ঢাকামঙ্গলবার, ২২শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

দুই টুকরো মানবতা, এক টুকরো ফ্যাসিজম | মতামত 

সাজিদ সামী চৌধুরী | সিটিজি পোস্ট
অক্টোবর ২১, ২০২৪ ১:৫৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

কালচারাল ফ্যাসিজম মানেই কি শুধু বাচালতা আর শৃঙ্খলার গল্প? মোটেই না। বাস্তবে এটি এমন এক খেলা, যেখানে কিছু মানুষ তাদের সংস্কৃতির নিয়মগুলোকে আপনাদের ওপর এমনভাবে চাপিয়ে দেয় যেন আপনার অন্য কোনো সংস্কৃতি চর্চার অধিকারই নেই। আর এই খেলার সবচেয়ে মজার দিক হলো, তারা এই কাজগুলো এমন প্যাশন দিয়ে করে, যেন এটা জাতীয় গৌরবের বিষয়!

 

ধরা যাক, হিপহপ চর্চাকারীদের ঢোলা কাপড় পরা দেখে কেউ হয়তো ভাবছে, “এত কাপড়, আবার এমন ঢোলা!” তাদের দৃষ্টিতে এটা যেন নতুন এক সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। কিংবা পেপার বলতে সবাই ধরে নিল রিসার্চ পেপার, আর কেউ যদি ভাবল, পেপার মানেই জয়েন্টের পেপার, তখন তো রীতিমত বিশ্বসংস্কৃতি তোলপাড়।

 

সত্যি বলতে, কালচারাল ফ্যাসিজমের মোড়ক খুললেই এসব ছোটখাটো হাস্যরসাত্মক ঘটনা ফুটে ওঠে। চলুন, এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু গুফতগু করি, দেখি কোনো জুস্তজু মিলে কিনা।

 

“কালচারাল ফ্যাসিজম” শব্দটা শোনার পর থেকে অনেকেই হয়তো ভাবছেন, কীসের আবার ফ্যাসিজম, কীসের কালচারাল? একদম ঠিক, মশাই। ফ্যাসিজম তো আর দাড়ি-গোঁফে হিটলার, মুসোলিনি ধরনের লুক নিয়ে আমাদের দরজায় ধাক্কা দেবে না। এটা তো সেই পেঁয়াজের খোসা, আস্তে আস্তে বের করতে হয়, আর বের হলেই টিয়ার গ্যাসের মতো চোখে পানি আসে!

 

দেখুন, হিটলারের জামানার ফ্যাসিজম ছিল নির্দিষ্ট স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, যেখানে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে। আজকের দিনে সেই মডেল পুরনো হয়েছে। একালের ফ্যাসিজম নরম ঘুঁটে; চেহারায় ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে আসে, সবার ঘরেই ঢুকে বসে আছে, কিন্তু আপনাকে বুঝতেই দেবে না যে, আপনি আস্তে আস্তে একটা ভয়ংকর জালে জড়িয়ে যাচ্ছেন।

 

এই “কালচারাল ফ্যাসিজম” কি তাহলে? সহজ কথায় বলতে গেলে, এটি সেই কৌশল যার মাধ্যমে আপনাকে ধীরে ধীরে বিশ্বাস করানো হয় যে, এই সমাজের একটা “নির্দিষ্ট” সংস্কৃতি আছে, বাকিগুলোকে কেটে বাদ দিলেও চলবে। মানে, যে টেবিল লেবু ছাড়া চলে না, তাতে গোটা আম রাখার কোনো সুযোগই নেই। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, যারা এই ফ্যাসিজম চালায়, তারা ঠিক এটুকুই চায়—“সবার ঘরে একটাই গান বাজবে, একটাই নাচ হবে।”

 

