ঢাকাবৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

৭ নভেম্বর ও জিয়াউর রহমান | হাসান নাহিয়ান

আবু হাসান নাহিয়ান
নভেম্বর ৮, ২০২৪ ১২:০৬ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

৭ নভেম্বর ১৯৭৫ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে বিবেচিত। এটি এমন একটি সময় ছিল, যখন দেশ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সংঘাত, এবং চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই ঘটনা পুরো জাতিকে স্তব্ধ করে দেয় এবং স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় জাতি এক গভীর সংকটে পড়ে। খোন্দকার মোশতাক আহমেদ সেই সময় ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রপতি হন, কিন্তু তার সরকার জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।

এরপর, ৩ নভেম্বর ১৯৭৫-এ, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন এবং সেনাবাহিনীর ভেতরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। মেজর জিয়াউর রহমান, যিনি তৎকালীন সময়ে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় সামরিক কর্মকর্তা এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতাদের একজন, তাকে গৃহবন্দী করা হয়। সেনাবাহিনীর অনেক সিপাহী এবং নীচু স্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়, কারণ তারা জিয়াকে মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর এবং দেশের একজন প্রকৃত রক্ষাকর্তা হিসেবে সম্মান করত। সেই সময় সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে সামরিক বাহিনীর ভেতরে চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এই দিনটি “সিপাহী-জনতার বিপ্লব” নামে পরিচিত, যা দেশের ইতিহাসে এক বিশেষ মোড় সৃষ্টি করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চার বছর পর, ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ গভীর রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ দেশকে সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের মধ্যে অসন্তোষ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ফলে একাধিক অভ্যুত্থান ঘটতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে ৭ নভেম্বর সিপাহী ও সাধারণ জনতা একত্র হয়ে বিপ্লব সংঘটিত করে, যা দেশের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন করে দেয়।

এই সংকটময় সময়ে মেজর জিয়াউর রহমান দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন এবং দেশকে নতুন দিশা দিতে শুরু করেন। জিয়াউর রহমান তখন সেনাবাহিনীর একজন সম্মানিত কর্মকর্তা এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর, যিনি দেশের জন্য তার অপরিসীম ত্যাগের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। তার নেতৃত্বের মাধ্যমে সিপাহী-জনতার বিপ্লব সফল হয় এবং দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে “আমি মেজর জিয়া বলছি” উচ্চারণের মধ্য দিয়ে যে আত্মবিশ্বাসের সঞ্চার হয়েছিল, ৭ নভেম্বরেও সেই আত্মবিশ্বাস পুনরায় ফিরে আসে। দেশের জনগণ জিয়াউর রহমানের সাহসী ভূমিকা দেখে আবার নতুন আশার আলো দেখতে পায়। তার দৃঢ় ও দৃপ্ত কণ্ঠস্বরের মধ্য দিয়ে জাতি অনুভব করেছিল যে দেশ একটি নেতৃত্বপূর্ণ হাতের মধ্যে রয়েছে, যা জাতীয়তাবাদী চেতনা ও জনগণের স্বার্থে কাজ করবে।

জিয়াউর রহমান তার নেতৃত্বকে বৈধতা দিতে এবং জনগণের মতামত যাচাই করতে ১৯৭৭ সালের ৩০ মে একটি গণভোট আয়োজন করেন। এটি ছিল দেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা, যেখানে তিনি জনগণের কাছে তার শাসনব্যবস্থার প্রতি সমর্থন চাইছিলেন। সেই গণভোটে প্রায় ৮৮.৫ শতাংশ ভোটার তার শাসনের পক্ষে রায় দেন, যা তার জনপ্রিয়তা এবং জনগণের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ বহন করে। এই গণভোটের মাধ্যমে তার নেতৃত্ব আন্তর্জাতিক মহলেও স্বীকৃতি পায় এবং দেশে গণতান্ত্রিক চর্চার এক নতুন ধারা শুরু হয়।

জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশের পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার রাষ্ট্র গঠনের নীতি ছিল সুসংহত এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্য নিয়ে প্রণীত। তিনি “বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ” এর ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেন, যা দেশের জনগণের মধ্যে নতুন ধরনের দেশপ্রেম ও জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায়। জিয়ার নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধিত হয় এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসে।

১. বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা: জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর দেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তিনি জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে দেশের জন্য একটি গণতান্ত্রিক ও শক্তিশালী রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হন। এতে বাংলাদেশ একটি বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যায় এবং দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নতুন দিশা পায়।

২. উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড: জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে কৃষি, শিল্প, শিক্ষা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো হাতে নেওয়া হয়। তিনি গ্রামোন্নয়নে বিশেষ মনোযোগ দেন এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। জিয়ার আমলে উৎপাদনশীল খাতগুলোতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি সাধিত হয়, যা দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করে তোলে।

৩. সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার: দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি জিয়াউর রহমান সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায়ও গুরুত্বারোপ করেন। তিনি দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য নানাবিধ প্রকল্প হাতে নেন। দেশের অভ্যন্তরে আত্মনির্ভরশীলতার চেতনা জাগ্রত করার জন্য তিনি বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য সুফল বয়ে আনে।

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি স্বতন্ত্র ও সম্মানজনক অবস্থান অর্জন করে। তিনি ওআইসির (ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা) সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সুদৃঢ় করেন এবং মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেন। পাশাপাশি, জিয়া প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন ও বৈশ্বিক উন্নয়ন সহযোগিতার জন্য কাজ করেন।

জিয়াউর রহমান তার শাসনামলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কার করেন। তিনি প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী ছিলেন এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। তার সময়ে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ানোর লক্ষ্যে উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। এ ছাড়া, তিনি সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নেও ভূমিকা রাখেন, যা দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করে তোলে।

 

৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লব বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। জিয়াউর রহমানের দৃঢ় ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব জাতিকে নতুন দিশা দেয় এবং দেশের উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে সহায়তা করে। তার রাষ্ট্র গঠনের কর্মকাণ্ড ও সংস্কার দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিসরে স্থায়িত্ব এনে দেয়। তাই ৭ নভেম্বরের বিপ্লব ও জিয়াউর রহমানের অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে এক অনন্য মাত্রা যোগ করেছে। এদিন সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জাতি প্রবল রাজনৈতিক অরাজকতা ও সংকট থেকে মুক্তি পায়, যা জাতীয় ঐক্যের নবজাগরণ ঘটায়। এই বিপ্লব শুধুমাত্র সামরিক উত্তরণ নয়, বরং জাতীয় সংহতির প্রাকৃতান্তর ও সার্বভৌমতার সুরক্ষায় এক প্রকট প্রতিশ্রুতি। জনমত ও সশস্ত্র শক্তির সম্মিলিত শক্তিতে উদ্ভাসিত এই দিনটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষায় এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে, যা স্বাধীনতাপ্রেমী জাতির চেতনায় সর্বদা প্রোথিত থাকবে। ৭ নভেম্বর তাই এক গৌরবময় অধ্যায়, যা স্বাধীনতা রক্ষার দিক থেকে অতুলনীয়।

লেখক: সমাজকর্মী ও ছাত্রদল নেতা