ঢাকাবৃহস্পতিবার, ১৩ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

শেখ হাসিনার আমলে ধর্ষণের শিকার ৪৩ হাজার নারী-শিশু

নিউজ ডেস্ক | সিটিজি পোস্ট
মার্চ ১৩, ২০২৫ ৪:২৮ অপরাহ্ণ
Link Copied!

শেখ হাসিনার সরকারের আমলে দেশজুড়ে ধর্ষণের মহোৎসব চলছে। গত ছয় বছরে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭ হাজার শিশুসহ প্রায় ৪৩ হাজারের বেশি নারী। এ সময়ে নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১ লাখ ৩৭ হাজার নারী, অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৮ হাজার ৪৮ জন নারী ও শিশু।

ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে ধানের শীষে ভোট দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নারীদের ধর্ষণ করেছেন। তবে নারীবাদী নেত্রী এবং মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন এই ঘৃণ্য ঘটনায় প্রতিবাদ না করে বছরের পর বছর উদ্বেগ ধামাচাপা দিয়েছে। তাদের এমন নীরবতায় হাইকোর্ট ডিভিশন পর্যন্ত প্রশ্ন তুলেছেন।

জুলাই গণবিপ্লবের সময়ে আন্দোলনরত নারী শিক্ষার্থীদের ওপর সংঘটিত নির্যাতন নিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, সরকারি বাহিনী এবং ছাত্রলীগের কর্মীরা নারীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণে বাধা দিতে যৌন নিপীড়ন ও শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছে। কয়েকটি ঘটনায় নারী আন্দোলনকারীদের বেআইনিভাবে আটক করে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে জাতিসংঘ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানায়।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজনৈতিক প্রভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সামাজিক অবক্ষয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা এসব অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ।

ধর্ষণের ভয়াবহ চিত্র: পুলিশের তথ্য

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এ সময় ধর্ষণের ঘটনায় মোট ৩৪ হাজার ৪৭০টি মামলা হয়েছে।

বছরভিত্তিক ধর্ষণের মামলা:

  • ২০১৯ সালে: ৬,১১৪টি
  • ২০২০ সালে: ৭,১৯৪টি
  • ২০২১ সালে: ৬,৯৮৬টি
  • ২০২২ সালে: ৭,০১২টি
  • ২০২৩ সালে: ৬,২৩২টি
  • ২০২৪ সালের জানুয়ারি-মার্চ: ১,০৩২টি
নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান

গত ছয় বছরে নারী নির্যাতনের ঘটনায় দেশে ১৭,৫৭১টি মামলা হয়েছে। এছাড়া যৌতুক না পেয়ে বা ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৫৯ জন নারী।

নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার পরিসংখ্যান:

  • ২০১৯ সালে: ২১,৭৬৪টি
  • ২০২০ সালে: ২২,৫১৭টি
  • ২০২১ সালে: ২২,১৩৬টি
  • ২০২২ সালে: ২১,৭৬৬টি
  • ২০২৩ সালে: ১৮,৯৪১টি

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ২,৯৩৭টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬৩৯ জন। ২০২২ সালে ধর্ষণের শিকার ৯৮৭ নারীর মধ্যে ৩৮ জনকে হত্যার শিকার হতে হয়েছে।

রাজনৈতিক সহিংসতা ও নারীদের ওপর নিপীড়ন

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত নারী নির্যাতনের ঘটনাও বাড়ছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাই গণবিপ্লবের সময়ে আন্দোলনরত নারী শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নিপীড়ন ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। জাতিসংঘের ১৩ ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি বাহিনী এবং ছাত্রলীগের কর্মীরা নারীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণে বাধা দিতে যৌন হয়রানি ও শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছে।

ছাত্রলীগের হাতে ধর্ষণ: জাবি ও এমসি কলেজের নৃশংস ঘটনা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) এবং সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে সংঘটিত ধর্ষণের নৃশংস ঘটনায় দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। গত বছর ২০২৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি জাবিতে এক দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান, যিনি মীর মশাররফ হোসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক।

এছাড়া, ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে তার সামনেই স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ছাত্রলীগের সক্রিয় ছয় কর্মী জড়িত ছিল।

এই ঘটনায় হাইকোর্ট নারী নেত্রীদের নীরব ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

অপরাধীদের বিচার ও আইনের দীর্ঘসূত্রতা

আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, ধর্ষণ মামলার বিচার ৯০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। তিনি বলেন, “মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে তদন্ত শেষ করতে হবে।”

তবে পুলিশের তদন্তে বিলম্ব, সাক্ষী ও প্রমাণ সংগ্রহের জটিলতা এবং বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতির কারণে অনেক মামলাই বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। ফলে অপরাধীরা প্রায়শই পার পেয়ে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও অপরাধ বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, “ধর্ষণের ঘটনা বাড়ার পেছনে বিশেষ উদ্দেশ্য কাজ করছে কি না, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। অস্থিতিশীলতা তৈরিতে এসব ঘটনা ঘটছে। তদন্তে এমন বিষয় পেলে অবশ্যই এর মূলোৎপাটন করব।” তিনি আরও বলেন, “বিগত বছরগুলোতে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছে। যারা গ্রেপ্তার হয়নি, তাদেরও শিগগিরই গ্রেপ্তার করা হবে।”

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পুলিশের উদ্যোগ

নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতা প্রতিরোধে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স হটলাইন সেবা চালু করেছে। যেকোনো অভিযোগ জানাতে ২৪ ঘণ্টা এই হটলাইনে যোগাযোগ করা যাবে।

হটলাইন নম্বর:
📞 ০১৩২০০০২০০১
📞 ০১৩২০০০২০০২
📞 ০১৩২০০০২২২২

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা কমাতে শুধু আইন প্রণয়ন যথেষ্ট নয়, বরং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করাই একমাত্র কার্যকর উপায়। অপরাধীদের কঠোর শাস্তি এবং সমাজের নৈতিক মূল্যবোধ উন্নত না হলে এই সহিংসতা বন্ধ করা কঠিন হয়ে পড়বে।