একসময় বিএনপি সরকারের (২০০১) ২৩ শীর্ষ ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ অপরাধীর তালিকায় থাকা সুব্রত বাইন একাধিক খুন, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে দেশ ছাড়েন। পলাতক অবস্থায় তিনি মোল্লা মাসুদের সঙ্গে বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। কলকাতায় স্থায়ী হলেও নিয়মিতভাবে যশোর ও সীমান্ত এলাকায় ফিরে এসে অপরাধ নেটওয়ার্ক চালাতেন। কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেও, বাংলাদেশেরই এক দুর্ধর্ষ অপরাধী তানভিরুল ইসলাম জয়ের মাধ্যমে, যিনি ভারতের গোয়েন্দা ও সামরিক সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, তিনি ছাড় পেয়ে যান।
দীর্ঘদিন ভারত অবস্থানকালে সুব্রত বাইন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা RAW (Research and Analysis Wing) ও সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ MI-এর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। সূত্র অনুযায়ী, তাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এনএসজি-স্টাইলের কমান্ডো ট্রেনিং দেওয়া হয়। গ্রেনেড ও ভারী অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই সন্ত্রাসীকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ‘অপারেশনাল অ্যাসেট’ হিসেবে বিবেচনা করতো। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে পরিচালিত হয় একাধিক গোপন অপারেশন, যার মধ্যে নাগাল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাবাদীর পরিবার ও পাকিস্তান-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী মুস্তাকিমের হত্যা রয়েছে।
২০০৭ সালে ভারত সরকার বিদেশি পলাতকদের বিরুদ্ধে কঠোর হলে সুব্রত বাইন ‘আলি মোহাম্মদ’ নামে একটি ভারতীয় পাসপোর্টে চীন হয়ে দুবাই পালান। সেখানে RAW-এর নিরাপত্তায় তিনি ডি-কম্পানি নেটওয়ার্কে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেন, যা ব্যর্থ হয়।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির এক গভীর রাতে, কোনো আইনি বন্দি বিনিময় চুক্তি ছাড়াই সুব্রত বাইনের হস্তান্তর ঘটে সিলেটের জয়ন্তাপুর সীমান্ত দিয়ে। কলকাতা প্রেসিডেন্সি জেল থেকে তাকে ‘রিমান্ডে নেওয়ার’ নামে বাংলাদেশে আনা হয়। এ সময় তার আইনজীবী বারবার কোর্টে তার সন্ধান জানতে চাইলে কোনো উত্তর পাননি। পরে জানা যায়, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের প্রত্যক্ষ অনুমোদনে এবং এনটিএমসি-র সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল হাসানের মাধ্যমে এই হস্তান্তর পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশে আসার পর, তাকে র্যাব হেডকোয়ার্টারে রেখে পুনরায় ট্রেনিং দেওয়া হয়—স্নাইপার শ্যুটিং, বাতাসের গতি, আর্দ্রতা ও দূরত্ব বিবেচনায় টার্গেট হিট করার ট্রেনিংসহ। তিন মাস ধরে উত্তরার একটি বাড়িতে তাকে গোপনে রাখা হয়। তার মেয়ে বিতুর সঙ্গে যোগাযোগ করানো হয় যাতে তার পরিচয় ও অবস্থান গোপন থাকে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরের দিকে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং RAW কর্মকর্তারা তার সঙ্গে দেখা করে তাকে ‘টার্গেট’ জানিয়ে দেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, লন্ডনে জুমার নামাজের সময় একটি মসজিদে তার যাওয়া-আসার পথে তাকে গুলি করে হত্যার পরিকল্পনা ছিল। এর জন্য তাকে পাকিস্তানি পাসপোর্ট দেওয়া হতো, যাতে সন্দেহ ঘুরে যায়। পুরো অপারেশন শেষ হলে তাকে কানাডায় পাঠিয়ে দেওয়া হতো। পরিকল্পনায় ব্রিটিশ হাইকমিশনে তৎকালীন বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিমকেও সম্পৃক্ত করা হয়।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গোটা অপারেশন ভেস্তে যায়। জিয়াউল হাসানের নির্দেশে তাকে তার মেয়ে বিতুর কাছে ফেরত পাঠানো হয়। এই সময় আন্ডারওয়ার্ল্ড এমনকি তার নিজের পরিবারও ধরে নেয় যে, তাকে হত্যা করা হয়েছে। ফলে ২০২২ সালের মার্চে তার ‘মৃত্যুর খবর’ শুনে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান তার মা, কমলিনী বাইন।
২০২৫ সালের মে মাসে যৌথ বাহিনী কুষ্টিয়া শহরের একটি বাসা থেকে সুব্রত বাইন ও তার এক সহযোগীকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে তিনি আট দিনের রিমান্ডে রয়েছেন এবং প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বিস্ফোরক তথ্য দিয়েছেন।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পরও তাকে দিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্য সাধনে একাধিক অপারেশন পরিচালনার চেষ্টা হয়। তার হাতে ছিল এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ও সার্জিস আলমসহ বিএনপি-জামায়াত ও এনসিপির একাধিক নেতার ‘টার্গেট কিলিং’-এর তালিকা। এই অপারেশন পরিচালনার পেছনে ছিল আওয়ামী লীগের ভেতরের নিষিদ্ধঘোষিত প্রভাবশালী একটি অংশ, সহযোগিতায় ছিল মোল্লা মাসুদ। নেপালের মাধ্যমে অর্থ পাঠানো হয়, যার মাধ্যমে অস্ত্র সংগ্রহ ও শুটার নিয়োগ করা হয়। পরিকল্পনা ছিল ঢাকার মগবাজার, শাহবাগ, গুলশান ও বাড্ডায় অস্ত্র সরবরাহের।
তার বক্তব্য অনুযায়ী, এই সমস্ত ‘টার্গেট কিলিং’ দিয়ে দেশে রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি করে আওয়ামী লীগের একটি চিহ্নিত গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় রাখার পরিকল্পনা ছিল।