ঢাকাসোমবার, ১৭ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

ভোট চোর মেয়র রেজাউলের তিন বছরে হাজার কোটি টাকার সাম্রাজ্য!

নিউজ ডেস্ক | সিটিজি পোস্ট
মার্চ ১৬, ২০২৫ ৫:২৩ অপরাহ্ণ
Link Copied!

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অপসারিত মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর আমলে নিয়ম-নীতির চিহ্ন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। ক্ষমতার দাপটে তিনি শূন্য থেকে মাত্র তিন বছরে হাজার কোটি টাকার মালিকে পরিণত হয়েছেন। তার সময়ে সিটি কর্পোরেশন হয়ে উঠেছিল অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়া। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই একের পর এক নিয়োগ, উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি পছন্দের ব্যক্তিদের মধ্যে ভাগাভাগি, বর্জ্য সংগ্রহের কাজ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই পছন্দের ঠিকাদারদের হাতে তুলে দেওয়া—এসবই ছিল তার আমলের নিত্যদিনের চিত্র।

সিটি করপোরেশনের নথিপত্র ও বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বিদ্যমান জনবল কাঠামো অনুযায়ী মোট পদ রয়েছে ৪ হাজার ২২৬। তবে এসব পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৮ হাজার ২৪৫ জন। অর্থাৎ বাড়তি লোকবল আছেন ৪ হাজার ১৯ জন। করপোরেশনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ব্যয়ের প্রকল্পের কাজ চলমান ছিল। বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়নে আড়াই হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে এ প্রকল্পের প্রায় শতকোটি টাকার ২৫টি কাজ অনুমোদন পায়।

গণখাতে ক্রয়বিধি (পিপিআর) না মেনে ঠিকাদারদের ভাগাভাগি করে দেয় সিটি করপোরেশন। এতে সহযোগিতা করেন প্রকৌশলী জসিম। তিনি নিজে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এবং মেয়র রেজাউলকে বানিয়েছেন শত শত কোটি টাকার মালিক। বিদায়ী মেয়রের আমলে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন পায়।

এই প্রকল্পের আওতায় সবচেয়ে বেশি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় ৬ নম্বর পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডে। ২০টি লটের বিপরীতে ১২২ কোটি ১৯ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই টাকায় ৪৭টি সড়ক ও উপসড়ক সংস্কার ও উন্নয়ন করা হবে। এক সময় কাজ ভাগাভাগির অভিযোগ ওঠায় প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। কাজ ভাগাভাগি বন্ধে, গুণগতমান বজায় রাখা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশলীর পরিবর্তে নতুন প্রকল্প পরিচালক হিসেবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. গোলাম ইয়াজদানীকে দায়িত্ব দেয় মন্ত্রণালয়। তবে কাজ ভাগাভাগির আবদার না শোনায় তার ওপর হামলা করেন আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ঠিকাদাররা। এ ঘটনায় সিটি কর্পোরেশনের কর্মীদের ইন্ধন ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০২৪-এর ২৯ জানুয়ারি টাইগারপাসে সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী প্রধান কার্যালয়ের কক্ষে ঢুকে প্রকল্প পরিচালককে মারধর করেন ঠিকাদাররা। এরপর গত বছরের মে মাসে গোলাম ইয়াজদানীর পরিবর্তে আরেকজন প্রকৌশলীকে নতুন প্রকল্প পরিচালক করা হয়।

সাবেক মেয়রের আমলে নগরের বর্জ্য সংগ্রহের কাজ বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়। আর এ কাজ পেয়েছেন তার ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের পছন্দের লোক। বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই এখন পর্যন্ত চারটি ওয়ার্ডের কাজ দেয়া হয় পছন্দের অনভিজ্ঞ ঠিকাদারদের। নগরীর ২৪ নম্বর উত্তর আগ্রাবাদের কাজ পায় সাবেক কাউন্সিলর ও বিদায়ী মেয়রের ঘনিষ্ঠ জাবেদ নজরুল ইসলামের মেসার্স পাওয়ার সোর্স। ২০২২ সালের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয় সিটি করপোরেশনের। আর সেপ্টেম্বরেই কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কাজ পাওয়ার পর জাবেদ নজরুল ইসলাম সাবেক মেয়রের সঙ্গে ভারতে যান। তারা সেখানে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। এরপর আরও পাঁচটি ওয়ার্ডে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ দেয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছিল। কিন্তু সরকার পতনের পর নথিপত্র চাপা পড়ে আছে।

পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পায় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবারক আলীর বন্ধু মোহাম্মদ জাহেদ হোসেন চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রাইভেট সার্ভিস। মোবারক আলী বর্জ্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি। শুলকবহর ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছে ক্লিন-গ্রিন ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস এবং চান্দগাঁও ওয়ার্ডের কাজ পায় চান্দগাঁও ক্লিনার্স সার্ভিস। রেজাউল করিমের বাড়ি এই ওয়ার্ডে। অথচ আয়তন ও জনসংখ্যায় এই ওয়ার্ড অনেক পিছিয়ে। এই ওয়ার্ডের চেয়ে অন্য ২০টি ওয়ার্ডে বেশি জনসংখ্যা রয়েছে।

৫ আগস্ট সরকার পতনের পর রেজাউল করিম চৌধুরী আত্মগোপনে চলে যান। তার বাড়ি থেকে কয়েক বস্তা ক্যাশ টাকা উদ্ধার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত হওয়া উচিত এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় মেয়রদের একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়ায় তারা প্রায়ই জবাবদিহির বাইরে থেকে যান। এ কারণে সেবার চেয়ে বড় প্রকল্প ও লোক নিয়োগে বেশি মনোযোগ দেন তারা। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অপসারিত মেয়রের আমলে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার দুর্বলতাই তুলে ধরে।

এখন প্রশ্ন হলো, কবে এই অনিয়ম ও দুর্নীতির কালো অধ্যায়ের তদন্ত হবে? কবে সাধারণ মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবে? চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এই দুর্নীতির জাল থেকে মুক্তি পেতে হলে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি

সূত্র : দৈনিক দিনকাল