ঢাকাসোমবার, ১৬ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

জিয়ার খাল খনন এবং বৃক্ষরোপণ রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় 

মতামত ডেস্ক | সিটিজি পোস্ট
আগস্ট ২২, ২০২৪ ৩:৪৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

৭১ এর স্বাধীনতাযুদ্ধ, সেনাবাহিনী ও রাজনীতির এক বহুমুখী চরিত্র জিয়াউর রহমান। সবার আগে জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে জিয়ার রাজনৈতিক পরিচয় ও ঘটে এদেশের মানুষের কাছে। 

রাজনীতিবিদ জিয়াউর রহমান সম্পর্কে অনেক ক্রিটিক আছে তবে এটা মানতে হবে জিয়া এসেছিলেন এক বিশেষ সময়ে। সেনানিবাস থেকে বিশেষ প্রয়োজনে ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসেন জিয়াউর রহমান। এটা তিনি জানতেন। কিন্তু একপর্যায়ে তিনি সামরিক পরিচয় মুছে ফেলে গণমানুষের রাজনৈতিক নেতায় পরিণত হন।

এর মূল কারণ হচ্ছে, জিয়াউর রহমানের আমলে বাস্তবায়ন করা বিভিন্ন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচি। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। খাল খনন, গণশিক্ষা, গ্রাম সরকার, ভিডিপির মতো বিভিন্ন কর্মসূচিতে নাগরিকদের সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে। গ্রাম বা গণমানুষকে ভিত্তি করে বিভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে।

 

অর্থনীতি ও কৃষিতে আমূল পরিবর্তন করা হয়েছে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ধারণা প্রয়োগের প্রথম ধাপে কৃষিতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছিল। দেশের ইতিহাসে ওই সময়কে সবুজ বিপ্লবের কাল বলে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি সামরিক খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা হয়। সামরিক বাহিনীকে ঢেলে সাজানো হয়।

খাল খনন কর্মসূচি দিয়ে জিয়াউর রহমানের পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনাকে বিশ্লেষণ করা যায়।

জিয়াউর রহমান এমন এক সময় ক্ষমতায় এসেছিলেন, যখন বিশ্বে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হচ্ছে হচ্ছে অবস্থা।

১৯৭২ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রথম স্টকহোমে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে জলবায়ু, প্রকৃতি ও দূষণকে সংকট হিসেবে বিবেচনা করে বহুপক্ষীয় উদ্যোগের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়।

সম্ভবত জিয়াউর রহমান সমকালীন বিশ্বরাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এ জন্যই তাঁর বিভিন্ন কর্মসূচিতে প্রকৃতি ও পরিবেশবান্ধব চিন্তার উপস্থিতি জন্য করা যায়।

গত এপ্রিলে বয়ে যাওয়া দাবদাহের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জলাধার কমে যাওয়া ও অবাধে গাছ কাটাকে দায়ী করেছেন। গরমে হাঁসফাঁস করে আমরা এখন জলাধার ও বৃক্ষ রক্ষার জন্য হাহাকার করছি।

খাল খনন কর্মসূচি দিয়ে জিয়াউর রহমানের পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনাকে বিশ্লেষণ করা যায়। দেশের অন্যতম সফল ও আলোচিত এক গণমুখী সামাজিক কর্মসূচি হচ্ছে খাল খনন কর্মসূচি এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি।

 

জিয়াউর রহমান প্রাকৃতিক জলাধার সৃষ্টির লক্ষ্যে সারা দেশে খাল খনন কর্মসূচি শুরু করেন। সমাজকে সংগঠিত করার এক অনন্য নজির হচ্ছে খাল খনন কর্মসূচি। এই কর্মসূচির মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করা হয়েছিল। আপাতদৃষ্টে এই কর্মসূচিকে শুধুই খাল খনন মনে করা যায়।

 

কিন্তু এই কর্মসূচির বহুমুখী উদ্দেশ্য ছিল, যেমন কৃষিতে সেচ নিশ্চিত করা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা।

 

সারা দেশে খাল খনন করে প্রাকৃতিক জলাধার নির্মাণের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির পরিবর্তে উপরিভাগের পানির ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। শুষ্ক মৌসুমে এসব খালের পানি সেচকাজে ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়া খালগুলোতে মাছের উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়।

 

