ঢাকাসোমবার, ২রা জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার এক অচেনা অধ্যায় : উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ

সাজিদ সামী চৌধুরী | সিটিজি পোস্ট
জুন ১, ২০২৫ ১০:৪৩ অপরাহ্ণ
Link Copied!

একসময় বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম নগরীর পরিচিতি ছিল সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটু বা কোমর পানিতে তলিয়ে যাওয়া। এটি ছিল নগরবাসীর জন্য এক নিয়মিত দুর্ভোগের নাম, যা জীবনযাত্রা ও অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলত । তবে, সাম্প্রতিককালে, বিশেষত ৩০ মে ২০২৫ তারিখে তীব্র বর্ষণ (প্রায় ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত) সত্ত্বেও চট্টগ্রাম নগরীতে উল্লেখযোগ্য জলাবদ্ধতা দেখা যায়নি । এই অপ্রত্যাশিত স্বস্তি অতীতের অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ বিপরীত, যা নগরবাসীর মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হলো চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির এই নাটকীয় পরিবর্তনের পেছনের কারণসমূহ, চলমান বিভিন্ন প্রকল্প ও উদ্যোগের কার্যকারিতা, বিদ্যমান চ্যালেঞ্জসমূহ এবং ভবিষ্যতের জন্য টেকসই সমাধানের পথগুলো বিশ্লেষণ করা। এই বিশ্লেষণ জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর কার্যকারিতা এবং ভবিষ্যৎ নগর পরিকল্পনার দিকনির্দেশনা দেবে।  

এই পরিবর্তনটি একটি গভীর পর্যবেক্ষণের জন্ম দিয়েছে। অতীতে যেখানে বছরের পর বছর ধরে অপরিকল্পিত নগরায়ন, খাল দখল, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা ও সমন্বয়হীনতা জলাবদ্ধতার মূল কারণ ছিল , সেখানে এত দীর্ঘদিনের সমস্যার হঠাৎ করে ‘তীব্র বর্ষায় জলাবদ্ধতা নেই’ হয়ে যাওয়াটা গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এটি কি প্রকল্পের সম্পূর্ণ সফলতার ইঙ্গিত, নাকি সাময়িক স্বস্তি যা কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপের ফল? এই পরিস্থিতির অন্তর্নিহিত কারণ হলো, যদিও মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ সম্পূর্ণ হয়নি এবং চ্যালেঞ্জগুলো এখনও বিদ্যমান , কিছু নির্দিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ ভৌত কাজ (যেমন খাল পরিষ্কার, কিছু স্লুইস গেট চালু, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ) এবং সম্ভবত প্রশাসনিক তদারকি বৃদ্ধি এই সাময়িক স্বস্তি এনেছে। এটি প্রমাণ করে যে, ছোট আকারের কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপগুলোও তাৎক্ষণিক সুফল বয়ে আনতে পারে, যা বৃহত্তর প্রকল্পের সফলতার জন্য একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত। তবে, এই স্বস্তি দীর্ঘমেয়াদী টেকসই সমাধানের নিশ্চয়তা দেয় না, বরং এটি একটি সতর্ক আশাবাদের জন্ম দেয়।

