তালহা মাহমুদ চৌধুরী একজন তরুণ সাহিত্যিক। তার উপন্যাস “জিস্ত এ দাগ” অমর একুশে বইমেলা ২০২৫ এ এসেছে, সমাজের অদেখা দাগগুলো তুলে ধরে। তালহা মাহমুদ চৌধুরী শুধু সাহিত্যিক নন, তিনি ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের এক সাহসী অংশগ্রহণকারী। ২১ দিন কারাভোগের পর তার কলমে কী দাগ পড়েছে? “জিস্ত এ দাগ” বইটি কি শুধু সাহিত্য, নাকি এক সংগ্রামী জীবনের দলিল?
সিটিজি পোস্টের আজকের সাক্ষাৎকারে জানতে পারবেন তালহা মাহমুদ চৌধুরীর উপন্যাস “জিস্ত এ দাগ”-এর পেছনের গল্প, তার রাজনৈতিক সংগ্রাম ও লেখালেখির পথে অভিজ্ঞতার প্রভাব। এছাড়া, তিনি কীভাবে সাহিত্যকে সমাজ ও বাস্তবতার প্রতিফলন হিসেবে দেখেন, সেটিও স্পষ্ট হবে।
প্রশ্ন ১. আপনার উপন্যাসের শিরোনাম “জিস্ত এ দাগ”– এখানে ‘জিস্ত’ (জীবন) ও ‘দাগ’ (ক্ষত) শব্দ দুটি একসঙ্গে এসেছে। জীবন ও ক্ষতের এই যোগসূত্রটি কীভাবে তৈরি হলো? আপনি কি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক বাস্তবতা নাকি সামগ্রিক সমাজজীবনের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন এতে?
তালহা: মজা ব্যাপার হলো, বই লেখার আগেই বইয়ের নাম ধার্য করেছিলাম। এর কারণ মূলত, আমার ভাষার চেয়েও ভাষার ফোনেটিক্সের উপর ইন্টারেস্ট বেশি বলে। জিস্ত শব্দটি ফারসি, তবে এই শব্দ আমার প্রথম শোনা হয়, একটি উর্দু গজল থেকে। অনেকে গজল বলতে হয়তো ইসলামিক গান হিসেবে চেনে তবে গজল বলে রাখা ভালো একটি কবিতা লেখার ধরণ। দাগ দেহলভী নামক উনিশ শতাব্দীর দিল্লির এক কবি তার ‘উজরে আনে ম্যা ভি হ্যায়’ নামক একটি গজলে ‘জিস্ত’ শব্দটি ব্যবহার করে। পরে বিখ্যাত গজল গায়িকা ‘বেগম আখতার’-এর এই গজলকে সুর দিয়ে গাওয়া গান শোনার সময় এই শব্দটি আমার কানে লাগে। আর সেই কানে লাগার পরপরই এর অর্থের খোঁজ করি। দেখলাম, এর মানে জীবন। জিস্ত অর্থ জীবন। দাগ দেহলভী সেই কবির ছদ্ম নাম। আসল নাম, নবাব মির্জা খান। এই দুটি শব্দটি যোগসূত্র সেখান থেকে। বই লেখার আগে থেকেই, দাগের জীবন বা জীবনের দাগ -এর ফারসি অর্থ ‘জিস্ত-এ-দাগ’ এই কথাটি অটোমেটিক মাথায় গেঁথে যায়, যে ভেবে বসেছিলাম একদিন যদি বই হিসেবে কিছু দাঁড় করাতে পারি, তার নাম হবে এই। প্রথমবার কেউ যদি কিছু লিখতে বসে, যেমন ধরা যাক একটি উপন্যাস, অবশ্যই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অনেকটুকু তাতে প্রতিফলিত হয়। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। আর রাজনৈতিক বাস্তবতার রেশ তো উঠতে বসতেই আমার ধারঘেঁষা। আগে হোক পরে হোক, আমার লেখনিতে তার ছোঁয়া থাকবেই। এই উপন্যাস দিয়ে না হয় প্রথম দানেই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজের সব স্তরের লোকদের বাস্তবিক পর্যালোচনা করলাম।
প্রশ্ন ২. আপনার লেখালেখির শুরুর দিকটা কেমন ছিল? আন্দোলনের আগে থেকেই কি আপনি লিখতেন, নাকি লেখালেখি ছিল আন্দোলনেরই একধরনের সম্প্রসারণ? কারাবাসের অভিজ্ঞতা কি আপনার সাহিত্যদৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে?
