আওয়ামী লীগ এক ঝাঁক পিশাচদের দল। এ কথা আমি সবসময় বলি। পিশাচদের কোনো মানবিকতা থাকে না, বিবেকবোধ থাকে না, থাকার তো কথা নয়, কারণ পিশাচরা তো মানুষ না। আওয়ামী লীগ ও ঠিক দল হিসেবে মানুষদের সংগঠন নয়, এটা বিভিন্ন শ্রেণীর পিশাচদের একটা ক্লাব। এখানে সকল ধরনের মানবরুপি পিশাচ খুঁজে পাওয়া যাবে। আজকে আওয়ামী লীগের আত্ম অহং এবং দল হিসেবে তারা কেন পিশাচ এই কথায় বলবো।
একথা তো আমরা সকলে বুঝি ক্ষমতা পেলে মানুষ সবসময়ই আমি আমি করে এটা কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য। কখন কী হয় সেটা বুঝার ক্ষমতা অনেকেরই থাকে না। স্বাভাবিক ভাবেই নিচ্ছি বিষয়টাকে। ক্ষমতা আমার দৃষ্টিতে একটা ভ্রম ছাড়া আর কিছুই না।
কিন্তু নির্মম সত্য হলো- এই ভ্রমের ভ্রমণে চলে ইতিহাসের অনেক শাসক জনগণের বিরুদ্ধে চলে যায় এবং একটা বিশেষ সময়ে জনগণ ও তার বিরুদ্ধে চলে যায় আর শাসক ক্ষমতা হারায়। বাংলাদেশেও এমনটা হয়েছে সামনেও হতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ইতিহাস আছে ঠিক কিন্তু তার বেশিরভাগই কলঙ্কের। গণতন্ত্রের কথা বলে তারা কায়েম করেছে দশকের পর দশক কখনো বাকশাল কখনো ফ্যাসিবাদ। মোটা দাগে তারা বাকশালীই ছিলো। বাকশাল কায়েমটাই তাদের (শেখ পরিবারের) পারিবারিক স্বপ্ন। এটা কিন্তু বুঝতে হবে একাত্তরের পুর্বের আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবের একার ছিলো না কিন্তু একাত্তর পরবর্তী আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবের নিজস্ব সম্পত্তি ছিলো। যা উত্তরাধিকার সূত্রে হাসিনা পেয়েছে।
গত জুলাই মাসেই পতিত স্বৈরশাসক হাসিনা দেখিয়েছে তার সর্বোচ্চ পৈশাচিকতা। সে কত বড় পিশাচ হতে পারে তা এদেশের মানুষ স্বচক্ষে দেখেছে। এই দেখাতে পারাটাই এতদিনের গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা বাংলাদেশীদের সফলতা ছিলো। শেষ মেষ দেড় হাজারের বেশি রক্তের বিনিময়ে তার ঐতিহাসিক পতন হলো।
তবুও কিন্তু তাদের কোনো লজ্জা আমরা দেখি না। আওয়ামী লীগের কিন্তু কোনো রাজনীতি নাই, গত এক দশকে তো ছিলোই না। ২০১৪ তেই তার রাজনৈতিক মৃত্যু হয়েছিলো, দাফনের কাজ হয়তো ২৪এ হলো, তবুও এই সময়েও এখনো লজ্জা সমোলোচনা ছাড়া কেন এত মানুষ আওয়ামী লীগ করে?? কারণগুলো হলো, এক. এরা রাজনৈতিকভাবে অশিক্ষিত। দুই. অনৈতিকতা বা গুণ্ডামিকে পূজা করতে আপত্তি নাই। তিন. পরিবারের বা ব্যক্তিগত লোভের কারণে বা টাকার প্রয়োজনে। চার. মিথ্যা প্রপাগান্ডা, ইতিহাসের দলীয় বয়ান ও মিথ্যার উপর ঈমান রেখে বসে আছে। পাঁচ. এরা মানুষ না এরা পিশাচ। মোটাদাগে এগুলোই আসল কারণ।
এই পিশাচরা এত পচন তৈরি করে, এদের সাথে যারাই থাকে তাদের ও পচন এবং পতন অনিবার্য এরশাদ, বি চৌধুরী এমনকি শাহবাগি পরিণতিও আমরা দেখেছি। এ এমন এক মেশিন যার ভেতর যেই ঢুকবে সেই পিশাচ হয়ে বের হবে।
এবার একটু সরল কথায় আসি,
আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে অত্যন্ত লজ্জাস্করভাবে। দেশের অতি পুরাতন দলটি তার পতন ঠেকাতে পারেনি। পিশাচদের পতন এভাবেই হয়। পিশাচদের প্রধানসহ অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে কিংবা আত্মগোপনে রয়েছে। অনেকেই খুনসহ গুরুতর অপরাধের মামলায় আটক/আসামি হয়েছে।