১৯৪৫ সালে সমাজতান্ত্রিক শক্তির পতনের পর থেকে আমাদের “উদারনীতিকেরা” যখন সমাজতন্ত্রের বিলুপ্তি দেখে হাততালি দিয়ে ওঠেন, তখন তারা খেয়ালই করেন না যে, সমাজতন্ত্রের পতন মানেই ফ্যাসিজমের এগিয়ে আসা। গণতন্ত্রকে তো কেউ রক্ষা করতে আসছে না। বরং কেউ কেউ এসব উদারনীতির ঢাক কেটে রেখে সমাজের মুখোশটাই বদলে দিয়েছে। কালচারাল ফ্যাসিজম মানে ঠিক তাই—আপনার চিন্তা, বিশ্বাস, অভ্যাসগুলোকে ধীরে ধীরে একটা “মাথা নত” সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করা।

 

এখন কথা আসে, সংস্কৃতিতে ফ্যাসিজম কীভাবে? উদাহরণ দিতে হলে বলতে হবে, আপনার ভাবনা, আপনার পড়া-লেখা, আপনার রুচি সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আপনি কি জানেন কেন আজ ইসরায়েল তার বর্ণবাদী কার্যকলাপের পরেও মিডিয়ার পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে? কেন আপনাকে “বিশ্ব সংস্কৃতি” শিখতে হবে আমেরিকানদের কাছ থেকে? ফ্যাসিজমের সুনির্দিষ্ট মডেল নেই। এটি সময়ের সাথে বিবর্তিত হয়েছে এবং এখন “কালচারাল” জগতে ঢুকে পড়েছে।

 

ফ্যাসিবাদ যখন আসে, প্রথমে আসে মিথ্যে আশ্বাস নিয়ে। হিটলার তখন বলেছিল “জার্মানির মহত্ব প্রতিষ্ঠা হবে।” আজও কিন্তু সেই একই কথা চলছে। আওয়ামী লীগ আমাদের শেখাতে চায় “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা,” আবার বিএনপি বলে “দেশ বাঁচাও।” এদিকে দুই দলই আমাদের চিন্তার জগৎটা এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যেন আমরা তাদের ন্যারেটিভ ছাড়া কিছুই বুঝতে না পারি।

 

ফ্যাসিজমের মূল বৈশিষ্ট্যই হল এমন একটা সমাজ গঠন করা যেখানে জনগণের মানসিকতা এমনভাবে গড়ে তোলা হবে যেন তারা নিজেরাই নিজেদের চিন্তাশক্তি হারিয়ে বসে। এই কাজ করতে হলে, অবশ্যই শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে তা কীভাবে হচ্ছে? দেশপ্রেমের নামে, গণতন্ত্রের নামে, সমাজের নামে! কিন্তু এর শেষ কোথায়? একেবারে আপনার রুটিন জীবনের সবকিছুতেই ছায়া ফেলেছে।

 

বইমেলায় আজকাল আর আপনি “আলোচনা চক্র” খুঁজে পাবেন না, পাবেন “উন্নয়ন মেলা,” যেখানে সংস্কৃতির বদলে উন্নয়ন দেখানো হয়। এটাই তো ফ্যাসিজমের সহজ পথ—লোকের মন থেকে সংস্কৃতিকে মুছে দিয়ে তাকে নতুনভাবে গড়তে হবে। আপনি আর “ভাইসাব” বলবেন না, বলবেন “সার”; “ভাতের হোটেল” বদলে হয়ে যাবে “ক্যাফে,” যেখানে দেশের নিজস্বতা নেই, আছে কেবল একধরনের মুখোশ।

 

এখন অনেকেই বলবেন, “এই কি শুধু আমাদের দেশে?” না, না মশাই, সারা পৃথিবীতেই এই রকম চলছে। আমেরিকাতে যাকে বলে “ফ্রি স্পিচ,” সেটাই আজ কালচারাল ফ্যাসিজমের হাতিয়ার। যে হিউম্যান রাইটস নিয়ে বড় বড় বক্তৃতা হয়, সেটা যখন নিজেদের অর্থনীতি বা পলিসির স্বার্থে চলে যায়, তখন সেখানে “উন্নয়ন” আর “নিরাপত্তা” ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।

 

আর মধ্যপ্রাচ্যে? ফিলিস্তিনে যারা নির্যাতিত হচ্ছে, সেই হাহাকারের খবর কে শুনবে? সেখানে তো সরকারেরাও চাইছে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক “স্বাভাবিক” হোক। আপনারা কি দেখতে পাচ্ছেন না, আজকের মুসলিম দেশগুলো কীভাবে আমেরিকা বা ইউরোপের দিকে তাকিয়ে “নিরাপত্তা” ও “উন্নয়ন” চাইছে? এগুলোও কালচারাল ফ্যাসিজমের প্রভাব।

 

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে যারা ব্যবহার করে আমাদের মনোজগতকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তারা বুঝতেও দেবে না যে আমাদের স্বাধীনতাই হরণ হচ্ছে। সেজন্যই আমাদের ফিলিস্তিনের বাচ্চারা আজ কান্নায় বলে, “মরে যেতে চাই,” আর কেউ তা শুনতে চায় না। ঠিক তেমনই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনলে আমরা তো গর্বিত হবই, কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এই গর্বিত হওয়ার সুযোগকে আজকের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের এজেন্ডা প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবহার করছে না তো?

 

এই প্রসঙ্গে “কালচারাল ফ্যাসিস্ট”দের এক সহজ স্ট্র্যাটেজি হলো প্রচারণা চালানো। দেখুন না, কোথাও হিন্দুদের মূর্তি ভাঙলেই সবার আগে সেখানে লড়াই বাধাতে আসবে কিছু দল, কিন্তু তারপর আর কিছুই করবে না। আসলে সেগুলো “কালচারাল প্রতীক,” যেখানে ফ্যাসিস্টরা নিজেদের মতাদর্শ প্রচার করে, আর জনতাকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে।

 

অথচ, আজকের গণমাধ্যমে খুব কমই পাবেন এমন আলোচনা যা আসলেই আমাদের চোখ খুলে দেয়। কারণ, এখানে “বুদ্ধিবৃত্তি বিরোধী” এক প্রবণতা কাজ করে, যা আসল সত্যটা আপনার থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এইটাই আসল কালচারাল ফ্যাসিজমের জাদু, যেখানে জনগণ নিজে থেকেই নিজেদের স্বাধীনতা হারাতে থাকে।

 

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বুদ্ধিজীবীরাও এখন নিজেদের ভাষা ব্যবহারে খুব সতর্ক। এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকও ঠিক করে বলবেন না, “ফ্যাসিজম” বললে সমস্যা হবে, তাই বলবেন, “সংশোধন” করা দরকার।

 

একদিকে আচার-অনুষ্ঠানে আপনি বৈচিত্র্য দেখবেন না, আর অন্যদিকে গণতন্ত্রের নামে, দেশের উন্নয়নের নামে একটা পুরো সমাজকে মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলা হবে। এগুলোকে বুঝতে পারাটাই আজকের দিনে বড় চ্যালেঞ্জ। যতোদিন আমরা এ চ্যালেঞ্জটাকে মোকাবিলা না করতে পারবো, ততোদিন ফ্যাসিজম আমাদের চারপাশে আপন গতিতে ছড়িয়ে পড়বে, আর আমরা দেখতে থাকবো, চুপ করে।

 

“কালচারাল ফ্যাসিজম” বলতে যে ধারণাটি বোঝানো হয়, তা বড্ড জটিল ও গভীর, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে সংস্কৃতি একদিকে অতি বৈচিত্র্যপূর্ণ আর অন্যদিকে গভীরভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত। ফ্যাসিজম মানেই কেবল ক্ষমতার জোরে দেশ শাসন নয়; এটা হলো ধীরে ধীরে সমাজের প্রতিটি স্তরে ঢুকে পড়া একধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, যা মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস, ও সংস্কৃতির ওপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।

 