তালহা: লেখালেখির শুরুটা ক্লাস ফোর থেকে, তখন কিছু লেখা হলে যাকে কবিতা ভাবতাম, এ বয়সে এসে মনে হয় তা ছিল আদতে ছড়া। পরে ছন্দ মিলিয়ে কিছু লিখবার চেষ্টা, তারপর কবিতা, গল্প, বিদেশি পত্র-পত্রিকায় আর্টিকেল লেখা, কিছু রাজনৈতিক প্রতিবেদন, ফ্রিল্যান্সার হিসেবে বিভিন্ন টপিকের উপর এসইও আর্টিকেল লেখা, বিদেশি কবিতার অনুবাদ, এভাবেই শুরু। আন্দোলনের প্রায় ২ বছর আগ থেকে আমার এই উপন্যাস লেখা শুরু। তবে হ্যাঁ, আন্দোলন বা আমার কারাবাস অবশ্যই আমার লেখার মধ্যে অনেক নতুনত্ব এনেছে, যা লেখার বেলায় আরো মসৃণ করতে আমি অনুসন্ধানরত। ফাঁকফোকর পেলেই সামনে নতুন কিছু আনার ইচ্ছা আছে।
প্রশ্ন ৩. বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাহিত্যের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখেন? আপনি কি মনে করেন, একজন লেখক শুধুমাত্র শিল্পসৃষ্টি করতেই দায়বদ্ধ, নাকি তার সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ?
তালহা: প্রথমত সাহিত্যের ভেতরেই স্থান পায় কোন পক্ষপাতিত্ব ছাড়া একেবারে উঁচু থেকে নিচু স্তরের ইতিহাস, যদি তা সততার সাথে চর্চা করা কারোপক্ষে সম্ভব হয়। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেভাবে দিকবেদিক হয়ে পড়ে, তাতে কারো সাহিত্য-শক্তি দিয়ে সে চাইলেই তার কিছুটা হাল ধরে সঠিক দিকে আনতে পারে। যেমন নজরুল তার লেখা দিয়ে চেয়েছিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শামিল হতে। তবে একজন লেখকের দায়িত্ব শুধুমাত্র তার সাহিত্যাঙ্গনে সীমাবদ্ধ থাকাটা আমার চোখে অনেকটুকু তার গাম্ভীর্য কমিয়ে আনে, কারণ সাহিত্য চর্চা যেখানে দৃষ্টিকোণে ভিন্নতা রেখে সমাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করাকেই বোঝায় সেখানে তার রাজনৈতিক অবস্থানকে গোপন রাখা বেমানান বরং বলা ভালো সামাজিক অবস্থান পিছিয়ে রেখে শুধু শিল্পসৃষ্টি করার ঝোঁক তার সৃষ্টিশীলতাকেই ভোঁতা করে দেয়ার সক্ষমতা রাখে। আমি বিশ্বাস করি কোন লেখকের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ তার সাহিত্যে প্রয়োগ করবার ফল স্বরূপ এক পর্যায় গিয়ে তার সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটায়।
প্রশ্ন ৪. আপনার উপন্যাসের চরিত্র ও কাহিনির পটভূমি কীভাবে গড়ে উঠেছে? আপনি কি বাস্তব চরিত্র ও ঘটনা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন, নাকি এটি পুরোপুরি কল্পনার ফসল? এই উপন্যাসের ঘটনাগুলো পাঠকদের জন্য কতটা চেনা বা অচেনা মনে হবে বলে আপনি মনে করেন?
