ঢাকাবুধবার, ৪ঠা জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

কৃষি, জ্বালানি, প্রযুক্তিতে অগ্রাধিকার, সামরিক ও নির্বাচন ব্যয়ে কাটছাঁট : বাজেট ২০২৫

নিউজ ডেস্ক | সিটিজি পোস্ট
জুন ২, ২০২৫ ১১:০৯ অপরাহ্ণ
Link Copied!

দেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েন, মূল্যস্ফীতির চাপ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আজ সকালে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার একটি ঘাটতি-সচেতন বাজেট ঘোষণা করেছেন। এই বাজেট রেডিও ও টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়। এটি একটি ব্যতিক্রমী বাজেট, কারণ এটি সংসদে উপস্থাপন না করেই ঘোষণা করা হয়েছে—যা বাংলাদেশের ইতিহাসে খুবই বিরল ঘটনা

নতুন বাজেটের মোট আকার গত অর্থবছরের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম। এ থেকেই বোঝা যায় যে সরকার ব্যয়ের লাগাম টানতে চাচ্ছে। বাজেটে খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি উৎপাদন, জ্বালানি সরবরাহ এবং প্রযুক্তিখাতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে, প্রতিরক্ষা ও নির্বাচন কমিশনের ব্যয়ে সাশ্রয়মূলক কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। বাজেটে আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—জনদুর্ভোগ লাঘব এবং রাজস্ব আয় বাড়ানোর মধ্যবর্তী সমন্বয় চেষ্টার ছাপ।

দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে আগত বছরের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বাজেটে ঘোষণা করা হয়, চলতি অর্থবছরে ৯ লাখ টন চাল এবং ৭ লাখ টন গম আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮.৫ লাখ টন চাল ইতোমধ্যে আমদানি করা হয়েছে। বাফার স্টক বাড়ানো এবং সার ও খাদ্যদ্রব্যে ভর্তুকি অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

সরকার জানায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বাজার অস্থিরতার কারণে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় ঝুঁকি রয়েছে। সেজন্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি বর্ধিত মজুদ পরিকল্পনার কথা বলা হয়।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ১০% ব্যয় হ্রাসের কথা বলা হয়েছে, যার অংশ হিসেবে এনার্জি অডিট, বিদ্যমান চুক্তির পুনর্মূল্যায়ন এবং এলএনজি সরবরাহ সম্প্রসারণ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে বলা হয়, ২০২৫ সালের মধ্যে অতিরিক্ত ৬৪৮ এমএমসিএফডি এবং ২০২৮ সালের মধ্যে ১৫০০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।

সরকার দাবি করে, জ্বালানি খাতে অধিক দক্ষতা ও স্বচ্ছতা আনার মাধ্যমে ব্যয় হ্রাস এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।

একটি গভীর উদ্বেগের জায়গা হিসেবে বাজেটে উঠে এসেছে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ২০.২০ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের জুনে ছিল ১০.১১ শতাংশ। বাজেটে ঘোষণা করা হয় যে, ঋণ শ্রেণিবিন্যাসে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড (IMF স্ট্যান্ডার্ড) অনুসরণ করা হবে এবং নিয়মিত অডিটের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি বাস্তবায়ন হলে ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা কিছুটা ফিরবে, তবে বাস্তব প্রয়োগ নিয়েই প্রশ্ন থেকেই যায়।

সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো না আসা পর্যন্ত মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী, ১ম থেকে ৯ম গ্রেড পর্যন্ত ১৫% এবং ১০ম থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত ২০% মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হবে। এজন্য বাজেটে ৮০ থেকে ৯০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত বরাদ্দের সম্ভাবনা রয়েছে।

এ নিয়ে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও, অনেকে মনে করেন বেতন কাঠামোর স্থায়ী সমাধান ছাড়া এটি একধরনের সাময়িক উপশম।

১০০ কোটি টাকার একটি জলবায়ু বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে। এই তহবিল ব্যবহৃত হবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং নারীদের অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজেটে জলবায়ু খাতের প্রতিশ্রুতি প্রশংসনীয় হলেও, অর্থের পরিমাণ সীমিত।

বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দ ৪০,৬৯৮ কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় কম। নির্বাচন কমিশনের জন্য ২,৯৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে জাতীয়, স্থানীয় এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের খরচ, এনআইডি ব্যবস্থাপনা, এবং দলীয় নিবন্ধন সংক্রান্ত খরচ।

বিশ্লেষকদের মতে, সামরিক ব্যয় হ্রাস ও নির্বাচন সংক্রান্ত কার্যক্রমে বরাদ্দ সাশ্রয় সরকারের স্বচ্ছতা ও সুশাসনের বার্তা বহন করে।

বর্তমানে দেশের চলতি হিসাব ঘাটতি রয়েছে ৬৬ কোটি ডলার। বাজেটে বলা হয়, জুন মাসের মধ্যে আইএমএফ ও অন্যান্য দাতা সংস্থার কাছ থেকে প্রায় ৩.৬ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়ার আশা করা হচ্ছে। সরকারের দাবি, এই সহায়তা এলে রিজার্ভ ও টাকার মান স্থিতিশীল থাকবে।

এই বাজেটকে অনেকেই দেখছেন একটি ভারসাম্যপূর্ণ অথচ সংকুচিত আর্থিক কাঠামো হিসেবে, যেখানে অগ্রাধিকার খাতগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে, আবার রাজনৈতিক সংবেদনশীল খাতগুলোর ব্যয়ে রাশ টানা হয়েছে।

সংসদে উপস্থাপন ছাড়াই বাজেট ঘোষণার নজির বিরল হলেও, অনেকেই বলছেন এই রাজনৈতিক পরিস্থিতে এটি বাস্তবতারই প্রতিফলন। বাজেটে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর চেষ্টা রয়েছে, তবে বাস্তবায়ন কতটা কার্যকর হবে—তা নির্ভর করবে পরবর্তী প্রশাসনের সদিচ্ছা ও সক্ষমতার ওপর।