‘ইউরোপের দেশগুলো কল্পনা করেন। সুইডেন ছোট্ট দেশ। তাকে সারাক্ষণ রাশিয়ার ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়। তাহলে তাঁরা আত্মমর্যাদা নিয়ে কীভাবে আছে? ভারত ১৯৭১ এ আমাদের সাহায্য করেছে এই অযুহাতে বাংলাদেশকে তাঁর উপনিবেশ করে রাখতে চাইছে। এটার সহজ বাংলা এটাই। পাকিস্তানিদের উপনিবেশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এতো রক্ত আপনি ঢাললেন ভারতের উপনিবেশ হওয়ার জন্য? ‘
সোমবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আবুল মনসুর আহমেদের রাষ্ট্রচিন্তা: প্রেক্ষাপট গণঅভ্যুত্থান’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন লেখক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রচিন্তা এই সভার আয়োজন করে। বেলা আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত এ সভা চলে। সভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে এক শিক্ষার্থী প্রশ্ন করেন, “কীভাবে ভারতের সাথে জনস্বার্থ ইনসাফের ভিত্তিতে সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে?’ এর জবাবে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান এসব কথা বলেন।
খ্যাতিমান এই লেখক বলেন, ‘শেখ হাসিনার অপরাধের মধ্যে একটা হচ্ছে বাংলাদেশের হৃৎপিণ্ড তিনি ধ্বংস করেছেন। পাওয়ার সেক্টরে লুটপাট, অর্থপাচার, দেশে অনাচার, গুম, খুন, অত্যাচার, এর বাইরেও বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশকে ভারতের দাসে পরিণত করেছিলেন। সেটা থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রথম কাজ আপনারা করেছেন৷ সেটা হচ্ছে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করা। দ্বিতীয় হচ্ছে জণগণের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতার পরিচয় দেওয়া। গণ্ডগোল বাধানোর জন্য যে উস্কানি এখন অন্যরা দিচ্ছে সেগুলো প্রতিহত করতে রাজনৈতিক সততা দরকার, সচেতনতা দরকার ও রাজনৈতিক শক্তি দরকার।’
সভায় এক শিক্ষার্থী ভারত, আমেরিকা ও ইসরায়েলের জাতীয় পতাকার ছবিতে পদচিহ্ন আঁকার বিষয়ে মতামত জানতে চান। এর জবাবে সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত, মাও সেতুং বলেছেন। বিদ্রোহের একটা ফর্ম হচ্ছে প্রতীকি। আমেরিকাতে সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছে পতাকা পুড়িয়ে দেওয়া কোনো অপরাধ নয়। মানুষ বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে পতাকার মধ্যে আগুন দিয়েছে আমেরিকায়। অর্থাৎ মানুষের জন্য পতাকা, পতাকার জন্য মানুষ নয়। ইসরায়েল এবং আমেরিকার যে ভূমিকা ফিলিস্তিনে, সেটার বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত বিক্ষোভ হিসেবে আমরা কি আমেরিকায় গিয়ে বোমা মারতে পারব? তাহলে আমরা কী করব? তুমি যদি না পারো মনে মনে হলেও ঘৃণা করো, এমন মহা মনিষীর উক্তি আছে না আমাদের? আমাদের প্রতিবাদের যতটুকু শক্তি আছে সেটা হচ্ছে পতাকা পর্যন্ত।’
ইসকন প্রশঙ্গে প্রশ্নের জবাবে সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘ইসকনকে ধর্মীয় শান্তিপূর্ণ সংগঠন হিসেবে ইউরোপ আমেরিকা মনে করে। কিন্তু সেই সংগঠন যদি বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র দেশে এসে বিশৃঙ্খল আচরণ করে, তাহলে আমাদের এক সাংবাদিক বন্ধু আশরাফ কায়সার বলেছেন, আমি তো এই হরে কৃষ্ণকে চিনতে পারছি না। বাংলাদেশের হিন্দুরা যদি মনে করেন যে ইসকনই তাঁদের রক্ষাকর্তা হবে তাহলে তাঁরা বড় আকারে একটা ভুল করছেন। কারণ ইসকন ছাড়াও বাংলাদেশে হিন্দুরা ছিলেন।’
আবুল মনসুরের চিন্তা রচনার প্রশংসা করে সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হওয়ার সময় আবুল মনছুর আহমেদ অনেকগুলো আপত্তি করেছিলেন। আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছরের পরবর্তী সংস্করণে তিনি সেটা যোগ করেছেন। সবগুলোই গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে প্রাশঙ্গিক মনে হচ্ছে। শেখ মুজিব আবুল মনসুরকে সংবিধান সংশোধনের জন্য আহ্বান করেছিলেন। আবুল মনসুরও সংশোধনের কথা বলেছিলেন। তবে শেখ মুজিব কথা দিতেন কিন্ত কথা রাখতেন না। সংবিধান সংশোধনের কথাও তিনি শতভাগ প্রত্যাখান করেছেন। ‘
সংবিধানের বিষয়ে সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধান অজ্ঞান অবস্থায় আছে। যেটিতে বলা হয়েছে সকল ক্ষমতার উৎস জনগন, এটি একটি বড় জোচ্চুরি।
অর্থাৎ আমরা সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করব কিন্তু উৎস জণগণ। এখানে হওয়া উচিত ছিল জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক। অর্থাৎ জণগণই সকল ক্ষমতার দণ্ডধর। যেন সরকার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে তাকে সরিয়ে দেওয়া যায় এমন সুযোগও থাকে।’
সভায় সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরিফ খান বলেন, ‘আবুল মনসুর আহমেদ তাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় সকলের ধর্মের স্বাধীনতা থাকতে হবে বলেছেন। ৭১ ও ২৪ এ আমাদের সংগ্রাম ছিলো বৈষম্যের বিরুদ্ধে। আবুল মনসুর আহমেদও সবসময় বৈষম্যের বিরুদ্ধে কাজ করে গেছেন। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন আইকনিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ত্ব। বাঙালি মুসলমানদের প্রতিষ্ঠিত করতে সবসময় কাজ করে গেছেন এই রাজনৈতিক বিজ্ঞানী।’
চট্টগ্রাম বিশ্বিবদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনসহ আমাদের ইতিহাসে যে বড় বড় রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য আন্দোলন হয়েছে সেসব আন্দোলনে এলিট শ্রেণীরা অংশ নেয়নি, অংশ নিয়েছে গণমানুষ। আবুল মনসুর এলিট শ্রেণী হলেও তিনি এসব আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিলেন।’
সহ-উপাচার্য (একাডেমিক)অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেন, ‘গত প্রশাসনের দুর্নীতির ফলে আমরা এখনও শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলগুলো খুলে দিতে পারিনি। তবে আমরা স্থির থাকিনি। এই প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে।’
আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদের আহ্বায়ক কবি ইমরান মাহফুজ বলেন, ‘গণতন্ত্রে আমাদের শিক্ষকরা ফেইল করেছে বলেই আমাদের গণতন্ত্র ফেইল করছে । আবুল মনসুর বলেছেন গণতান্ত্রিক সরকার সঠিক পথে চলতে পারে যদি তার নাগরিক সোচ্চার হয়। আমরা যদি সোচ্চার না হই তাহলে শুধুমাত্র গণজাগরণ বা ২৪ আবু সাঈদের জীবন দেয়া পরিবর্তন এনে দিতে পারবে না।’
বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রচিন্তার উপদেষ্টা ও যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আর রাজী এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সংগঠনের সদস্য তানভীন কায়েস অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন।