কলকাতার এক নারী হিন্দিতে কথা বলতে অস্বীকার করে বাংলায় কথা বলছিলেন বলে তাকে শুনতে হলো যে তিনি বাংলাদেশে নেই, ভারতে আছেন! ভারতে থেকে কেন তিনি হিন্দি জানেন না, এই প্রশ্নও করা হয় ওই বাঙালি নারীকে।
এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ওই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে প্রথমে দুই নারীর মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হচ্ছে এবং পরে একাধিক পুরুষকেও সেই বিতর্কে যোগ দিতে ‘শোনা’ যাচ্ছে।
সেখানে একজন নারীকে ইংরেজি এবং হিন্দিতে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। অন্য নারীর শুধু গলা শোনা গেছে– তিনি বাংলায় কথা বলার জন্য জেদ করছেন।
ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি কে করেছেন, তা স্পষ্ট নয়, তবে যে নারী বাংলায় কথা বলার জন্য জেদ করছিলেন তার খোঁজ মিলেছে। শক্তিরূপা সাধুখাঁ নামের ওই নারী বলেছেন, ঘটনাটি কলকাতার মেট্রোরেল পরিসরে ঘটেছে ১৮ নভেম্বর দুপুরে।
তবে অন্য যে নারী বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।
শক্তিরূপা সাধুখাঁ দাবি করছেন, “যে ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, সেটা কে করেছেন আমি জানি না। তবে আমি নিজে একটা ভিডিও করেছিলাম ঘটনার। সেটা পরে রেল পুলিশ আমাকে জোর করে ডিলিট করিয়ে দেয়।”
বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘বাংলা পক্ষ’ বলছে শুধু নভেম্বর মাসেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় অন্তত সাতটি ঘটনা তারা জানতে পেরেছেন যেখানে হিন্দিতে কথা বলতে অস্বীকার করায় ‘বাংলাদেশি’ বলে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছে।
‘ইন্ডিয়াতে থেকে হিন্দি জানেন না?’
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া দুই মিনিট ২০ সেকেন্ডের ভিডিওর শুরুতেই দেখা যাচ্ছে যে এক নারী ইংরেজি এবং হিন্দি মিশিয়ে বলছেন, “আপনি বাংলাদেশে থাকেন না, আপনি ‘ইন্ডিয়া’তে থাকেন। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ইন্ডিয়া’র অংশ, তাই আপনাকে হিন্দি শিখতে হবে। আপনি বাংলা জানেন অথচ ‘ইন্ডিয়া’তে থেকে হিন্দি জানেন না?”
এরপরে আরেকটি নারী কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে (তাকে ভিডিওতে দেখা যায়নি)। শক্তিরূপা সাধুখাঁ দাবি করছেন যেই গলা তার। তাকে বাংলায় বলতে শোনা গেছে, “আমি পশ্চিমবঙ্গে থাকি, নিজের মাটিতে থাকি, তোর মাটিতে থাকি না।”
এরপর সাধুখাঁ অন্যদের উদ্দেশে বলছেন, “উনি আমাকে অপমান করছেন! আমার মাটিতে বসে আমাকে….”
জবাবে প্রথম নারী ইংরেজিতে বলেন, “মেট্রো আপনার নয়, ওয়েস্ট বেঙ্গল আপনার নয়।”
দুজনের তর্কের মাঝে প্রথম নারীকে বারবার হিন্দিতে বলতে শোনা যায়, “ইন্ডিয়া মে রহতে হো না, হিন্দি নেহি আতা? ইন্ডিয়ান হো না, হিন্দি নেহি আতা?” অর্থাৎ, ‘ভারতে থাকো তো, হিন্দি আসে না? ভারতীয় তো, হিন্দি আসে না?’
এরপরে একবার ওই নারীকে হিন্দিতে বলতে শোনা যায়, “ওয়েস্ট বেঙ্গল কোথায়? ‘ইন্ডিয়া’তেই তো? ‘ইন্ডিয়া’র ভাষা কী – হিন্দি!”