প্রথমেই বলতে হয়, বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ মানে কী? হ্যাঁ, এটাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে মিশিয়ে একরকম পবিত্রতার মুকুট পরানো হয়। অথচ, আসলে এটা তো এখন রাজনৈতিক ব্র্যান্ডিংয়ের হাতিয়ার! আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত — যারাই ক্ষমতায় আসুক, নিজেদের দেশপ্রেমিক বলে পরিচয় দেবে। কিন্তু আসল কাজ? নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে জাতীয়তাবাদকে এত বেশি ব্যবহার করা হয়েছে যে, তা এখন ম্যানিপুলেশনের একটি উৎকৃষ্ট পদ্ধতি ছাড়া আর কিছু নয়। আজকাল দেখবেন, যেকোনো প্রতিবাদ আন্দোলন দমানোর জন্য “দেশদ্রোহী” তকমা দেওয়া হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তোলা হচ্ছে, যেনো এইসব তর্কে-ভালোবাসায়-রাগে তারা একাধারে বিচারক আর সাক্ষী।

 

বাংলাদেশের সংস্কৃতি বৈচিত্র্যপূর্ণ। এখানে বাউল গান, ভাওয়াইয়া, রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে শুরু করে আধুনিক হিপ-হপ পর্যন্ত সবই আছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে কী প্রচার করা হয়? সংস্কৃতির এক-একটা শাখাকে উসকে দিয়ে আরেকটা শাখাকে ছাপিয়ে রাখার খেলা চলে। উদাহরণস্বরূপ, বাউলদের যেমন আধিপত্য, তেমনই সংখ্যালঘুদের নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে কৌশলে দূরে ঠেলে রাখা হয়।

 

বাংলাদেশে “বিজয় দিবস” কিংবা “মুক্তিযুদ্ধের মাস” এলেই স্কুল-কলেজে সবার মধ্যেই একটা দেশপ্রেমের ঢেউ চলে আসে। আর যারা “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা”র বাইরে কিছু বলতে চায়, তারা কী? তারা হলো “দেশদ্রোহী,” “মৌলবাদী,” আর নানা রকমের ট্যাগ পেতে থাকে। যেনো রাষ্ট্রের চেয়েও বড় দেশপ্রেমের দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন কিছু লোক। আর সেই লোকগুলোই দেশের নাম ভাঙিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কালচারাল ফ্যাসিজমের সবচেয়ে বড় প্রচারক।

 

যেমন ধরুন, আজকাল “জয় বাংলা” স্লোগান একটা দলীয় স্লোগান হয়ে উঠেছে। একদিকে স্বাধীনতার মহত্ত্ব, আর অন্যদিকে সেই স্লোগানের আড়ালে সব রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ার খেলা। যে দলই ক্ষমতায় আসে, তাদের ব্যানারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে তোলে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব একচেটিয়া দাবি করে ফেলে তারা। যেনো বাকিরা কেউ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গড়ার অংশই ছিল না। এভাবে ফ্যাসিজমের একটা দুর্দান্ত খেলা চলছে — যেখানে কালচারাল আইকনগুলো একেকজন একেক দলের অধীনে চলে যাচ্ছে। ফ্যাসিস্টদের চরিত্রই এমন, নিজের আদর্শ চাপিয়ে দিতে চায়, আর এদেশে সেই চাপের শুরু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে।

 

কালচারাল ফ্যাসিজমের বড় একটি উপাদান হলো, বুদ্ধিজীবীদের দমিয়ে রাখা। আজকাল যদি কেউ স্বাধীনভাবে কোনো রাজনৈতিক ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে কথা বলে, তাদের জীবনে বিষিয়ে তোলা হয়। সামাজিক মাধ্যমেও একদল “দলীয় ট্রোল আর্মি” সবসময় ওঁত পেতে থাকে, যেখানে কেউ ভিন্নমত পোষণ করলেই তাকে নোংরা ভাষায় আক্রমণ করা হয়। এমনকি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরাও সেই চাপের বাইরে নন। কিছু ভিন্নমতাবলম্বী শিক্ষকের চাকরি হারানোর ঘটনা, অথবা চাকরি থাকলেও পদোন্নতি না পাওয়ার উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। এই ফ্যাসিজম এত সূক্ষ্ম যে, একসময় মানুষ আর মুখ খোলার সাহসই পায় না।

 