ভোট চুরির বিচার হলে অনেক দিন নির্বাচনে উপযুক্ত প্রার্থীও পাওয়া কঠিন হবে দলটির। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ সহজে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। আওয়ামী লীগের এই করুণ পরিণতির জন্য দায়ী এর নেতৃত্ব। দলটি অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেনি। স্বাধীনতাত্তোর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ব্যাপকভাবে বিরোধী দল দমন, হামলা, মামলা, লুটপাট, দখল, মূল্যস্ফীতি (১৯৭৫ সালে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬৭.১৭%, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ) কিন্তু পরের বছর হয়েছিল ৮.৩৬%), গুম, খুন (রক্ষী বাহিনীর হাতে নিহত হয় ৩০ হাজার মানুষ বলে কথিত), জখম, ধর্ষণ, বাকস্বাধীনতাহরণ, গণতন্ত্র হত্যা, তামাশার নির্বাচন, ভোট ডাকাতি, দুর্ভিক্ষ, দুর্নীতি ইত্যাদি হয়েছিল (তার আগে ১৯৫৪ সালে যুক্তফন্টের ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে সংসদের ভেতরে দায়িত্ব পালনকালে পিটিয়ে হত্যা এবং দলের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানীকে বেধড়ক পিটিয়েছিল)। সেই একই অপকর্ম করেছে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে গত ৪ আগস্ট পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগারদের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি! বরং আগের চেয়ে পরে আরো বেশি অধোপতন হয়েছে! তাই পতন অনিবার্যই ছিল। তবে তা অনেক বেশি রক্তের বিনিময়ে হয়েছে। হঠাৎ করেই পতন হবে সে ধারণা ছিল না পশ্চিমাদের, বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল, প্রকৃত গণতন্ত্র ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের পরাজয় হবে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের চরম লজ্জাজনকভাবে পতন হবে সে ধারণা ছিল না। এমনকি দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যেও সে ধরনের আশংকা ছিল না। বরং তারা ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে বলে স্বপ্ন দেখেছিল। কথা-বার্তা বলতো এবং কাজকর্মও করতো সেভাবেই। কিন্তু নিয়তির পরিহাস বড় নির্মম। যেমন কর্ম তেমন ফল অনিবার্য, যা চিরন্তন সত্য। আওয়ামী লীগের পরিণতিও হয়েছে তাই। ক্ষমতাচ্যুত তো হয়েছেই, সে সাথে অস্তিত্ব রক্ষার সংকটেও পড়েছে! এই করুণ পরিণতির প্রধান কারণ হচ্ছে, স্বৈরতান্ত্রিকতা এবং একতরফা ও ভাওতাবাজির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকা!
তবুও আওয়ামী লীগের মাঝে আমরা লজ্জার ডিসকোর্স দেখি না। আমরা দেখি না তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে তাদের ভেতরের আলাপ আলোচনা কিংবা সমালোচনা। শত গুম, হাজার খুন, দূর্নীতি, দেশ বিক্রির চিরচেষ্টা, স্বৈরতন্ত্রের সামাজিকরণের চেষ্টা, ফ্যাসিবাদ কায়েম, বিরোধী মত ধ্বংস, সংবাদ মাধ্যম ধ্বংস, সমাজের সকল প্রতিষ্ঠানকে লীগকরণ, এত এত অপকর্মের কোনো আত্মসমালোচনা নেই। কারণ শুরুতেই বললাম আওয়ামী লীগ এক ঝাঁক পিশাচদের দল। পিশাচরা কখনো ক্ষমা চাই না, তাদের চির অহংকার এবং পৈশাচিকতা তাদের পতন নিশ্চিত করে চিরতরে।
যা’হোক, আওয়ামী লীগের পতন থেকে শিক্ষা নিতে হবে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে। বিশেষ করে ক্ষমতা এবং গণপ্রতিনিধিত্ব প্রত্যাশী দলগুলোকে। কারণ, রাজনৈতিক দলের বেশিরভাগ নেতা-কর্মী অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, সেকেলে শিক্ষায় শিক্ষিত ও বেকার। তাই তাদের অধিকাংশই রাজনীতিকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে। তারা অর্থ ছাড়া কোনো কিছুই করে না। তারা রাজনীতি ও দলের নাম ব্যবহার করে ব্যাপক চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতিসহ নানা অপকর্ম করে। কী করেন, বলে অনেককে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর পাওয়া যায়, ‘রাজনীতি করি’। অথচ, রাজনীতি কোনো পেশা নয়। এটা দেশ ও মানুষের সেবা করার একটা মাধ্যম। সেই সেবাকে এ দেশের অনেক মানুষ নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের হাতিয়ারে পরিণত করেছে এবং তা দিনদিন বাড়ছে। আবার এই শ্রেণির মানুষগুলো নেতা-নেত্রীর সর্বাধিক ভক্ত হওয়ার যাদুকরী কৌশল ব্যবহারের ওস্তাদ। যার