বাংলাদেশের নাগরিকও নন, তিনি মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা। থাকার কথা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। কিন্তু তিনি মোচনীপাড়ায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বড় এজেন্ট। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মোবাইল ফোন অপারেটরের নিবন্ধিত সিম দরকার হলেও সেই নিবন্ধন বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের কোনো নাগরিকের পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু রোহিঙ্গা হয়েও শফি আলম তা পেলেন কীভাবে এবং এত টাকার লেনদেনের নেপথ্যেই বা কী?— এমন প্রশ্ন সচেতন মহলের।
জানা গেছে, বেশি লেনদেনের কারণে শফি সেরা এজেন্টের পুরস্কারও পেয়েছেন মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে। গত কয়েক মাসে তার এজেন্ট নম্বরের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে অন্তত অর্ধকোটি টাকা। এজেন্টদের মধ্যে ওই এলাকায় তিনি বেশ প্রভাবশালী। শুধু শফি আলম নন, বিপুল পরিমাণ লেনদেনের কারণে অসংখ্যবার পুরস্কারও পেয়েছেন সেখানকার অনেক স্থানীয় মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট।
টেকনাফ উপজেলার সীমান্তে জনবসতিও তুলনামূলক কম। বড় ব্যবসা-বাণিজ্যও নেই। তবুও টেকনাফে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে রেকর্ড পরিমাণ এই লেনদেনে আলোচনায় এলাকাটি।
তবে টেকনাফের সীমান্ত এলাকায় এই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অস্বাভাবিক পরিমাণ আর্থিক লেনদেনের নেপথ্যে মাদকের কারবারিরা বলে দাবি করছেন ওই এলাকার একাধিক মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট। মাদকের অবৈধ টাকা লেনদেনে এই এলাকায় গড়ে উঠেছে শক্তিশালী মোবাইল ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক। এর প্রায় পুরো নিয়ন্ত্রণও রোহিঙ্গাদের হাতে।
মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে টেকনাফে স্ত্রীসহ আশ্রয় নিয়েছিলেন শফি আলম। এখন তিনি দুই সন্তানের বাবা। তাদের পুরো পরিবারই জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত। কাগজপত্র অনুযায়ী শফি আলম পরিবার নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকার কথা। কিন্তু তিনি এখন মোচনীপাড়ায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বড় এজেন্ট!
এজেন্ট হিসেবে শফি আলম যে লাইসেন্স ব্যবহার করছেন, সেটি হ্নীলার মোচনীপাড়া ‘মুফিজ ক্রোকারিজ’নামে নিবন্ধিত। ট্রেড লাইসেন্সও রয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানের। এটির মালিক মুফিজ আলম। তিনি (মুফিজ আলম) বলেন, আমি বিকাশ এজেন্টের নিবন্ধন নিয়েছি। নিজের ক্রোকারিজ দোকানের জন্য এটা করলেও এখন সক্রিয় নয়। এমনকি শফি আলমকে চেনেন না বলেও দাবি করেন তিনি।
জানা গেছে, শফি ছাড়াও ওই এলাকায় অন্তত ৭ রোহিঙ্গা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তারা স্থানীয় লোকজনের নামে শত শত মোবাইল সিম নিবন্ধন করে এই বাণিজ্য করে আসছে। তারা গোটা এলাকায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লেনদেন করে আসছে। তাদের দাপটে স্থানীয় সাধারণ মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টরাও কোণঠাসা।
টেকনাফ এলাকার একাধিক মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টরা জানান, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাদক পাচার শেষে পুরো প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। শুধু টেকনাফ নয়, কক্সবাজার, নাইক্ষ্যংছড়ি বা মিয়ানমার সীমান্তের যে কোনো জেলা থেকেই মাদক সরবরাহ করা হোক না কেন, তার মূল্য মোবাইলের মাধ্যমে টেকনাফের এজেন্টদের কাছেই আসে। সেজন্য টেকনাফ কোনো বাণিজ্যিক বা গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা না হয়েও মোবাইল লেনদেনে প্রায়ই সারা দেশে সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকে।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মাদকের টাকা লেনদেনের কথা স্বীকার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মজিবুর রহমান পাটওয়ারী বলেন, টেকনাফের মতো একটি ছোট উপজেলায় এত বড় বড় অঙ্কের লেনদেন সন্দেহজনক। বিভিন্ন সময় তদন্তে এবং আসামি ধরতে গিয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি উঠে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে কথাও বলেছি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্রগুলো বলছে, সম্প্রতি টেকনাফ এলাকায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন বেড়েছে আগের চেয়ে বহুগুণে। আপাতদৃষ্টিতে ইতিবাচক মনে হলেও অস্বাভাবিক এ অর্থপ্রবাহ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কারণ টেকনাফে লবণ, সুপারির ব্যবসা এবং বন্দরকেন্দ্রিক কিছু বাণিজ্য হয়। কিন্তু সেগুলোর তুলনায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন হচ্ছে অনেক বেশি।
তবে টেকনাফ উপজেলায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মাদক চোরাচালানে বড় অঙ্কের টাকা লেনদেনের বিষয়ে অবগত নন বলে জানান বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নির্বাহী পরিচালক মাসুদ বিশ্বাস। তিনি বলেন, বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে সামনে এলে আমরা অবশ্যই তদন্ত করব।