মব জাস্টিসের নামে কেউ অন্যায়-অবিচার করলে তাকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম।
শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সম্মেলন কক্ষে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরেকটি অপরাধ হচ্ছে মব জাস্টিস। ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রামেও একটি ঘটনা ঘটেছে। যেখানে গান গাইতে গাইতে একজনকে মেরে ফেলা হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে কিন্তু আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা অপরাধচক্রের একজনকে গ্রেপ্তার করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যারা ঘটনা ঘটিয়েছিল, ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে তাদের স্টেটমেন্ট নিয়েছি। সবার নাম-ঠিকানা সবকিছু পাওয়া গেছে বাকিদের গ্রেপ্তারের অভিযান অব্যাহত আছে। আমরা একটা বিষয় পরিষ্কার করতে চাই- মব জাস্টিসের নামে কেউ আইন হাতে তুলে নেবেন না। কোথাও না। তাহলে যার প্রতি আপনি মব জাস্টিসের নামে অন্যায়-অবিচার করলেন, সে অপরাধে আপনাকে ছাড় দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। আমরা বিষয়টি ইতিমধ্যে কঠোরভাবে দেখছি।
মামলায় সাংবাদিকদের চেয়ে পুলিশের সংখ্যা বেশি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যেসব মামলা হচ্ছে সেখানে পুলিশ সদস্যর সংখ্যা সাংবাদিকদের চেয়ে অনেক বেশি। অনেক ক্ষেত্রে বিজিবি, ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারদের আসামি করা হয়েছে। আমরা পুলিশকে বলেছি, থানায় মামলা রেকর্ড করার আগে যাচাই-বাছাই করে দেখে নেওয়ার জন্য। যারা মামলার বাদী তারা আমাদেরই সমাজেরই একটি অংশ। যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদেরকে আসামি করলে মামলাগুলো কিন্তু সত্য হয়। মামলার ভিত্তি মজবুত হয়। মামলার তদন্ত করাও সহজ হয়।
‘মামলা হলেই কেউ আসামি হিসেবে গ্রেপ্তারের আওতায় আসবে সেটা কিন্তু আইন বলে না। যেসব মামলায় সাংবাদিক, পুলিশসহ সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আছেন সেগুলো আমরা বিশ্লেষণ করব। এটা নিয়ে একটি কমিটিও হয়েছে। ওই কমিটি এটা নিয়ে কাজ করছে। আপনারা যদি নিরীহ, নিরপরাধ হয়ে থাকেন তাহলে আপনাদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। ভীত হওয়ার কোনো কারণ নেই।’
পুলিশের সকল ইউনিটের কার্যক্রম শুরু হয়েছে জানিয়ে পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে অনেকেই জীবন দিয়েছেন। সেখানে আমাদের পুলিশের ৪৪ জন সদস্য শহিদ হয়েছেন। প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন আহত হয়েছেন। আমি দায়িত্ব গ্রহণ পর চেষ্টা করেছি পুলিশের সকল ইউনিটকে সক্রিয় করা এবং যে সদস্যরা মনোবল হারিয়েছে তাদেরকে বিভিন্নভাবে কাজের পরিবেশ ফিরিয়ে দেওয়ার। সকল ইউনিটে অপারেশন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ পুরোপুরি কার্যকর আছে।’
‘যেসব পুলিশ সদস্য আমাদের মাঝে নেই তাদের আত্মদানের যথাযথ প্রতিদান হবে আমাদের কাজের মাধ্যমে। আমরা যদি সঠিকভাবে কাজ করতে পারি তাহলে জনগণের সঙ্গে পুলিশের যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে সেটা আর থাকবে না।’
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সংঘটিত প্রত্যেকটি হত্যার বিচার হবে জানিয়ে ময়নুল ইসলাম বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রত্যেকটি মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত ও বিচার করা হবে। জাতিসংঘের একটি দল এটা নিয়ে কাজ করছে। তারা বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে। প্রত্যেকটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে সঠিক বিচার করতে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক।’
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী সকল অপতৎপরতা রুখে দেওয়া হবে জানিয়ে তিনি আরও বলেন,’সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী আছে যারা এটার বিপক্ষে কাজ করছে। কোনো ধরণের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী ঘটনা এ দেশে ঘটবে না। এদেশ সকল মানুষের, সকল বাঙালির। এদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিস্টান সবার। যারা এদেশের নাগরিক তাদের প্রতিটি বিষয়ে সমান অধিকার আছে। এটা সংবিধান স্বীকৃত। আইনি কাঠামো দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী সকল অপতৎপরতা আমরা রুখে দিতে চাই।’
আসন্ন দুর্গাপূজায় পুলিশের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে জানিয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক ময়নুল ইসলাম বলেন, ‘সামনে সনাতন ধর্মাবলম্বী ভাইদের দুর্গাপূজা উৎসব। এ উৎসব তারা আনন্দের সঙ্গে পালন করবে। সেখানে আমাদের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। কেউ যাতে সেখানে কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটাতে না পারে সে ব্যাপারে আমরা সজাগ আছি। যদি কেউ করতে চায় তাহলে তাকে কঠোর আইনের আওতায় আমরা নিয়ে আসব।’
‘জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য আমরা তৎপর। যারা জামিন পেয়েছে তাদের মধ্যে কেউ যদি আবার জঙ্গিবাদে জড়ায় তাকে আবার আমরা আইনের আওতায় আনব।’
৫ আগস্ট ও তার লুট হওয়া পুলিশের ৭৫ ভাগ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে আমাদের অস্ত্র উদ্ধার অভিযান শুরু হয়েছে। এবার অস্ত্র উদ্ধার অভিযান তিনটি পৃথক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলনের সময় গণভবন ও পুলিশের যেসব অস্ত্র লুণ্ঠিত হয়েছিল সেগুলো জমা দেওয়ার জন্য আমরা ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলাম। সে অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান চলছে।’
‘বিগত ১৫ বছরে অনেককেই অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে যারা অস্ত্র রাখার যোগ্য না। সে লাইসেন্স বাতিল করে সরকার অস্ত্রগুলো জমা দিতে বলেছিল। যারা জমা দেয়নি সেসব অস্ত্রগুলো ৪ সেপ্টেম্বর থেকে অবৈধ হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত আমরা ২৩৮টি অস্ত্র উদ্ধার করেছি। পুলিশের যে অস্ত্র লুট হয়েছিল তার মধ্যে ৭৫ ভাগ উদ্ধার হয়েছে। যারা অবৈধ অস্ত্র রাখবে বা কেনাবেচা করবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’
পুলিশের সংস্কার নিয়ে এক সাংবাদিকের করা প্রশ্নের জবাবে ময়নুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশের মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করে সেসব সদস্যদের পক্ষ থেকে যে ১১ দফা এসেছিল সেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। পুলিশের সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। সংস্কার তো একটি প্রক্রিয়া। এটা সময় লাগবে। পোশাক ও কাজের ঘণ্টার কথা এসেছে। অনেক কিছু মিলেই সংস্কারগুলো করতে হবে। পুলিশ হচ্ছে জনগণের বিশ্বাস। জনগণের সম্মতি ছাড়া পুলিশ কাজ করতে পারে না। প্রশিক্ষণও আমরা ঢেলে সাজাচ্ছি।’
এ সময় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান, সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ, অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) আবদুল মান্নান মিয়া ও চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবীব পলাশ।