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা, যা প্রায় দেড় দশক ধরে প্রকট হয়েছে । এই সমস্যার মূলে ছিল বহু-মাত্রিক কারণের এক জটিল আন্তঃসম্পর্ক। নগরের বেশিরভাগ খাল দখল হয়ে যাওয়া, নালা-নর্দমা থেকে নিয়মিত মাটি উত্তোলন না করা, এবং অপরিকল্পিত পাইপলাইন স্থাপন (ওয়াসা, বিদ্যুৎ, টিঅ্যান্ডটি, গ্যাস) জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ ছিল । নগরের ৭১টি খালের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ৫৭টির অস্তিত্ব রয়েছে, যার মধ্যে ৩৬টিতে সিডিএ এবং একটিতে চসিক কাজ করছে। বাকি ২০টি খালের উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি । চাক্তাই খাল, রাজাখালী খালের মুখে পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়াও পানি নিষ্কাশনে বাধা সৃষ্টি করে ।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব এবং জনসচেতনতার অভাব এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। নালা-খালে বর্জ্য ফেলা জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ । চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা ড. কিসিঞ্জার চাকমার মতে, শুধু ভৌত কার্যক্রম দিয়ে জলাবদ্ধতা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, নাগরিকদের সচেতনতা বিরাট ভূমিকা পালন করবে । জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বৃষ্টিপাতের ধরন ও পরিমাণ বেড়েছে। চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বছরে প্রায় ৩০০০ মিমি বৃষ্টিপাত হয়, যার সর্বোচ্চ হয় জুন-জুলাই মাসে । জোয়ারের সময় ভারী বৃষ্টিপাত হলে কর্ণফুলী নদীতে পানি নামতে না পারায় জলাবদ্ধতা আরও ভয়াবহ হতো ।

এই সমস্যাগুলো কেবল প্রাকৃতিক বা অবকাঠামোগত ছিল না, বরং এর মূলে ছিল দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। ‘তদারকহীনভাবে’ কাজ হওয়ায় সমস্যা বাড়ছিল এবং জনভোগান্তি বেড়েই চলছিল । কমিটি চিহ্নিত সমস্যাগুলো নতুন না হলেও সমাধান কার্যক্রমে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি । বিভিন্ন সংস্থা যার যার মতো কাজ করায় এবং একে অপরের উপর দায় চাপানোয় সমস্যার মূল কারণগুলো (যেমন খাল দখল, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা) অনুল্লেখিত থেকে গেছে, যার ফলে বিপুল অর্থ ব্যয় করেও সুফল আসেনি। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ছিল জলাবদ্ধতার সবচেয়ে বড় চালিকা শক্তি। এই আন্তঃসম্পর্ক বোঝায় যে, জলাবদ্ধতা নিরসনে কেবল একটি বা দুটি ক্ষেত্রে কাজ করলেই হবে না। এটি একটি ‘সিস্টেমিক’ সমস্যা, যার জন্য একটি সমন্বিত, বহু-মাত্রিক এবং দীর্ঘমেয়াদী কৌশল প্রয়োজন। শুধুমাত্র ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ (যেমন খাল খনন) যথেষ্ট নয়; এর সাথে ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এটি প্রমাণ করে যে, সমস্যাটি কেবল প্রকৌশলগত নয়, বরং এটি একটি সামাজিক, পরিবেশগত এবং প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ।

৩০ মে ২০২৫ তারিখে ভারী বৃষ্টিপাত সত্ত্বেও চট্টগ্রাম নগরীতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়নি । বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, আগ্রাবাদ, চকবাজার, বাকলিয়া, কাপাসগোলা, পতেঙ্গা, হালিশহর, ফিরিঙ্গিবাজার, ষোলশহর, ২ নম্বর গেট, জিইসি মোড়, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, প্রবর্তক মোড়, বারইপাড়া, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ-আছাদগঞ্জ—এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা যায়নি । বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা তোফাজ্জল মিয়া এবং শফিউল আলম বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, টানা বৃষ্টি সত্ত্বেও তাদের এলাকায় পানি জমেনি । মুরাদপুরের বাসিন্দা মাহফুজুর রহমান জানান, ভারী বর্ষণে কিছু সময়ের জন্য সামান্য জলাবদ্ধতা হলেও ২০-৩০ মিনিটের মধ্যেই পানি নেমে যাচ্ছে । চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা ইখতিয়ার উদ্দিন নিশ্চিত করেছেন যে, খাল ও নর্দমায় পানি প্রবাহ স্বাভাবিক থাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়নি এবং পরিস্থিতি অনেক ভালো । পতেঙ্গা আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত প্রায় ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড হলেও জলাবদ্ধতা হয়নি ।

এই ইতিবাচক পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সমন্বিত প্রচেষ্টা ও মেগা প্রকল্পগুলোর আংশিক বাস্তবায়ন । সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন যে, বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে খাল ও নালা-নর্দমা পরিষ্কার ও খননে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে । চাক্তাই খাল খনন এবং খালের ভেতরের বাঁধ অপসারণ করা হয়েছে । চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে । এই প্রকল্পের আওতায় বহদ্দারহাটসহ জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকায় নালা সম্প্রসারণ, নতুন করে নির্মাণ এবং দুটি খালের (চশমা ও মীর্জা খাল) সঙ্গে সংযোগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে । সিডিএ অ্যাভিনিউয়ের নালা সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙা হয়েছে । সিডিএ’র জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেড কাজ করছে । জলাবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্পের আওতায় মহেশখাল, টেকপাড়া, কলাবাগিচা, ফিরিঙ্গিবাজার ও মরিয়ম বিবি খালে স্লুইস গেট স্থাপন করা হয়েছে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহ আলী জানিয়েছেন, পাঁচটি স্লুইস গেট চালু হয়েছে এবং মহেশখালের স্লুইস গেটের সুফল পাওয়া যাচ্ছে । কর্ণফুলী নদীর সাথে সংযুক্ত স্লুইস গেট এবং পাম্প স্থাপন এপ্রিলের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা, যা জোয়ারের পানিজনিত জলাবদ্ধতা দূর করবে । এলাকার ড্রেন ও খালগুলো পরিষ্কার থাকায় পানি জমতে পারেনি এবং বৃষ্টির পানি নর্দমা ও খাল হয়ে নদীতে চলে যাচ্ছে ।

এই পরিস্থিতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে নির্দেশ করে: জলাবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ যদিও এখনও ১০০% সম্পন্ন হয়নি এবং দীর্ঘসূত্রিতা ও সমন্বয়হীনতার মতো চ্যালেঞ্জগুলো বিদ্যমান , তবে প্রকল্পের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভৌত কাজ (যেমন প্রধান খালগুলোর খনন, স্লুইস গেট স্থাপন ও চালু করা, এবং নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান) তাৎক্ষণিক ও দৃশ্যমান সুফল বয়ে এনেছে। এটি প্রমাণ করে যে, সঠিক স্থানে এবং সঠিক সময়ে করা বিনিয়োগ এবং কার্যকর পদক্ষেপগুলি, এমনকি অসম্পূর্ণ হলেও, বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই পরিস্থিতি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে: এই স্বস্তি কতটা টেকসই? এটি কি কেবল বর্ষা শুরুর আগে খাল পরিষ্কার এবং কিছু স্লুইস গেট চালু করার ফল, নাকি প্রকল্পের সামগ্রিক নকশা এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতি সত্যিই কার্যকর হচ্ছে? যদি এই স্বস্তি ধরে রাখতে হয়, তবে চলমান প্রকল্পগুলোর দ্রুত ও সমন্বিত সমাপ্তি এবং দীর্ঘমেয়াদী রক্ষণাবেক্ষণ অপরিহার্য। এটি একটি “অসম্পূর্ণ সফলতার” দৃষ্টান্ত, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত হলেও আত্মতুষ্টির সুযোগ দেয় না।

চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে প্রায় ১৬ হাজার ৭৭১ কোটি টাকার চারটি বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে । তবে, অন্য একটি সূত্রে চারটি প্রকল্পের মোট ব্যয় ১৪ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা এবং খরচ হয়েছে ৮ হাজার ৩১২ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়েছে । এই প্রকল্পগুলো চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক/সিডিএ), চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বাস্তবায়ন করছে । সিডিএ’র জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেড কাজ করছে ।