১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সালের মে মাস পর্যন্ত সারা দেশে দেড় হাজারের বেশি খাল খনন করা হয়। দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ হাজার কিলোমিটার খাল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খনন ও পুনঃখনন করা হয়। খাল খনন ছিল একধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লব। এর ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী একতাবদ্ধ হয়েছিল। দল বেঁধে খাল খনন করা তাদের বিভিন্ন সামাজিক কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

 

খাল খননের সরাসরি প্রভাব পড়েছিল কৃষিতে। খালের মাধ্যমে কৃষিতে সেচ দেওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এটা অপেক্ষাকৃত স্বল্পমূল্যের সেচসুবিধা ছিল কৃষকদের জন্য। ফলে অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যয় বহন করতে হয়নি কৃষকদের। ১৯৭৪ থেকে ৭৫ সালে মোট ৩২ লাখ ২ হাজার ২৫০ একর জমি সেচের আওতায় ছিল। এর মধ্যে ১৫ লাখ ৩৯ হাজার ১৩০ একর জমিতে পাওয়ার পাম্প ও টিউবওয়েলের মাধ্যমে সেচ দেওয়া হতো। আর ১৬ লাখ ৬৩ হাজার ১২০ একর জমিতে প্রচলিত পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া হতো। খাল থেকে সেচ দেওয়া হতো মাত্র ২ লাখ ৯৩ হাজার ৮৪০ একর জমিতে। ১৯৮১ থেকে ৮২ সালে দেশে মোট সেচের আওতায় আসা জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪০ লাখ ৬৪ হাজার ৩৩৭ একর। ওই সময় খাল থেকে সেচ দেওয়া জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ লাখ ৩ হাজার ৫১৫ একর।

 

শুধু সেচের আওতাই বৃদ্ধি নয়, গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্যসহায়তারও পথ খুলে দিয়েছিল খাল খনন কর্মসূচি। কার্যত খাল খনন কর্মসূচি একসঙ্গে অনেকগুলো সাফল্য অর্জনের একটি পরিকল্পিত কর্মসূচি ছিল। এর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। আগেই বলা হয়েছে কৃষিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। এ ছাড়া ওই সময় দেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ কার্যত বেকার বসে ছিল।

 

দারিদ্র্যের হার ছিল বেশি। তাদের দ্রুত খাদ্যসহায়তা ও কর্মসংস্থানের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সরাসরি ভর্তুকি সহায়তা দেওয়ার মতো সংগতি দেশের ছিল না। এ ক্ষেত্রে খাল খনন কর্মসূচি ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।

 

প্রথম এই কর্মসূচিতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামরিক বাহিনীর সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী—সবাই অংশ নিয়েছিলেন। এর পাশাপাশি গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যাঁরা খাল খনন করেছেন, তাদের খাদ্যসহায়তা হিসেবে গম দেওয়া হয়েছিল। এতে করে ওই সময় কিছুটা হলেও খাদ্যসংকটের সমাধান হয়েছিল।

 

এমনকি একসময় কৃষিজমির আল বা বিভাজনও তুলে দেওয়ার কথা জিয়াউর রহমান বলেছেন। অনেকেই মনে করেন, দেশে কৃষি খাতে যৌথ খামারপদ্ধতি শুরু করার পরিকল্পনা ছিল। জিয়াউর রহমান সরাসরিই কৃষি সমবায়ের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে উদার অর্থনীতির সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থার সমন্বয়ের চিন্তাও থাকতে পারে।

 

এ ধরনের গণভিত্তিক উৎপাদনপ্রক্রিয়া সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে দেখা যায়। তবে ওই সময়ের সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে এসব সরকারি নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের কঠোর সরকারি পর্যবেক্ষণপদ্ধতি বজায় রেখে স্থানীয় জনসাধারণের হাতে এসব ছেড়ে দেওয়া হয়। জিয়াউর রহমান পুঁজিবাদের চরম মুনাফামুখী আচরণ বা সমাজতন্ত্রের অতি কঠোর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে সরে এসে পশ্চিম ইউরোপীয় ঘরানার মডেল অনুসরণ করেছিলেন।

 

জিয়ার বৈপ্লবিক ধারার এ অর্থনৈতিক কাঠামোর কারণে দেশের শিল্প ও কৃষি খাতে পরিবর্তন জন্য করা যায়। মূলত পশ্চিম ইউরোপীয় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ঘরানার মডেল অনুসরণের কারণেই জিয়ার এই কর্মসূচিগুলো অতি দূরদর্শী এবং জনমুখী।