একটা উদাহরণ দেওয়া যায়, কেন যেনো হঠাৎ সব শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, নাট্যকার — সবাই একযোগে ‘বঙ্গবন্ধু’মুখী হয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে নাটক, সিনেমা, বই, সবই বের হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যারা প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে কাজ করছে তারা কই? কিংবা যারা সত্যিকার অর্থে সমালোচনামূলক কাজ করতে চায়, তারা কি সেই সুযোগ পাচ্ছে? এসবই প্রপাগান্ডার একধরনের খেলা, যেখানে সংস্কৃতিকে নিজের মতো করে মোড়ানো হয়।

 

বাংলাদেশে ধর্মের ব্যবহারও কালচারাল ফ্যাসিজমের অন্যতম হাতিয়ার। একদিকে সরকার গায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পোশাক পরিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে, অন্যদিকে গোপনে ধর্মীয় দলগুলোর সাথে সমঝোতা করে চলে। এটি একপ্রকার কালচারাল ফ্যাসিজম, যেখানে ধর্মকে একটা চমৎকার হাতিয়ার বানিয়ে মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়।

 

আজকে যদি কাউকে ইসলাম নিয়ে কিছু বলতে দেখেন, সে মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তাকে মৌলবাদী ট্যাগ দেওয়া হয়; আর যদি হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়, তাহলে তো কথাই নেই — সেই ব্যক্তি হয়ে যায় ‘দেশের শত্রু’। সরকার তথা রাষ্ট্রযন্ত্র এসব ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়া তো দূরের কথা, বরং এই ধরনের তকমা লাগানোর পেছনে তার মদতই বেশি।

 

বাংলাদেশে কালচারাল ফ্যাসিজম এখন প্রায়ই একটি ‘শুদ্ধ’ সংস্কৃতি তৈরির মিশনে লিপ্ত। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে একটা বিভাজনের খেলাই চলেছে। যেমন, কোনটা খাঁটি বাঙালির সংস্কৃতি আর কোনটা নয়, তা নিয়ে কত চুলচেরা বিচার! একজন কবি বা শিল্পী যখন রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে থেকে কথা বলেন, তাকে ঠিক কিভাবে দমানো যায়, সেটাই কালচারাল ফ্যাসিজমের মূল লক্ষ্য।

 

সংক্ষেপে বলা যায়, বাংলাদেশে কালচারাল ফ্যাসিজম হলো এমন একটি ‘অদৃশ্য দড়ি’, যা একাধারে আমাদের চিন্তা, বিশ্বাস, সংস্কৃতি, সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। মুক্তচিন্তার প্রবাহ থামিয়ে দেওয়া আর দলীয় মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার এক জটিল প্রক্রিয়া — যেখানে জাতীয়তাবাদ, ধর্ম, সংস্কৃতি সবই এক ধরনের ‘কাঠামো’র মধ্যে ঢেলে দেওয়া হয়, এবং তার বাইরে কিছু থাকতে পারে না।

 

এই ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াই শুধু রাজনীতির নয়; সংস্কৃতিকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন করা, এবং সেই সাথে ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখানো — এটাই হলো বর্তমান সময়ের বড় প্রয়োজন। নয়তো জাতি হিসেবে আমরা আরেকবার কালচারাল ফ্যাসিজমের ফাঁদে আটকে যাবো, আর বেরোতে পারব না।

 

তবে, শেখ হাসিনার সরকারের পতননোত্তর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। তবে এই পরিবর্তনকে আমরা কতটা আশাব্যঞ্জক বা বাস্তবিক দেখতে পাচ্ছি, সেটাই মূল প্রশ্ন। যে শাসন ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের মুখোশ পরে স্বৈরতন্ত্র চালানো হয়েছিল, সেটির শেষ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আসল পরিবর্তন কি হয়েছে?