কেন তার অনুমতি না নিয়ে ভিডিও করা হচ্ছে, সেই কথাও বলেছেন ওই নারী। এর জন্য তিনি মামলা করবেন এবং ভিডিও রেকর্ডকারীকে জেলে যেতে হবে বলেও হুমকি দিয়েছেন।
এর মাঝে কয়েকবার দ্বিতীয় নারী-কণ্ঠে বলতে শোনা গেছে, “বাংলায় বলুন না প্লিজ।” ভিডিও রেকর্ডিংটি যেখানে কাট করা হয়েছে, তারপরের অংশে ইংরেজি ও হিন্দি বলতে থাকা নারীকে আবারও বলতে দেখা গেছে, “আমি হিন্দুস্তানি।”
এরপরে এক ভারিক্কি গলার পুরুষকে হিন্দিতেই বলতে শোনা যায়, “আপনি হিন্দুস্তানি তো কী! ইংরেজিতে বলুন!”
এই তর্কের মধ্যে একাধিকবার কয়েকটি পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেছে– হিন্দি এবং বাংলায় তারা বলছেন, দুজনে বাইরে গিয়ে ‘সলিউশন’ করে আসুন, আরও একাধিক ব্যক্তি বলছেন দুজনেই বাইরে যান না ইত্যাদি।
কেন বাঁধল ঝগড়া?
শক্তিরূপা সাধুখাঁ বলছেন, “আমি ১৮ই নভেম্বর হাওড়ার দিক থেকে মেট্রো রেলে উঠেছিলাম। খুব ভিড় ছিল। এসপ্ল্যানেড স্টেশনের লিফটে ওঠার পরে দেখা যায় ওজন বেশি হয়ে গেছে। ওই মেয়েটি একদম শেষে ওঠে লিফটে। যেটা স্বাভাবিক যে শেষে যিনি বা যারা ওঠেন, ওজন বেশি হয়ে গেলে তারা নেমে যান। কিন্তু ওই মেয়েটি কিছুতেই নামতে চাইছিল না।
“আমি বাংলায় তাকে বলি নেমে যেতে। তখনই সে আমাকে বলতে থাকে যে আমি কি বাংলাদেশি নাকি যে হিন্দি বলতে পারি না। ভারতে থেকে কেন আমি হিন্দি জানি না, এটা বারবার বলতে থাকে মেয়েটি,” জানাচ্ছিলেন মিজ সাধুখাঁ।
তিনি আরও বলছিলেন, “আমাকে বাংলাদেশি বলাতে আশপাশের যাত্রীরাও প্রতিবাদ করেন। গোটা ঘটনার প্রমাণ রাখার জন্য আমি ভিডিও করেছিলাম। তখনই আমাকে ওই মেয়েটি হুমকি দিয়েছিল যে মামলা করবে, জেলে পাঠাবে। এরপরে আমাদের দুজনকেই রেল পুলিশ এসপ্ল্যানেড স্টেশনে তাদের দফতরে নিয়ে যায়। তিন ঘণ্টা সেখানে থাকি আমরা দুজনেই। তখনই জানতে পারি যে মেয়েটি রাজস্থানের বাসিন্দা, এখানে পড়াশোনা করতে এসেছে। আমাকে বার বার বাংলাদেশি বলে কটাক্ষ করা হয়েছে সেই সময়ে। অন্যদিকে পুলিশ আমাকে নানাভাবে চাপ দিতে থাকে ভিডিওটি ডিলিট করে দেওয়ার জন্য।”
কলকাতায় বহু বাঙালিকেই আজকাল হিন্দিতে কথা বলতে দেখা যায়। তারা নিজেদের মধ্যে বাংলা বললেও অবাঙালিদের সঙ্গে নিজের থেকেই হিন্দিতে কথা বলছেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা