসিকিউটর ডানকান লেভিন বলেছেন, ডিসট্রিক্ট অ্যাটর্নি অফিস একটি ‘পুঙ্খানুপুঙ্খ’ মামলা উপস্থাপন করেছে যা সন্দেহাতীতভাবে ট্রাম্পের অবৈধ প্রক্রিয়ায় অর্থ প্রদানের বিষয়টি প্রমাণ করেছে। এটি বাদীপক্ষের জন্য এক বড় জয় বলে মন্তব্য করেছেন লেভিন।
অনেকেই মনে করেন ট্রাম্পের কট্টর সমর্থকরা যত যাই হোক তাকেই ভোট দেবে। জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের ভোটার ডান্টে সেলার্স এমনই মনে করেন। তবে সাধারণ ভোটাররা দুবার ভাববে। ‘এমন লোক আছে যারা ব্যালট দেখে ভাববে, দোষী সাব্যস্ত অপরাধীকে ভোট দেওয়া কি ঠিক হবে? এটা নিরপেক্ষ ভোটারদের জন্য একটি বড় সমস্যা হবে । তবে আমার জন্য এতে কিছু পরিবর্তন হবে না। কারণ আমি এমনিতেই ট্রাম্পকে ভোট দিতাম না’, বলেন ডান্টে।
জর্জিয়ার জন্য ট্রাম্পের দণ্ডাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এটি একটি ‘সুইং স্টেট’ বা দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য। যেখানে ভোটাররা সবসময় এক দলকে ভোট দেয় না। জনমত সমীক্ষা বলছে, সেখানে এখনও ১৮ শতাংশ পর্যন্ত ভোটার আছে যারা ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান কোন দলের দিকেই ঝোঁকেনি। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২০ সালে দক্ষিণের এ অঙ্গরাজ্যে অল্প ব্যবধানে জিতেছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের লক্ষ্য এবার সেখানে জয় পাওয়া। এমন প্রেক্ষাপটে ডান্তে মনে করছেন, মনস্থির না করা ভোটাররা এখানে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ‘আমি মনে করি যারা ট্রাম্পকে সমর্থন করে তারা রায় যা-ই হোক তাকে সমর্থন করে যাবে’, বলেন ডান্টের বন্ধু মাকিতা ইটন। জর্জিয়ানদের এক-তৃতীয়াংশ কৃষ্ণাঙ্গ। বাইডেন ও ট্রাম্প উভয়েই তাদের ভোট পক্ষে টানতে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ট্রাম্পকে এখনই খরচের খাতায় ফেলার কোন কারণ নেই। তিনি এ রায়ের নিন্দা করে এর বিরুদ্ধে আপিল করার কথা জানিয়েছেন তাৎক্ষণিকভাবেই।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান এবং সাবেক প্রেসিডেন্টদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত বাহিনী সিক্রেট সার্ভিস খুব সংক্ষিপ্ত এক বিবৃতিতে বলেছে, ট্রাম্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনও পরিবর্তন হয়নি। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিক্রেট সার্ভিস যেভাবে প্রতিরক্ষামূলক মিশন পরিচালনা করে তাতে আজকের রায়ের কোন প্রভাব নেই। আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপরিবর্তিত থাকবে।’ সিবিএস নিউজের মতে, নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ট্রাম্পের জন্য সম্ভাব্য হুমকি খতিয়ে দেখছেন এবং প্রয়োজনে তার নিরাপত্তা টিমকে আরও শক্তিশালী করতে প্রস্তুত রয়েছেন।
ট্রাম্পের সমর্থকদের মধ্যে তার প্রতি ভক্তি যে ইস্পাত কঠিন তার আরেক সাক্ষ্য ইতিমধ্যেই মিলেছে। দোষী সাব্যস্ত করে আদালতের রায়ের পর পরই ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় চাঁদা দেওয়ার সংখ্যা রেকর্ড মাত্রায় বেড়েছে। ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার সিনিয়র উপদেষ্টা ব্রায়ান হিউজের তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার বিকেলে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ডিজিটাল তহবিল সংগ্রহের সিস্টেমে রেকর্ড সংখ্যক সমর্থক ছিল। চাঁদা দেওয়ার চাপের কারণে সাইটের গতি মাঝেমধ্যে ধীর হয়ে যাচ্ছিল।
এ কারণেই হয়তো বাইডেনের প্রচারণা দল সাবধান করে দিয়ে বলেছে, তাদের এখনও ব্যালট বাক্সে হারাতে হবে ট্রাম্পকে। তাদের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হন বা না-ই হন, তারা মনে করেন তাকে পরাজিত করার একমাত্র উপায় ব্যালট বাক্সে। তবে আদালতের এই রায় নভেম্বরের ভোটে জয়ের ব্যাপারে বাইডেন পক্ষের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বিবিসির বিশ্লেষক অ্যান্টনি জারখার বলেছেন, ১১ জুলাই মোটা জরিমানা ছাড়াও অন্তত কাগজে-কলমে ট্রাম্পের কারাদণ্ড হওয়া সম্ভব। তবে এ ঘটনার রাজনৈতিক ধাক্কা বিবেচনা করা খুব সহজ হবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে এমন কিছু আগে কখনও ঘটেনি। সাউদার্ন মেথোডিস্ট ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর প্রেসিডেন্সিয়াল হিস্ট্রির পরিচালক জেফ্রি এঙ্গেল এ বিষয়ে বিবিসিকে বলেন, ‘কী ঘটতে চলেছে তার ইঙ্গিত পেতে আমরা প্রায়শই ইতিহাসের দিকে তাকাই। কিন্তু রেকর্ডে এমন কিছু নেই যা এর কাছাকাছিও আসে।’
সাম্প্রতিক জরিপগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে সংখ্যার হিসাবে সমানে সমানে লড়ছেন। নির্বাচনে চূড়ান্ত ফল ঠিক করে দিতে পারে এমন বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুইং স্টেটে সামান্য এগিয়ে আছেন তিনি। তবে সেই জরিপগুলো এটাও বলছে, আদালতের এই দণ্ডাদেশ সব হিসাব নিকাশ পাল্টে দিতে পারে।
গত শীতে রিপাবলিকান দলের প্রাইমারি (প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া) চলার সময় চালানো এক্সিট পোলগুলোতে অনেক দলীয় ভোটার বলেছে, সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হলে তারা তাকে ভোট দেবে না। এগুলো ছিল অনুমানভিত্তিক কথা। তখন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চারটি ফৌজদারি মামলা চলছিল। এবার আদালতের স্পষ্ট রায়ের পর ভোটাররা ভেবেচিন্তে তাদের রায় দিতে পারবেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কখনও কখনও এমন পরিস্থিতিও হয় যে বিশেষ কোন অঙ্গরাজ্যে মাত্র কয়েক হাজার ভোট জয় পরাজয় উল্টে দিতে পারে। ট্রাম্পের সমর্থকদের মধ্যে বড় ধরনের আনুগত্য বদল তাই তার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। আগামী দিনগুলোতে রাজনীতি, আইনি লড়াই ও জনমতের ক্ষেত্রে কী ঘটে তার দেখার জন্য উভয়পক্ষই এখন রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করবে। আপাতত আর কিছু করারও নেই।