পতিত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ব্যবসা করে শত কোটি টাকা লুট করেছেন বোয়ালখালীর আওয়ামী লীগ নেতা মো. মনছুর আলম পাপ্পী এবং তার ভাই মো. আলম ববি।
মনছুর আলম পাপ্পী বোয়ালখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। কিন্তু ধুরন্দর এই সন্ত্রাসী ও অবৈধ ব্যবসায়ী ৫ আগস্টের পর বিএনপি নেতাদের সাথে দেখা করে আগের মতো ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট অংশে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এখনও বালু উত্তোলন করছে পাপ্পী এবং ববি গং-এর নিয়োগ করা সন্ত্রাসীরা।
কালুরঘাট সেতু, সিইউএফএল পাম্প হাউস ও মাটির নিচে পাইপলাইন থাকায় এই এলাকাটি স্পর্শকাতর হিসেবে চিহ্নিত। সেখান থেকে উত্তোলিত বালু নদীর দুই পারে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। অথচ বালু উত্তোলনের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বা জেলা প্রশাসন কোনো ইজারা দেয়নি।
এছাড়া বালু তোলার জন্য কালুরঘাট এলাকার ঘাটটি একরকম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উত্তোলন করা বালু ভবন, ব্রিজ কালভার্টসহ বিভিন্ন নির্মাণকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বালু বিক্রি করে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা অবৈধভাবে আয় করছেন মনছুর আলম পাপ্পী। পুরো কালুরঘাট এলাকায় অবৈধ বালু ব্যবসা তার নিয়ন্ত্রণে থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগ আছে।
বিএনপি নেতাদের সাথে সমঝোতার চেষ্টা
পতিত সরকারের মন্ত্রী হাসান মাহমুদ, চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী এবং চান্দগাও-বোয়ালখালীর সাবেক সাংসদ নোমান আল মাহমুদের সাথে সখ্যতা রেখে নিজেদের বেআইনি বালু ব্যবসা টিকিয়ে রাখেন পাপ্পী এবং ববি গং। অবৈধ ব্যবসার ভাগ পৌঁছে যেত এসব নেতাদের কাছে।
বিশেষ করে পলাতক সাবেক মন্ত্রী হাসান মাহমুদের ভাইয়েরা পেতেন এই বেআইনি ব্যবসার একটি অংশ। ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণ অভ্যুথানের পর স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনের পর এক প্রকার গা ঢাকা দেন এই দুই প্রতারক ব্যবসায়ী।
কিছুদিন আত্নগোপনে থাকার পর নিজেদের আওয়ামী পরিচয় লুকিয়ে ফুলের তোড়া দিয়ে দেখা করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং তার ছেলে সামির কাদের চৌধুরীর সাথে।
যদিও পরবর্তীতে এই দুই প্রতারকের উদ্দেশ্য বুঝতে পারে তাদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী।
সামির কাদের চৌধুরী সিটিজি পোস্টকে বলেন, “কার্যালয়ে অনেকেই ফুল দিতে আসছিলেন সেই হিসেবে এই প্রতারকেরাও ঢুকে পড়েছিলেন৷ আমরা ভবিষ্যতে এমন বিতর্কিত ব্যক্তিদের উপস্থিতির ব্যাপারে সতর্ক থাকব।”
কর্ণফুলী নদী থেকে প্রতিদিন বিপুল পরিমান বালু উত্তোলন করায় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন মো. মনছুর আলম পাপ্পী এবং মো. আলম ববি।
চট্টগ্রামের প্রাণ কর্ণফুলী নদী। এ নদী ঘিরে চট্টগ্রামের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার। চট্টগ্রামের লাইফ লাইন খ্যাত এ নদীটি অবৈধ দখল ও অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে তীরবর্তী এলাকা ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, এতে নদীর পাশাপাশি জীব বৈচিত্র্য সংকটের মুখে পড়ছে। নদীর দু’পাশ ভাঙ্গনের কবলে পড়ছে।
অভিযোগ রয়েছে, অবৈধভাবে বালু তুলে চট্টগ্রাম মহানগরীসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় পাচার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে পাপ্পি চক্র। অন্যদিকে ইজারা না দেয়ায় সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ নিয়মনীতি অনুসরণ না করে বালু তোলায় বেড়েছে কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এলাকার ভাঙন। ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি হারিয়ে নিংস্ব হচ্ছে নদী পাড়ের শত শত মানুষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, ইজারাদাররা যত্রতত্র ড্রেজার বসিয়ে অবাধে বালু উত্তোলন করছে। একেকটি ড্রেজার দিয়ে দৈনিক ৩০ থেকে ৫০ হাজার ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা যায়।
কালুরঘাট থেকে নতুন ব্রিজ এলাকা পর্যন্ত দেড়শটি বালু মহাল রয়েছে, ৫০টির বেশি ড্রেজার মেশিন রয়েছে। এসব বালু মহালের কোনটি ইজারাপ্রাপ্ত, আবার কোনটি ইজারা ছাড়াই ব্যবসা করছে।
দেশের অর্থনীতির প্রাণ প্রবাহ বলা হয় চট্টগ্রাম বন্দরকে। কর্ণফুলী নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বন্দর কার্যক্রমও হুমকির মুখে পড়েছে নির্বিচারে বালু উত্তোলনের কারণে।
কর্ণফুলীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে শত শত অবৈধ বালু মহাল। শাহ আমানত সেতু এবং কালুরঘাট রেল সেতুর কাছ থেকেও দিনরাত বালু উত্তোলন চলছে। সেতু দুটির জন্য যা এখন হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতে, বালুদস্যুদের কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রামে কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রতিরক্ষা বাঁধ এখন হুমকির মুখে। অনেক জায়গায় বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে।
বিগত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের সময় নছুর আলম পাপ্পীসহ কারো বিরুদ্ধেই অভিযান চালাতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড। বিশেষ করে তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী হাসান মাহমুদের ছত্রছায়ায় বারবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন মো. মনছুর আলম পাপ্পী এবং তার ভাই মো. আলম ববি।
বিগত বছরগুলোতে পানি উন্নয়ন বোর্ড বহুবার চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে বালু উত্তোলন বন্ধে সহায়তা চেয়েছিল। কিন্তু প্রশাসন বালু উত্তোলনে নিয়োজিৎ বোয়ালখালীর এসব চিহ্নিত দস্যুদের কোনোভাবেই দমাতে পারেনি।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুত এই দুই অপরাধীকে পরিবেশ ধ্বংস , রাজস্ব ফাঁকি এবং অবৈধ ব্যবসার দায়ে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবেন বলে আশাবাদী কালুরঘাট অঞ্চলের স্থানীয় নাগরিকদের।
চট্টগ্রামের প্রশাসনের একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিটিজি পোস্টকে জানিয়েছে, পরিবেশ ধ্বংসকারী এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রনালয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে শীঘ্রই অভিযান শুরুর কথা রয়েছে।
মো. আলম ববির ভোল পাল্টানোর নানা চেষ্টা ও তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মাওয়া ট্রেডার্সের নামে অবৈধ সম্পদ অর্জনে ও অপরাধের ফিরিস্তি নিয়ে শীঘ্রই দুই পর্বের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।