চট্টগ্রামের প্রধান জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পগুলোর একটি বিশদ চিত্র নিচে তুলে ধরা হলো। এই তথ্যগুলো বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতি, ব্যয় এবং সময়সীমার মধ্যে তুলনা করার সুযোগ দেয়। এটি প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতা, ব্যয় বৃদ্ধি এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার মতো সমস্যাগুলোকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরবে। উদাহরণস্বরূপ, চসিকের প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া এবং সিডিএ’র প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব পাশাপাশি দেখলে প্রকল্পের বাস্তবায়নগত চ্যালেঞ্জগুলো আরও স্পষ্ট হবে। এটি রিপোর্টকে আরও একাডেমিক এবং তথ্যবহুল করে তুলবে। এই তথ্য নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি দ্রুত রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে কাজ করতে পারে, যা তাদের প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা এবং কোথায় সমস্যা হচ্ছে সে সম্পর্কে দ্রুত ধারণা দেবে। এটি কেবল একটি ডেটা উপস্থাপন নয়, বরং একটি বিশ্লেষণাত্মক সরঞ্জাম হিসেবে কাজ করবে।

চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পটি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) দ্বারা বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর আনুমানিক ব্যয় ৮,৬২৬ কোটি টাকা, যা প্রাথমিকভাবে ৫,৬১৬.৪৯৯ কোটি টাকা ছিল । ২০১৭ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের মূল সময়সীমা ছিল ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত, যা পরে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে । বর্তমানে এর অগ্রগতি ৭৫-৮০ শতাংশ । এই প্রকল্পের আওতায় ৩৬টি খাল পুনঃখনন করা হচ্ছে এবং ২১টি নতুন খাল যুক্ত হবে ।

কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি সিডিএ দ্বারা বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর আনুমানিক ব্যয় ২,৭৭৯ কোটি টাকা, যা প্রাথমিকভাবে ২,৩১০ কোটি টাকা ছিল । ২০১৭ সালের জুন মাসে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল, যা পরে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে । বর্তমানে এর অগ্রগতি ৭৮ শতাংশ , তবে এর অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে কম বলে উল্লেখ করা হয়েছে ।

বহদ্দারহাট বারৈপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন খাল খনন প্রকল্পটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) দ্বারা বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর আনুমানিক ব্যয় ১,৩৬২ কোটি টাকা, যা প্রাথমিকভাবে ১,২৫৬.১৫ কোটি টাকা ছিল । ২০১৪ সালে অনুমোদিত এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ছিল, যা পরে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল । বর্তমানে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে এবং কাজ থমকে আছে, মেয়াদ আর বাড়ানো হয়নি ।

চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা/জলজট নিরসন, নিষ্কাশন ও উন্নয়ন প্রকল্পটি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) দ্বারা বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর আনুমানিক ব্যয় ১,৬২০.৭৩ কোটি টাকা । ২০১৯ সালে অনুমোদিত এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল, তবে এটি ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল । বর্তমানে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে এবং কাজ থমকে আছে । এই প্রকল্পের আওতায় ২৩টি খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপন এবং ৬৯টি পাম্প হাউস নির্মাণের কথা রয়েছে ।

এই তথ্যাদি থেকে বোঝা যায় যে, চট্টগ্রাম জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পগুলো একদিকে যেমন বিপুল অর্থ ব্যয় এবং দীর্ঘসূত্রিতার শিকার, অন্যদিকে তাদের আংশিক বাস্তবায়নই (যেমন সিডিএ প্রকল্পের ৮০% অগ্রগতি) দৃশ্যমান সুফল এনেছে। এটি একটি দ্বৈত চিত্র তুলে ধরে: প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ এবং সমন্বয়হীনতা প্রবল , যার ফলে ব্যয় বাড়ছে এবং সময়সীমা অতিক্রম করছে । কিন্তু একই সাথে, যেটুকু কাজ সম্পন্ন হয়েছে, তাতেই নগরবাসী স্বস্তি পাচ্ছে । এর গভীরতর তাৎপর্য হলো, যদি এই প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে ও সমন্বিতভাবে সম্পন্ন হতো, তাহলে জলাবদ্ধতার সমস্যা হয়তো আরও অনেক আগেই এবং আরও কার্যকরভাবে সমাধান করা যেত। বর্তমানের আংশিক সাফল্য ভবিষ্যতের জন্য একটি সতর্কবার্তা যে, সমন্বয়হীনতা ও দীর্ঘসূত্রিতা অব্যাহত থাকলে এই সাফল্য ধরে রাখা কঠিন হবে এবং বিপুল বিনিয়োগের পূর্ণাঙ্গ সুফল অধরাই থেকে যাবে। মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া প্রকল্পগুলোর (যেমন সিটি কর্পোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্প) ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, যা একটি বড় ঝুঁকি।