 

স্বাধীনতার স্লোগান “জয় বাংলা” কীভাবে আওয়ামী লীগের মালিকানাধীন স্লোগান হয়ে গেলো? তারা এই স্লোগানটিকে তাদের নিজস্ব কর্পোরেট ব্র্যান্ড বানিয়ে ফেলেছে। যেখানে এই স্লোগানটি হওয়া উচিত ছিল মুক্তির প্রতীক, সেখানে তা হয়ে গেছে “পাওয়ার গেম”-এর অস্ত্র। কেউ যদি বিরোধিতা করে, তাকে “রাজাকার” বলে গালি দেওয়া, যেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একচ্ছত্র দাবিদার শুধু তারাই। এই সাংস্কৃতিক দখলদারির এমন দুঃসাহস, যেন বাকিরা কোনো মানুষই নয়।

 

হাসিনার পতনের পরে নতুন শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতায় এলেও, দেশবাসীর জীবনে কতটুকু বাস্তবিক পরিবর্তন এসেছে? দেশে নতুন সরকার এসেছে বলে গণতন্ত্র ফিরে এসেছে কি? সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক মুক্তির স্বাদ পেতে হলে শুধু ক্ষমতার পালাবদল যথেষ্ট নয়, দরকার জনগণের স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ এবং সঠিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রবর্তন।

 

নতুন নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতি যতই মধুর হোক না কেন, তাদের কাজগুলোও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বহুবার এমন হয়েছে যে, এক শাসকের পতনের পর নতুন শাসক এসেছে এবং ক্ষমতায় এসে আগের পথেই হেঁটেছে। হাসিনার পতন এই চক্র ভাঙতে পারবে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়।

 

শেখ হাসিনার শাসনামলের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, এবং প্রশাসনিক নির্যাতনের যে ধারাবাহিকতা ছিল, তা যদি থামাতে না পারে নতুন সরকার, তবে পতনের প্রভাব খুব বেশি ফলপ্রসূ হবে না। হাসিনার পতন স্বস্তির নিঃশ্বাস আনলেও, জনগণের জন্য বাস্তবিক মুক্তির দরজা কি খুলেছে? সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও অস্পষ্ট। জনগণের চাওয়া ছিল সুষ্ঠু নির্বাচন, স্বাধীন গণমাধ্যম, এবং রাজনৈতিক মত প্রকাশের স্বাধীনতা—এই চাওয়া পূরণ না হলে কেবল একটি নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই ইতিহাসের পাতা আবারও ঘুরে যাবে।

 

যারা হাসিনার পতনের জন্য আন্দোলন করেছে, তাদেরও নিজেদের মেরুদণ্ড মজবুত করতে হবে। কারণ, যদি তারা আবারও পুরোনো খেলা খেলে, তাহলে দেশের রাজনৈতিক চিত্র আগের মতোই থেকে যাবে। তাই, এই রাজনৈতিক দলগুলোকে এবার শুধুমাত্র বিরোধিতা নয়, কার্যকরী সমাধান এবং ভালো শাসনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। না হলে হাসিনার পতন শুধু একটি নতুন নামে নতুন স্বৈরতন্ত্রের উত্থান ঘটাবে।

 

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের অধিকারই হলো সর্বোচ্চ শক্তি। হাসিনার পতন সেই শক্তিকে পুনর্জাগরণ করার সুযোগ দিয়েছে, তবে এই সুযোগকে যদি নতুন শাসকরা ভালোভাবে কাজে লাগাতে না পারে, তাহলে এটা একদমই বৃথা হয়ে যাবে। একটি রাষ্ট্রকে শুধুমাত্র শাসন করা নয়, পরিচালনা করা দরকার, যেখানে জনগণের কথা শোনা হবে, গণতন্ত্র ফিরে আসবে, এবং প্রশাসন হবে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে পরিচালিত।

 

যদি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করা না যায়, তবে আবারও জনগণ তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে নতুন শাসকদের পদচ্যুত করবে। সেই চক্রাকারে নতুন নেতা আসবে, পুরোনো গল্প আবারও ফিরে আসবে। হাসিনার পতন যেন শুধু একটি গল্পের শেষ না হয়, বরং নতুন এক অধ্যায়ের শুরু হয়, যেখানে সত্যিকারের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও উন্নতির আশা করা যায়।

 