তালহা: পুরোপুরি কাল্পনিক নয় আবার পুরোপুরি বাস্তবিকও নয়। উপন্যাস গড়ার উপায় আমার কাছে, মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মতো। চারপাশ থেকে কিছু ‘মতাদর্শগত পার্থক্য’ একটা দিক বরাবর ছুড়ে মারলে দেখা যাবে অটোমেটিক তা থেকে কিছু চরিত্র ইমার্জ করছে। সেই চরিত্রদের নিয়েই তারপর যাত্রা। পরবর্তীতে যে সকল ঘটনাবলী উপন্যাসে উঠে আসবে তা অবশ্যই পাঠকদের চেনা তবে কিভাবে এই ঘটনাসমূহ চরিত্রদের মনস্তাত্ত্বিক দিকে থেকে প্রতিফলন ঘটায় তা পাঠকদের অচেনা ঠেকতে পারে। অর্থাৎ কিছু নতুনভাবে পরিবেশন করা হয়েছে বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের জন্য।
প্রশ্ন ৫. রক্তক্ষয়ী ২০২৪ সালের আন্দোলন ও কারাবাস আপনার জীবন ও চিন্তাধারায় কী পরিবর্তন এনেছে? আপনি কি মনে করেন, একজন লেখকের জন্য বাস্তব সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি?
তালহা: চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনেনি কোন তবে যাই আমার নিজস্ব মতাদর্শ ছিল তাতে আরো শান দিতে পারার ইচ্ছাশক্তি বাড়িয়েছে। আরো বেশি পড়াশোনা আর বোঝার শক্তি বাড়ানোর ইচ্ছা। তা হ্যাঁ বলা যায়, বাস্তব সংগ্রামে শরীক থাকাটা লেখক জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে মনে করি।
প্রশ্ন ৬. উপন্যাসটিকে যদি রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে দেখা হয়, তাহলে এটি কি শুধুই একটি সাহিত্যকর্ম, নাকি আন্দোলনের একধরনের রূপান্তরিত ভাষা? আপনি কি মনে করেন, এই বইটি ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য কোনো অনুপ্রেরণা হতে পারে?
তালহা: আমার উপন্যাসের এক পর্যায়ে দেখা যায় একটা শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়, যার শুরু ‘দেশ গার্মেন্টস’ নামক জায়গা থেকে। তারপর একে একে ছাত্ররাও পরে যোগ দেয়। ২৪ এর ছাত্র জনতার গণ অভ্যুত্থানে আমরা দেখছি, প্রথমে ছাত্ররা পরে একে একে খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালা ওর শ্রমিকরাও এতে যোগ দেয়। এক দিক দিয়ে বলা যায়, কিছুটা মিল আছে। তবে রূপান্তরিত ভাষা বলার পক্ষে আমি না। তবে ভবিষ্যতে কি হবে তা আগ থেকে বলতে পারছি না, কিন্তু অনুপ্রেরণা অবশ্যই নেওয়া সম্ভব।
প্রশ্ন ৭. বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে প্রতিবাদী বা রাজনৈতিক সাহিত্য কতটা গ্রহণযোগ্য? “জিস্ত এ দাগ” প্রকাশের সময় কি কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন? বাংলাদেশে একজন লেখকের সত্য বলার জায়গাটা ঠিক কতটা নিরাপদ?
তালহা: লেখা জুতসই আর ভালো হলে যেকোন বই-ই গ্রহণযোগ্য হয়। তবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশকরা বেশির ভাগ সময় ভালো বই থেকে বেশি চায় ভালো ব্যবসা। যেই বই দিয়ে ভালো টাকা আয় করা সম্ভব বেশিরভাগ সময়ই সে বই তারা প্রকাশ করে থাকে। জিস্ত-এ-দাগ এর বেলায়ও কিছুটা প্রবলেমের মুখোমুখি হয়েছি। এই উপন্যাস বের হওয়ার কথা ছিল, ২০২৪ এ। তবে প্রকাশক খুঁজে না পাওয়াতে আর বের করা হয়নি সেবার। এ বছর উপকথা প্রকাশন থেকে বের হলো, আমার প্রকাশক তানভীর ভাইকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাবো আমার মতো নতুন একজন লেখকের উপর আস্থা রাখবার জন্য। নিরাপদ কি নিরাপদ না সেই প্রশ্নের উত্তরে বলবো, কেউ বইমেলার প্রাঙ্গনে কোপ খায়, কেউ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়, কাউকে মেরে ফেলে। তবে এসব যদি কেউ অতীত ভেবে নেয় তাহলে বলতেই হয় দেখা যাক সামনে কি আছে দেখবার।
প্রশ্ন ৮. বাংলাদেশের তরুণ লেখকদের অনেকেই রাজনীতি এড়িয়ে চলতে চান এবং সাহিত্যের ‘নিরপেক্ষতা’ বজায় রাখতে চান। আপনি কি মনে করেন, সাহিত্য আসলেই নিরপেক্ষ হতে পারে, নাকি প্রত্যেকটি লেখা একধরনের রাজনৈতিক অবস্থান বহন করে?