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে বিপুল বিনিয়োগ এবং চলমান প্রকল্প সত্ত্বেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা সুদূরপ্রসারী সমাধানের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা ও সমন্বয়হীনতা। চারটি প্রকল্পের কাজ ৫ থেকে ১১ বছর ধরে চলছে। দুটি প্রকল্পের মেয়াদ গত বছরের জুনে (২০২৪) শেষ হলেও কাজ চলমান । প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকায় তিনটি সংস্থা (চউক, চসিক, পাউবো) কাজ করলেও তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা প্রকট । সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী সিডিএ’র ‘দূরদর্শিতার অভাব’ এবং খালমুখে বাঁধ অপসারণ না করার জন্য দায়ী করেছেন। অন্যদিকে, সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাস ড্রেন ও খাল পরিষ্কারের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের উপর চাপিয়েছেন । ড্রেনেজ ব্যবস্থার দায়িত্ব একক সংস্থাকে না দেওয়ায় সমস্যা বাড়ছে । স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত মনিটরিং কমিটি মাসিক সভা ও প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও প্রায় এক বছর ধরে কোনো সমন্বয় সভা হয়নি, যা সমন্বয়হীনতার ফাঁদকে আরও প্রকট করে ।

এই পরিস্থিতি স্পষ্টতই “সমন্বয়হীনতার ফাঁদ” নির্দেশ করে। যখন একাধিক সংস্থা একই সমস্যার সমাধানে কাজ করে, কিন্তু তাদের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়, সুস্পষ্ট দায়িত্ব বন্টন এবং নিয়মিত তদারকি না থাকে, তখন বিনিয়োগের কার্যকারিতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। সিটি মেয়র ও সিডিএ চেয়ারম্যানের মধ্যে ‘দোষারোপের খেলা’ এবং মনিটরিং কমিটির অকার্যকারিতা এই সমন্বয়হীনতার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। এর ফলে, একটি সংস্থার কাজ অন্যটির কাজের পথে বাধা সৃষ্টি করে বা একে অপরের পরিপূরক হতে পারে না, যার চূড়ান্ত ফল হলো জনগণের দুর্ভোগের দীর্ঘস্থায়ীত্ব এবং প্রকল্পের ব্যয় ও সময়সীমা বৃদ্ধি। এই সমন্বয়হীনতা কেবল প্রকল্প ব্যবস্থাপনার সমস্যা নয়, এটি সামগ্রিক নগর শাসনব্যবস্থার একটি মৌলিক দুর্বলতা। এটি প্রমাণ করে যে, কেবল অর্থ বরাদ্দ এবং প্রকল্প অনুমোদনই যথেষ্ট নয়; কার্যকর বাস্তবায়ন, আন্তঃসংস্থা সহযোগিতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না গেলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই ‘ফাঁদ’ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যা একটি ‘প্রতীকী সমস্যা’ হিসেবেই থেকে যাবে, যা অন্যান্য শহরের জন্যও একটি নেতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াবে।