এখন প্রশ্ন হলো, এটা কি পুনরুজ্জীবন না পুনরাবৃত্তি? আমরা কি সেই দিনটির অপেক্ষায় থাকবো, নাকি নতুন নেতৃত্বকে তাগিদ দিবো সঠিক পথে চলার জন্য? ইতিহাস মনে রাখবে সেই নেতৃত্বকে, যারা জনগণের আশা পূরণ করতে পেরেছে। কিন্তু ইতিহাস তাদেরকেও ভুলবে না, যারা স্বৈরতন্ত্রের চেহারা বদলে এক নতুন মুখোশ পরে একই পথ ধরেছে।

ধরা যাক, আপনি একজন হিপহপ আর্টিস্ট। আপনার ঢোলা প্যান্ট, স্নিকার্স, আর ঢুলে টুপি পরে রাস্তায় বেরিয়েছেন। এমন সময় এল একদল সংস্কৃতি রক্ষাকারী ‘ফ্যাশন পুলিশ,’ যারা একদম গর্জন করে বলে উঠলো, “এই যে, তোমার প্যান্ট কি মেপে বানাওনি নাকি? এত ঢোলা কেন? এতে তো আমাদের সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে!”

 

আপনার কাছে মনে হলো, হিপহপ তো স্রেফ সেলফ-এক্সপ্রেশনের একটা স্টাইল, কিন্তু তাদের মতে ঢোলা কাপড় পরা মানেই জাতির মানসম্মান হানি! ঢোলা প্যান্টে কি বাতাস ঢুকে যাচ্ছে, না কি তা জাতির পতাকায় ধুলা লাগিয়ে দিচ্ছে, কে জানে! কিন্তু এই নিয়ে আলোচনা এমন হবে, যেন আপনি ভুলে ‘দেশের জাতীয় পোষাক’ এড়িয়ে ঢোলামালা কিছু পরে ফেলেছেন।

আরেকটা উদাহরণ নিই। আপনি কোনো বন্ধুর কাছে বলেন, “আমাদের একটু পেপার শেয়ার করো তো!” এ কথা শুনে তিনি রীতিমত রিসার্চ পেপারের ফোল্ডার খুলে বসে গেলেন। কিন্তু যখন আপনি তাকে আপনার ছোট্ট জয়েন্টটা দেখালেন, তখন তার মুখের সেই অভিব্যক্তি দেখলে বোঝা গেল, আপনি যেন জ্ঞানচর্চা বন্ধ করে অজ্ঞানতার পাপে ডুব দিয়েছেন!

 

তাদের মতে, পেপার মানেই রিসার্চ পেপার। মানে লম্বা-লম্বা রেফারেন্স, ইন-টেক্সট সাইটেশন, আর অতিমানবিক জ্ঞানার্জন। সেখানে আপনি যদি মজা করে একটা জয়েন্ট নিয়ে বললেন “এই পেপারটা সেয়ার করো,” তাতেই কালচারাল হাহাকার! তাদের মতামত, আপনি শিক্ষার জগৎকে এমন এক জগতে নিয়ে গেলেন, যেখান থেকে তারা কল্পনাও করতে পারে না।

 

এভাবেই কালচারাল ফ্যাসিজমের খপ্পরে পড়তে হয় আমাদের—একটু ঢোলা প্যান্ট পরলেই যদি সংস্কৃতির মানহানি হয়, আর ‘পেপার’ বলতে জয়েন্ট পেপার বুঝলেই যদি শিক্ষা ব্যবস্থার পতন ঘটে, তবে আমরা তো সবসময়ই বিপদে। কিন্তু সত্যি বলতে, সংস্কৃতির মজাটা তো এই বৈচিত্র্যেই! তাই ‘ফ্যাশন পুলিশ’ বা ‘পেপার গুরু’ যাই বলুক না কেন, আপনি আপনিই থাকুন। কারণ দিন শেষে, সংস্কৃতি আমাদের আত্মার প্রকাশ, এটাকে আঁটো করে ফেলা মানে নিজের খোলসেই বন্দি হয়ে যাওয়া।