ঢাকাশনিবার, ১৫ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

RAW-এর বাংলাদেশে মোবাইল নেটওয়ার্ক লিংক প্রস্তাব : ডিজিএফআই-এর প্রত্যাখ্যান

নিউজ ডেস্ক | সিটিজি পোস্ট
মার্চ ১৫, ২০২৫ ৩:৩৯ অপরাহ্ণ
Link Copied!

শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) বলপূর্বক গুম ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার জন্য ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। গোপন কারাগার (আয়নাঘর নামে পরিচিত) পরিচালনায় তাদের ভূমিকা ডিজিএফআই-এর ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিশেষ করে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে হাসিনার শাসনের পতনের পর জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

জনসমর্থন ছাড়াই হাসিনা তার শাসন টিকিয়ে রাখতে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক আহমেদ সিদ্দিকীর মাধ্যমে ডিজিএফআইকে দমন-পীড়নের হাতিয়ারে পরিণত করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে এমন কিছু উদাহরণও রয়েছে, যেখানে ডিজিএফআই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চাপের কাছে নতি স্বীকার করেনি। এর মধ্যে ২০১৮ সালের সমালোচিত মধ্যরাতের নির্বাচনের আগে ও পরের ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইন্ডিয়ান এক্সটার্নাল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস (RAW) বাংলাদেশের SS7 মোবাইল নেটওয়ার্কের সঙ্গে লিংক করার জন্য একটি প্রস্তাব পেশ করে। এই প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের ভয়েস কল ডেটা, প্রেরক ও প্রাপকের ফোন নম্বর, সময়, অবস্থান এবং কলের সময়কালসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে পারত। বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে রোমিং চুক্তি না থাকায় ভারত বাংলাদেশের SS7 নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে পাকিস্তান-সম্পর্কিত ভয়েস কল ডেটা সংগ্রহ করতে চেয়েছিল।

সিগন্যালিং সিস্টেম নং ৭ (SS7) হলো ১৯৭০-এর দশকে তৈরি করা টেলিফোনি সিগন্যালিং প্রোটোকলের একটি সেট, যা বিশ্বের বেশিরভাগ পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক (PSTN) মারফত টেলিফোন কল সেটআপ এবং বন্ধ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এই সিস্টেমের মাধ্যমে সংখ্যা অনুবাদ, স্থানীয় নম্বরের অ্যাক্সেস, প্রিপেইড বিলিং, শর্ট মেসেজ সার্ভিস (এসএমএস) এবং অন্যান্য পরিষেবাগুলো পরিচালনা করা হয়। সহজ কথায়, SS7 লিংকের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে করা যে কোনো ভয়েস কলের ডেটা অ্যাক্সেস করতে পারত। একবার লিংকটি পেয়ে গেলে ভারতের গোয়েন্দারা বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের রোমিং চুক্তি অনুযায়ী ইনকামিং এবং আউটগোয়িং উভয় ভয়েস কলের তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হত।

ডিজিএফআই-এর উচ্চপদস্থ সূত্রগুলো জানায়, ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার স্টেশন প্রধান প্রথমে এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তবে ডিজিএফআই-এর তৎকালীন প্রধান পরপর দুবার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এছাড়াও, ভারত বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্যাবল রুটে একটি ইন্টারসেপশন সিস্টেম স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছিল, যা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।

একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, পাকিস্তানের সঙ্গে রোমিং চুক্তি না থাকার কারণে ভারত এই লিংকটি চেয়েছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কিত ভয়েস কল ডেটা সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশের SS7 নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন ভারতের গোয়েন্দারা। উচ্চ পর্যায়ের সূত্র মারফত জানা গেছে, SS7 লিংকের মাধ্যমে ভারত প্রেরক ও প্রাপকের ফোন নম্বর, সময়, তাদের অবস্থান, কলের সময়কাল এবং অন্যান্য মেটাডেটার মতো বিবরণ সংগ্রহ করতে পারত। ইন্ডিয়ান এক্সটার্নাল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস বাংলাদেশে একটি সাবমেরিন ক্যাবল ইন্টারসেপশন সিস্টেম স্থাপনের প্রস্তাব করেছিল।

একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল রুট SMW-4 এবং SMW-5-এর অংশ, যেখানে এই ধরনের একটি ইন্টারসেপশন সিস্টেম স্থাপন করা যেতে পারে। প্রাপ্ত নথিগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, ভারত ইনস্টলেশনের জন্য দুটি বিকল্প উপস্থাপন করেছিল; হয় তারা সরাসরি প্রদর্শনের জন্য বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশনে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে আসবে অথবা বাংলাদেশের একটি দল বিষয়টি প্রদর্শনের জন্য ভারতে যেতে পারে। যদি এই সিস্টেমটি ইনস্টল করা হত, তাহলে ভারত বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশের মধ্যে যে কোনো ইনকামিং বা আউটগোয়িং ভয়েস কলের পাশাপাশি বাংলাদেশের মধ্যে যে কোনো ভয়েস কলের ডেটা সংগ্রহ করতে সক্ষম হত।

সূত্র মারফত জানা গেছে যে, মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকী জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই)-এর তৎকালীন প্রধান মেজর জেনারেল টিএম জোবায়েরের সঙ্গে ডিজিএফআইকে চাপ দিয়েছিলেন ভারতীয় গোয়েন্দাদের দ্বারা প্রস্তাবিত সিস্টেমটি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করার জন্য। এটি লক্ষণীয় যে, এনএসআই প্রধান জোবায়ের তৎকালীন RAW প্রধান সামন্ত কুমার গোয়েলের সঙ্গে একই সময়ে লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। সূত্রগুলো থেকে জানা যায় যে, মেজর জেনারেল জোবায়ের গোয়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যিনি পরবর্তীতে তার নিজের সুবিধার্থে এই সম্পর্কটি কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। ডিজিএফআই-তে কর্মরত একজন কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘SS7 নেটওয়ার্কে প্রবেশ করা ঝুঁকিপূর্ণ, যা সরাসরি জাতীয় স্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। তাই আমরা এটি বন্ধ করে দেই।’

ডিজিএফআই-এর এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে সংস্থাটির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গুমের অভিযোগ এখনও সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।

সূত্র: বাংলা আউটলুক