এছাড়াও, ভূমি অধিগ্রহণ ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ জটিলতা একটি বড় বাধা। খাল ও খালের পাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আইনি জটিলতা এবং ভূমি অধিগ্রহণে সমস্যা রয়েছে । চসিকের প্রকল্পের জন্য ২.৫ একর ভূমি অধিগ্রহণে প্রশাসনিক অনুমোদনের জটিলতা রয়েছে । বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতার অভাবও একটি মৌলিক সমস্যা। খাল ও নালা পরিষ্কার করার পরও জনসচেতনতার অভাবে আবার বর্জ্যে ভরে যাচ্ছে । সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন নাগরিকদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির উপর জোর দিয়েছেন । পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করা এবং পাহাড় কাটা রোধে সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন । অর্থায়ন ও তহবিল ছাড়ের সমস্যাও প্রকল্পগুলোকে ধীরগতি করছে। প্রকল্পগুলোতে প্রয়োজনীয় তহবিল বরাদ্দ হচ্ছে না, নির্মাণ ও ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ৬২২ কোটি টাকার চাহিদা পূরণ হচ্ছে না । কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের প্রধান বাধা প্রয়োজনীয় তহবিল ছাড় না হওয়া । পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ অসম্পূর্ণ এবং ৩২০ কোটি টাকার তহবিল সংকট রয়েছে । প্রায় ১৪ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা খরচ হলেও নগরবাসী সুফল পায়নি । পাহাড় কাটা ও বন উজাড়ের কারণে খাল ও নালা ভরাট হচ্ছে । এটি পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভূতত্ত্ববিষয়ক প্রভাবের একটি অংশ । ১৯৯৫ সালের ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানে ‘রিটেনশন পন্ড’ রাখার পরামর্শ উপেক্ষা করা হয়েছে ।

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যার একটি টেকসই সমাধানের জন্য একটি “সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি” অপরিহার্য। এটি কেবল প্রকৌশলগত সমাধান নয়, বরং একটি সামাজিক-পরিবেশগত-প্রশাসনিক সমাধান, যেখানে প্রতিটি অংশ একে অপরের সাথে সংযুক্ত।

ড্রেনেজ ব্যবস্থার পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব একটি একক সংস্থাকে দিতে হবে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এই কাজের জন্য উপযুক্ত সংস্থা হতে পারে, কারণ তারা আগে থেকেই এই কাজ করে আসছে এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হওয়ায় তাদের দায়বদ্ধতা বেশি । চসিকের জনবল, সরঞ্জাম ও আর্থিক সক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি করতে হবে ।

আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। নালা-খালে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে জনসচেতনতা ও সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে । চসিকের বর্জ্য অপসারণ সক্ষমতা দ্বিগুণ করতে হবে । পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ এবং কাঁচের জগ ব্যবহারের মতো সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে ।

জলাধার ও নালা-খাল দখল ও ভরাট বন্ধ করতে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে । অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আইনি জটিলতা দ্রুত সমাধান করতে হবে ।   চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে অভ্যন্তরীণ ও বাইরের বিশেষজ্ঞ ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ড্রেনেজ সেল গঠন করতে হবে। এই সেলের কাজ হবে ড্রেনেজ ব্যবস্থা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করে ত্রুটি চিহ্নিত করা এবং সমাধানের পরামর্শ দেওয়া । ওয়ার্ডভিত্তিক প্রতিটি নালা-খালের পরিস্থিতির লগবুক সংরক্ষণ করা সহায়ক হবে ।

বন্দরের রুটিন ড্রেজিং বর্তমানে শুধু মূল চ্যানেল ও জেটি এলাকায় সীমাবদ্ধ। এই ড্রেজিং এলাকা কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত এবং খালগুলোর মুখ পর্যন্ত সম্প্রসারণ করতে হবে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে একটি সমঝোতা করতে পারে ।

জলাবদ্ধতা একটি বহুমাত্রিক সমস্যা, যা কেবল সিটি কর্পোরেশনের একক প্রচেষ্টায় সমাধান সম্ভব নয়; সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ এবং নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি । বর্জ্য অব্যবস্থাপনা এবং খাল ও জলাভূমি দখলের বিরুদ্ধে একটি স্থায়ী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে । প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস জলাবদ্ধতা নিরসনে স্থানীয় প্রশাসন, নাগরিক সমাজ এবং সকল প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ।

