গত তিন মাসে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর বকেয়া ৫৭৮ মিলিয়ন ডলারের বিল পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি), এটি এমন এক অর্জন, যা গত দুই বছরে করতে হিমশিম খেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি।
গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে জ্বালানি সরবরাহকারীদের কাছে বিপিসির প্রতি মাসে বকেয়া বিলের পরিমাণ গড়ে ছিল ২০০ মিলিয়ন (২০ কোটি) ডলারের কাছাকাছি। বকেয়া বিলের কারণে অনেক সময় জ্বালানিবোঝাই জাহাজ চালান খালাস না করতে পেরে— চট্টগ্রাম বন্দরের অদূরে সাগরে অপেক্ষা করেছে। যার ফলে বেড়েও যায়, জাহাজ ভাড়া ও ক্ষতিপূরণ মাশুল (ডেমারেজ চার্জ)।
তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি, বন্টন ও বিপণনের দায়িত্বে থাকা বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন আল আহসান দ্রুত দেনা পরিশোধের এই অর্জনের কৃতিত্ব কিছু কৌশলগত পরিবর্তনকে দেন, যার ফলে জ্বালানি সরবরাহকারীদের কাছে তাঁর সংস্থার ভাবমূর্তির উন্নয়ন যেমন হয়েছে, তেমনি বেড়েছে দর কষাকষির সক্ষমতা।
বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন আল আহসান বলেন, “৭ নভেম্বর নাগাদ বিপিসির কাছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের আর কোনো দেনা নেই, অর্থাৎ তা শূন্যে দাঁড়িয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো – বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে আমাদের এলশি (ঋণপত্র) খোলার সিদ্ধান্ত, যাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ছিল।”
গত তিন মাস ধরে এলসি করতে ব্র্যাক ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, দ্য সিটি ও ইসলামী ব্যাংকের সাথে কাজ করেছে বিপিসি। যার মাধ্যমে নতুন করে বৈদেশিক দেনা সৃষ্টি হয়নি। বিপিসির একটি এলসির মূল্য সাধারণত প্রায় ২৫ মিলিয়ন ডলার। প্রতিমাসে ১৭ থেকে ১৮টি এলসি খোলা হয় – যার মোট পরিমাণ ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। এই পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলারের চাহিদা শুধুমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব ছিল না।
কৌশলের এই পরিবর্তনের ফলে সোনালীসহ অন্যান্য সরকারি ব্যাংকের ওপর বিপিসির নির্ভরতা কমেছে। এই সময়ে সোনালীসহ সরকারি ব্যাংকগুলো আগে খোলা এলসির বকেয়া বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করেছে, যা আগে বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের কারণে করা যায়নি।
দেশের বাজারে বৈদেশিক মুদ্রা তথা ডলারের সংকট থাকায় পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে জ্বালানি তেল, খাদ্য ও রাসায়নিক সারসহ জরুরি পণ্য আমদানির জন্য ডলার সরবরাহের নির্দেশ দেয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭.৬২ বিলিয়ন ডলার, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৩.৫৮ বিলিয়ন ডলার, এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১২.৭৯ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। কিন্তু, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকায়— বাংলাদেশ ব্যাংকও সবসময় চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ করতে পারেনি। যেকারণে ধাপে ধাপে জ্বালানি তেল আমদানিতে বিদেশি সরবরাহকারীদের কাছে বিপিসির দেনা বাড়তে থাকে।
বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন আল আহসান বলেন, সোনালীসহ অন্যান্য সরকারি ব্যাংকের ওপর নির্ভরতা একদম কমে গেছে। যেকারণে এই সময়ে সোনালী ব্যাংকসহ অন্যান্য সরকারি ব্যাংক আগে খোলা এলসির বকেয়া বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করেছে। রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, জ্বালানি উপদেষ্টা সরকারি ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের বিপিসির বকেয়া পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করার নির্দেশনা দেন। এতে বৈদেশিক সরবরাহকারীরা অত্যন্ত খুশি জানিয়ে বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘এর আগে সরবরাহকারীদের সাথে দরকষাকষির ক্ষেত্রে বিপিসি কিছুটা দুর্বল অবস্থানে থাকতো। তারা বলতো, তোমরা (বিপিসি) সময়মতো পেমেন্ট করো না। এখন সেটা আর হবে না। আগামী ডিসেম্বরে পরবর্তী ছয় মাসের জন্য তেল সরবরাহের চুক্তি করবে বিপিসি। এবারে দরকষাকষিতে কোনো দুর্বলতা থাকবে না।
বেসরকারি ব্যাংকে এলসি খোলার ক্ষেত্রে বাড়তি কোনো খরচ হচ্ছে না বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, ঢাকা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়াও এলসি খোলার আগ্রহ দেখিয়েছে। আগামী সপ্তাহে হয়ত এসব ব্যাংকে এলসি খোলা হবে। এছাড়া জানুয়ারিতে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে এলসি খোলার পরিকল্পনা আছে।
আগে রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংকের মাধ্যমে বিপিসি এলসি খুলতো। এখন সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৯টি ব্যাংকের মাধ্যমে খোলা হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর চাপও কমে গেছে। বিপিসির জন্যও প্রক্রিয়াটি সহজ হয়েছে।
দেশে জ্বালানি তেলের একমাত্র আমদানিকারক হিসেবে বিপিসি বিদেশি মুদ্রায় জ্বালানি ক্রয় করে এবং স্থানীয় মুদ্রায় বিক্রি করে। একমাত্র বাংলাদেশ বিমানের কাছে পাওনা ছাড়া জ্বালানি তেল বিক্রির কোনো টাকা বকেয়া থাকে না। ব্যাংকগুলোকে স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায় তেল আমদানির এলসি খোলে সংস্থাটি।
করোনা পরবর্তী সময়ে জ্বালানি আমদানি চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় – বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে পড়ে। আমদানি দায় অনুযায়ী, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় না হওয়ায়– বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকে। বাড়তে থাকে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার।
বাজারের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করেও সামাল দিতে পারেনি। এক পর্যায়ে টাকা থাকলেও ডলার পায়নি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এই পরিস্থিতিতে পড়ে বিপিসি বৈদেশিক সরবরাহকারীদের পাওনা সময়মতো পরিশোধ করতে পারেনি। পরিণত হয়েছিল দেনাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে।
গত ২০ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ইউএনবিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধীরে ধীরে বাড়ছে এবং স্থিতিশীল হচ্ছে। আগের সরকারের আমলে রিজার্ভ প্রতি মাসে ১.৩ বিলিয়ন (১৩০ কোটি) ডলার করে কমে আসছিল, তবে এখন তা একটি ইতিবাচক প্রবণতায় ফিরছে।
গভর্নর আরও বলেন, ‘সার, বিদ্যুৎ ও আদানি-শেভরনের বকেয়া পাওনার জন্য এরইমধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। শুধু গত দুই মাসেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক জ্বালানি ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় সেবার বকেয়া ১.৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে — অপরিশোধিত বিল ২.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৭০০ মিলিয়ন ডলারে নামিয়ে এনেছে।’