অন্যতম হচ্ছে, চাটুকারিতা, কদমবুসি, মোসাহেবি, নানা ফরমায়েশি কাজ ইত্যাদি। এতে ঊর্ধ্বতন নেতা-নেত্রীরা খুশি হয় এবং ভক্তদের পদোন্নতি দেয় ইচ্ছামাফিক। তাতে পিছিয়ে পড়তে পড়তে যোগ্য ও দক্ষ তথা বরেণ্য শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, উদ্ভাবক তথা মেধাবী নেতা-নেত্রীরা রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছে। ফলে দেশের রাজনীতি মেধাহীন ও দুর্বৃত্তায়িত হয়েছে, তথা কলুষিত হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্র না থাকায় এই দৈনদশা সৃষ্টি হয়েছে, যার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে দেশের সব কর্মকান্ডে।
বর্তমান যুগ হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এবং বিশ্বায়নের যুগ। এসব ক্ষেত্রে যে বা যারা যত বেশি অগ্রগামী হচ্ছে তারা তত বেশি উন্নতি করছে। দেশ পরিচালনাকারি হচ্ছে রাজনীতিবিদরা। কিন্তু তারা যদি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, আধুনিক কর্মে দক্ষ এবং সৎ না হয়, তাহলে দেশ ও তার কাজ আধুনিক হবে না। সুশাসন ও ন্যায়বিচারও প্রতিষ্ঠিত হবে না। সার্বিক উন্নতি হবে না। ঋণ করে যেটুকু উন্নতি হবে তার সবটুকুর ভাগীদার হবে মুষ্টিমেয় কিছু লোক। তারা আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে যাবে রাতারাতি। বাংলাদেশে সেটাই হয়েছে। আয় বৈষম্য বিশ্বের সর্বাধিক হয়েছে! তাই দেশের রাজনীতিকে আধুনিক, দুর্বৃত্তায়ন মুক্ত ও গণতান্ত্রিক করতে হবে। দক্ষ, যোগ্য ও সৎ লোকদের প্রাধান্য দিতে হবে দলের নেতৃত্বে। সর্বোপরি রাজনৈতিক দলগুলোতে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আওয়ামী লীগের পতন থেকে বিএনপির শিক্ষা নেওয়া দরকার বেশি। কারণ, এ দলটি দেশের বৃহত্তম দল। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপি বিপুল ভোটে জয়ী হবে নিঃসন্দেহে, যা কট্টর আওয়ামী লীগাররাও বিশ্বাস করে এবং বলে। উপরন্তু আওয়ামী লীগের পতনত্তোর নির্বাচনে বিএনপির বিজয়ের সম্ভাবনা আরো অনেক বেড়েছে। তাই সম্প্রতি বিএনপিতে যোগদানের হিড়িক পড়ে যেত যদি যোগদানের দরজা বন্ধ করে দেওয়া না হতো। এ অবস্থা শুধু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, শিক্ষিত এবং প-িতদের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।
পুরাতন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বামপন্থীরা চরম ব্যাকফুটে গেছে। বিশ্ব থেকে সমাজতন্ত্র বিদায় নেওয়ার পর থেকেই তাদের দুর্দশা শুরু হয়েছে আর্থিক সহায়তার অভাবে। সেই কারণে আগামীতেও তাদের দুর্দশা আরো বাড়বে। কারণ, দলে নতুন রিক্রুট নেই তেমন। সমাজতন্ত্র বিদায়ের পর পুঁজিতন্ত্র জেঁকে বসেছে বিশ্বব্যাপী। কিন্তু তাতে অধিকাংশ মানুষের ভাগোন্নয়নের পরিবর্তে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের ভাগোন্নয়ন হচ্ছে। তাই সাধারণ মানুষ পুঁজিতন্ত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তাদের অনেকেই বিকল্প হিসাবে ইসলামীতন্ত্র নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে, যার ঢেউ বাংলাদেশেও লেগেছে। ফলে দেশে ইসলামপন্থীদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তবে তাদের দলের সংখ্যা অধিক হওয়ার কারণে তারা রাজনীতিতে তেমন শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এই অবস্থায় দেশের মধ্যপন্থী বলে খ্যাত বিএনপিই বৃহৎ দল হয়ে রয়েছে। আওয়ামী লীগ যা যা করেছে রাজনৈতিক ভাবে বিএনপির উচিত তার উল্টো পথে এন্টি ফ্যাসিস্ট উদারপন্থী মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করা তবেই বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে পৈশাচিকতার পতন হবে এবং বাংলাদেশ পন্থী রাজনীতির জয় জয়কার হবে।