আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গণমাধ্যমে অনেক নিবন্ধ প্রকাশ হচ্ছে। বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এসব নিবন্ধ প্রকাশ করা হচ্ছে। এসব নিবন্ধের লেখকদের পরিচয় এমনকি ব্যবহৃত ছবি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বার্তা সংস্থা এএফপির এক অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আসন্ন জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন সামনে রেখে টেকসই প্রচারণার প্রমাণ হিসেবে অজানা লেখকরা এসব লিখছেন। এসব লেখা এশিয়ার প্রভাবশালী ও চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম সিনহুয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার বরাতে ওয়াশিংটনভিত্তিক ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনেও প্রকাশিত হয়েছে।
মানবাধিকার কর্মী ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন বিদেশি শক্তি বর্তমান সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে উদ্বেগ জানিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া তারা বাংলাদেশে মতপার্থক্য বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আসছে।
এএফপির অনুসন্ধানে এমনকিছু তথাকথিত লেখক ও বিশেষজ্ঞদের খোঁজ মিলেছে। এসব লেখক বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন, এমনকি তারা বিভিন্ন হেডশট ছবি চুরি ও লেখায় ভুল উদ্ধৃতি দিচ্ছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন এ সম্পর্কে এএফপিকে বলেছেন, এগুলো হলো সমন্বিতভাবে মানুষকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা।
কোনো তথ্য নেই
এএফপির অনুসন্ধানে এ ধরনের সাত শতাধিক নিবন্ধের তথ্য উঠে এসেছে। এসব নিবন্ধ দেশি-বিদেশি ৬০টি সাইটে ৩৫ জন ব্যক্তির নামে প্রকাশিত হয়েছে। এসব লেখক গত বছরে প্রথমবারের মতো সামনে এসেছেন। এসব নিবন্ধের বেশিরভাগ অতি চীনপন্থি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে সতর্কবার্তার সমালোচনায় লেখা হয়েছে।
এএফপির ওই অনুসন্ধানে ৩৫ ব্যক্তির পরিচয় সঠিক কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কেননা এসব লেখকদের অনলাইনে উপস্থিতি বা কোনো আর্টিকেল পাওয়া যায়নি। এমনকি তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো প্রোফাইল বা অ্যাকাডেমিক জার্নালে কোনো গবেষণাপত্রও পাওয়া যায়নি। ৩৫ ব্যক্তির মধ্যে অন্তত ১৭ জন পশ্চিমা ও এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার দাবি করেছেন। তবে যাচাইবাছাইয়ে এসবের কোনো রেকর্ড পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তালিকায় থাকা এসব ব্যক্তিদের মধ্যে ৯ জনের বিষয়ে আটটি বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, এসব ব্যক্তি তাদের সঙ্গে কখনো কাজ করেননি। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো যুক্তরাষ্ট্রের ডেলওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়, সুইজারল্যান্ডের লুসার্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর।
কথিত এসব লেখকদের একজনের বিষয়ে ভারতের জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, আমাদের নথিপত্রে এমন নাম ও রোলের কারও তথ্য পাওয়া যায়নি।
এএফপির ওই অনুসন্ধানে এমন লেখকদেরও তথ্য মিলেছে যাদের বাংলা ও ইংরেজিতে আলাদা নাম ব্যবহার করা হয়েছে। এসব ব্যক্তিদের একজন হলেন ডোরেন চৌধুরী। তিনি যে ছবিটি ব্যবহার করছেন তা একজন ভারতীয় ফ্যাশন ডিজাইনারের। এ ছাড়া তিনি নিজেকে নেদারল্যান্ডের গ্রোনিংজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরাল গবেষক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে কোনো তথ্য বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে ইমেইলে ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিরাপত্তার স্বার্থে তার পরিচয় জানাতে চাননি।
পুরোটাই সাজানো
ফুমিকো ইয়ামাদা নামের এক ব্যক্তি ব্যাংকক পোস্ট ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের একটি ব্লগে নিবন্ধ লিখেছেন। তিনি নিজেকে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ স্টাডিজের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাবি করেছেন। তবে অনুসন্ধানে বাংলাদেশ স্টাডিজ বলে কোনো বিভাগ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাওয়া যায়নি।
ভুয়া উদ্ধৃতি
পৃত্থীরাজ চতুর্বেদী নামের এক ব্যক্তির একটি লেখায় নেদারল্যান্ডসের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল স্টাডিজের অধ্যাপক জেরার্ড ম্যাককার্থির নামে ভুয়া উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। যেখানে মিয়ানমারের বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বৈত নীতির বিষয়ে তার উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। এ উদ্ধৃতিকে তিনি সাজানো বলে দাবি করেছেন।
ওই লেখাটি একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির ফিচার এডিটর মুবিন এস খান বলেন, আমরা তার অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর আস্থা রেখে বিষয়টি প্রকাশ করেছি।
এ ছাড়া চলতি বছরের শুরুতে নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবীর জানান, তার কাছে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের বিষয়ে বিভিন্ন লেখা পাঠানো হয়েছে। প্রথমে তিনি এগুলো প্রকাশ করলেও পরে ভাড়াটে লেখকদের বিশেষ উদ্দেশ্যে লেখা হিসেবে সন্দেহ করে তিনি তা বাদ দেন। এগুলোর লেখক সব কাল্পনিক চরিত্র বুঝতে পেরে তিনি অবাক হন।
তিনি বলেন, লেখকদের পরিচয় যাচাই করার বিষয়ে এবং ভুল তথ্য ও অপপ্রচারের যুগে আমাদের আরও সচেতন হওয়া উচিত