এই সুপারিশগুলো থেকে বোঝা যায় যে, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যার একটি টেকসই সমাধানের জন্য একটি “সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি” অপরিহার্য। এটি কেবল প্রকৌশলগত সমাধান নয়, বরং একটি সামাজিক-পরিবেশগত-প্রশাসনিক সমাধান, যেখানে প্রতিটি অংশ একে অপরের সাথে সংযুক্ত। একক সংস্থার অধীনে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা, আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কঠোর আইন প্রয়োগ, এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ—এগুলো একে অপরের পরিপূরক। উদাহরণস্বরূপ, খাল খনন করলেও যদি বর্জ্য ফেলা বন্ধ না হয়, তবে তা আবার ভরাট হয়ে যাবে। একইভাবে, আইন প্রয়োগ না হলে দখলদারিত্ব বাড়বে। এই সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যৎ নগর পরিকল্পনার জন্য একটি মডেল হতে পারে। এটি কেবল বর্তমান সমস্যা সমাধানের দিকেই মনোনিবেশ করে না, বরং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ (যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব) মোকাবিলায় নগরকে আরও স্থিতিস্থাপক করে তোলার উপরও জোর দেয়। এটি প্রমাণ করে যে, একটি জটিল নগর সমস্যার সমাধান কেবল সরকার বা একটি নির্দিষ্ট সংস্থার দায়িত্ব নয়, বরং এটি সমগ্র সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং একটি দূরদর্শী, বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনার ফল।

এই সুপারিশগুলো থেকে বোঝা যায় যে, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যার একটি টেকসই সমাধানের জন্য একটি “সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি” অপরিহার্য। এটি কেবল প্রকৌশলগত সমাধান নয়, বরং একটি সামাজিক-পরিবেশগত-প্রশাসনিক সমাধান, যেখানে প্রতিটি অংশ একে অপরের সাথে সংযুক্ত। একক সংস্থার অধীনে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা, আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কঠোর আইন প্রয়োগ, এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ—এগুলো একে অপরের পরিপূরক। উদাহরণস্বরূপ, খাল খনন করলেও যদি বর্জ্য ফেলা বন্ধ না হয়, তবে তা আবার ভরাট হয়ে যাবে। একইভাবে, আইন প্রয়োগ না হলে দখলদারিত্ব বাড়বে। এই সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যৎ নগর পরিকল্পনার জন্য একটি মডেল হতে পারে। এটি কেবল বর্তমান সমস্যা সমাধানের দিকেই মনোনিবেশ করে না, বরং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ (যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব) মোকাবিলায় নগরকে আরও স্থিতিস্থাপক করে তোলার উপরও জোর দেয়। এটি প্রমাণ করে যে, একটি জটিল নগর সমস্যার সমাধান কেবল সরকার বা একটি নির্দিষ্ট সংস্থার দায়িত্ব নয়, বরং এটি সমগ্র সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং একটি দূরদর্শী, বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনার ফল।

চট্টগ্রাম নগরী জলাবদ্ধতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, তা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। সাম্প্রতিক ভারী বর্ষণে জলাবদ্ধতা না থাকা প্রমাণ করে যে, মেগা প্রকল্পগুলোর আংশিক বাস্তবায়ন এবং নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ইতিবাচক ফল দিচ্ছে। তবে, এটি একটি প্রাথমিক সাফল্য মাত্র, যা ধরে রাখা এবং আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া জরুরি। জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত প্রকল্পগুলোর দীর্ঘসূত্রিতা, সমন্বয়হীনতা, অর্থায়ন এবং জনসচেতনতার অভাবের মতো চ্যালেঞ্জগুলো এখনও বিদ্যমান। এই সমস্যাগুলো মোকাবিলায় একটি একক, সমন্বিত কর্তৃপক্ষ, আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, খাল ও জলাধার দখলমুক্ত রাখা, এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। চট্টগ্রামকে কেবল বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবেই নয়, বরং একটি জলবদ্ধতামুক্ত, পরিবেশবান্ধব এবং বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি এবং সকল অংশীজনের নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা অপরিহার্য। এই সম্মিলিত প্রচেষ্টাই চট্টগ্রামকে জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে চিরতরে মুক্তি দিতে পারে এবং অন্যান্য শহরের জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।