তালহা: যারা এড়িয়ে চলে তাদেরকেও মানুষ এড়িয়েই চলবে, আগে হোক বা পড়ে। ভেতরে যাই থাকে, যেই মতবাদের অনুসারীই হোক না কেন, লেখায় তার ছাপ পড়লে অবশই তার ধার বাড়ে। তরুণ লেখকরা অনেক ক্ষেত্রেই তৈরি করে দেওয়া আগের লাইনেই হাঁটতে পছন্দ করে, হোক তা সাহিত্যের ধরণ, রূপবরণ, রীতি বা রাজনীতি। ব্যতিক্রমী হওয়ার যে জোশ তা পারতপক্ষে কম নতুনদের মধ্যে। তবে আমি নিজেও নতুন হওয়াতে কতটুকু আমার মতাদর্শ আমার উপন্যাসের পাতায় দিতে পেরেছি, তা বিচার করবে আমার পাঠকরা। তবে আমি মনে করি, নিরপেক্ষতা দিয়ে তেমন সাহিত্যের ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব না।
প্রশ্ন ৯. আপনার মতে, বাংলাদেশের পাঠকরা কী ধরনের সাহিত্য বেশি গ্রহণ করেন? “জিস্ত এ দাগ” কি মূলধারার পাঠকদের কাছে পৌঁছাতে পারবে, নাকি এটি এক নির্দিষ্ট পাঠকগোষ্ঠীর জন্য বেশি প্রাসঙ্গিক হবে?
তালহা: বর্তমানে বাংলাদেশের পাঠকরা রোম্যান্টিক নভেলই বেশি পড়তে চায়, বা থ্রিলার ঘরানার কিছু, অথবা সাইফাই। জিস্ত-এ-দাগ মূলধারার পাঠকদের অবশই ভালো লাগবে যদি তা তাদের অব্দি পৌঁছাতে পারে। এই উপন্যাসে, প্রেম, রাজনীতি, থ্রিলার, ভাষাগত দিক দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট, আখ্যানগত দিক দিয়ে 2nd Person Perspective এক্সপ্লোর, মনস্তাত্ত্বিকতা, বাস্তবিকতা সব কিছুই শামিল আছে। এখন পড়ে দেখবার পালা।
প্রশ্ন ১০. এই উপন্যাসের পর আপনার লেখালেখির পরিকল্পনা কী? আপনি কি ভবিষ্যতেও বাস্তবতা ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সাহিত্য লিখতে চান, নাকি অন্যধরনের সাহিত্যিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যেতে চান?
তালহা: জিস্ত-এ-দাগ এর পর আমার আরেকটি উপন্যাস আসবে সামনের বছর এই আশা রাখি। সেটি হবে, ১৯৭১ সালের প্রেক্ষাপটে তবে জাদুবাস্তবতা ধরণের মধ্য দিয়ে। এর সাথে সাথে উপন্যাসের বাইরে Visual Media তে কাজ করবার আগ্রহ থেকে একটা Screenplay তে কাজ করে যাচ্ছি। দেখা যাক কোন পরিচালকের হাতে তা পৌঁছাতে পারি কিনা। ধন্যবাদ।
তালহা মাহমুদ চৌধুরী জানালেন, তার লেখায় শুধু গল্প নয়, একটা আন্দোলনও লুকিয়ে আছে। তার উপন্যাস শুধুই সাহিত্য না, সমাজের ক্ষতগুলো স্পর্শ করার একটা চেষ্টা। এই দাগগুলো হয়তো অনেকের কাছে পরিচিত হবে, আবার কিছুটা অচেনাও ।