ঢাকামঙ্গলবার, ২৪শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পাহাড়ে অশান্তির মূলে কারা, ইউপিডিএফ-জেএসএস নাকি পাহাড়ের শান্তিপ্রিয় মানুষ !

নিউজ ডেস্ক | সিটিজি পোস্ট
সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪ ১২:২৩ অপরাহ্ণ
Link Copied!

খাগড়াছড়ি সদরে গত বুধবার মামুন নামের এক বাঙালি যুবককে পিটিয়ে মারার ঘটনায় আবারও আলোচনায় এসেছে চার গ্রুপে বিভক্ত পাহাড়ের দুই আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফ এবং জেএসএসের অস্ত্র প্রদর্শনের বিষয়টি। চুরির ঘটনায় ওই যুবককে বেধড়ক পেটায় স্থানীয় পাহাড়ি যুবকরা। এরপর হাসপাতালে পাঠানোর পর সেখানে তার মৃত্যু হয়। 

 

ঘটনাটিকে পরিকল্পিত উল্লেখ করে এরপরপরই দীঘিনালায় বিক্ষোভ করেন বাঙালিরা। সেই ঘটনায় পাহাড়িরা বাধা দিলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই শুরু হয় সংঘাত, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া এবং আগুন দেওয়ার ঘটনা। সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে রাঙামাটিতেও। এখন পর্যন্ত ৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৬০/৭০ জন।

 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটিতে প্রকাশ্যে এসেছে অস্ত্র প্রদর্শনের বিষয়টি। পাহাড়ি যুবকদের অনেকের হাতেই দেখা গেছে ছোট বড় আগ্নেয়াস্ত্র এবং ধারালো ছুরি। এসব উচ্ছৃঙ্খল যুবকরা এতোটাই বেপরোয়া ছিলেন যে, পাহাড়ে নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও অস্ত্র দেখিয়ে জিম্মি করে রাখেন। বেশ কিছু ছবি এবং ভিডিও ফেসবুকেও ভাইরাল হয়েছে।

 

প্রশ্ন উঠেছে, পাহাড়ে ছোট বড় যে কোনো ঘটনায় মুহুর্তে এসব অস্ত্র আসছে কোথা থেকে? স্থানীয় বেশ কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, একাধিক গ্রুপে বিভক্ত পাহাড়ের দুই আঞ্চলিক গোষ্ঠী ইউপিডিএফ এবং জেএসএসের কর্মীদের অনেকেই পাহাড়ি যুবকদের অস্ত্রের জোগান দিচ্ছেন। বছরজুড়ে চাঁদাবাজি আর আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত দল দুটি এখনও সুযোগ পেলে একে অপরের বিরুদ্ধে মরণ খেলায় মেতে উঠছে। কখনও স্থানীয় বাঙালিদের ভয় দেখিয়ে, কখনও নিজের গোষ্ঠীর লোকদের হত্যা করে তারা নিজেদের টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে আছেন।

 

গণমাধ্যম এবং স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির পর ২০২৪ সাল পর্যন্ত ইউপিডিএফ এবং জেএসএসের হাতেই পাহাড়ে মারা গেছেন অন্তত ১২০০ জনের বেশি। কেবল ২০১৫ সাল পর্যন্তই মারা গেছেন ৬০০।

 

রাঙামাটির দুর্গম বাঘাইছড়ি উপজেলার বঙ্গলতলী ইউনিয়নের বাসিন্দা ধীমান চাকমা বলেন, পাহাড়ে আমরা শান্তি চাই। হানাহানি কাম্য নয়। আঞ্চলিক দলগুলো পাহাড়ের মানুষের সমস্যা নিয়ে কাজ করার চেয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এখন বেশি ব্যস্ত।

 

চলতি বছরের গত ৭ আগস্ট রাঙামাটি শহরে জেএসএস-ইউপিডিএফের সংঘর্ষের সময় দুই নেত্রীকে অপহরণের অভিযোগ ওঠে প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের (একাংশ) বিরুদ্ধে। সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সহযোগী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন। এই সংগঠনের দুই নেত্রী ছিলেন রাঙামাটি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সুষ্টি চাকমা ও তথ্য ও প্রচার সম্পাদক কাঞ্চনমালা চাকমা।

 

জেএসএসের ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) এর কেন্দ্রীয় তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক অন্বেষ চাকমা নিজেই ওই সময় জানতে চাইলে জানান, দেশীয় অস্ত্রের মুখে ইউপিডিএফ (প্রসিত গ্রুপ) এর কর্মীরা তাদের অপহরণ করে নিয়ে যায়।

 

পাহাড়ে এই দুই দলের নেতা-কর্মীদের হাতে অস্ত্র এখন এতোটাই সহজলভ্য হয়ে গেছে যে, যখন তখন বাসায় ঢুকে গুলি করে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের গত ২৭ জুলাই খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় বাসায় ঢুকে জুনেল চাকমা (৩১) নামে এক যুবককে হত্যা করা হয়েছে। তিনি ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের তারাবুনিয়া এলাকার সংগঠক ছিলেন। ঘটনার দিন ভোর আনুমানিক ৪টার দিকে প্রতিপক্ষের অস্ত্রধারীরা ঘরে ঢুকে তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়।

 

তবে এসব ঘটনায় বরাবরই একে অপর পক্ষকে দোষারপ করে দায়িত্ব সারছেন পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলো। ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের জেলা সংগঠক অংগ্য মারমা বলেন, সংস্কারপন্থি (জেএসএস সংস্কার) এবং নব্য মুখোশ বাহিনীর (ইউপিডিএফ সংস্কার) সন্ত্রাসীরা সবসময় নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে এই ধরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। আমাদের দল সবসময় পাহাড়ের মানুষের পাশে ছিল, সামনেও থাকবে।

 

অন্যদিকে গত কয়েকদিনে খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটির বর্তমান সংঘাতের পেছনে ইউপিডিএফকে দায়ি করেছেন জেএসএসের রাঙামাটি জেলা শাখার সভাপতি ডা. গঙ্গা মানিক চাকমা।

 

তিনি পাহাড়ে বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের নামে ইউপিডিএফ তাদের দেশি-বিদেশি ইন্ধনদাতাদের টাকায় সাধারণ পাহাড়ি ছাত্রদের দিয়ে এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে বলেও দাবি করেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাথে মতবিনিময় সভায় প্রকাশ্যে এই কথা বলেন তিনি। এই সময় গঙ্গা মানিক চাকমা পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে জেলা পরিষদ সমূহের নির্বাচন, স্থানীয় পুলিশ বাহিনী গঠনসহ শান্তিচুক্তির মৌলিক ধারাগুলো বাস্তবায়নের কথা জানান।

 

এদিকে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর অস্ত্রের ঝনঝনাতি ভীত বসবাসরত বাঙালিরা। ১৯৯৬ সালে রাঙামাটির লংগদুতে ৩৫ কাঠুরিয়াকে হত্যা করা হয়। প্রতি বছর এই হত্যাকান্ডের বিচার চেয়ে আসছেন সেখানকার বসবাসরত বাঙালিরা। পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, আমাদের দেশ একটি। আমরা সবাই বাংলাদেশি। অথচ তারপরও স্বাধীন একটি দেশে এখনও আতংকে রাত কাটাতে হয় পাহাড়ের বাঙালিদের।

 

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ও সম্প্রীতি রক্ষায় সশস্ত্র অবৈধ অস্ত্রধারী ও দেশদ্রোহী সন্ত্রাসী সংগঠন জেএসএস ও ইউপিডিএফকে নিষিদ্ধ করার কোনো বিকল্প নেই।