১৮ নং পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ গত ৫ আগস্ট থেকে আত্নগোপনে রয়েছেন। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আওয়ামী লীগ কর্মী শাহ আলম খুনসহ বেশ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগে ফেঁসে যেতে পারেন বিতর্কিত এই কাউন্সিলর।
২০১৯ সালের ১১ মে চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থানার বজ্রঘোনার নিকটে মদিনা মসজিদ এলাকায় এক নারীকে ঘরে ঢুকে গুলি করা হত্যা করেন স্থানীয় সন্ত্রাসী ও আওয়ামী লীগ কর্মী হিসেবে পরিচিত শাহ আলম।
ওই ঘটনার দিন শনিবার (১১ মে) দিবাগত রাত ৩টার দিকে ওই এলাকার পেছনে কর্ণফুলী নদীর তীরে এক ‘কথিত’ বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় নিহত হন অভিযুক্ত যুবক শাহ আলম।
অপরাধীকে আইনের আওতায় না এনে কেন বন্দুকযুদ্ধের ‘নাটক’ সাজিয়ে বিচার বহির্ভূত হত্যা করা হয় সেটি নিয়ে সে সময় জনমনে প্রশ্ন উঠলেও পরিস্থিতির কারণ মুখ খুলতে সাহস করেনি কেউ।
তবে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড দিয়ে গণমাধ্যমের সোচ্চার ভূমিকা শুরুর পর চট্টগ্রামের গণমাধ্যমগুলো শাহ আলম হত্যাকান্ডের পেছনের ঘটনা তদন্তে নেমে পড়েছে।
ওই ঘটনার পেছনের গল্প দেখুন প্রতিবেদনে।
শাহ আলম কে?
স্থানীয়দের সবার কাছে শাহ আলম ১৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হারুনুর রশীদের কাছের লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এমনকি ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে হারুনুর রশীদের নির্দেশে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হুমকি দেন শাহ আলম। স্থানীয়দের মধ্যে বেশ কিছু বাসিন্দা এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
স্থানীয় কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, মূলত শাহ আলম বুবলি আক্তার নামে ২৮ বছর বয়সী এক নারীকে হত্যার পর তার রাজনৈতিক নেতা কাউন্সিলর হারুনুর রশিদকে ফোন দিয়ে বাঁচাতে বলেছিলেন। ওই সময় শাহ আলম এটি করা না হলে সে ইতিপূর্বে যত অপকর্ম করেছে সেগুলোর নির্দেশ দাতা হিসেবে হারুনুর রশিদের নাম গণমাধ্যম ও আইশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।
এ ঘটনায় নিজের অবস্থান নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়ে যান কাউন্সিলর হারুনুর রশিদ। তিনি এমন পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে তৎকালীন বাকলিয়া থানার বিতর্কিত থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীনের সহায়তা নেন।
ওসি নেজাম উদ্দীন সন্ত্রাসী শাহ আলমকে আটকের পরও শুধুমাত্র কাউন্সিলরকে বাঁচাতে ‘কথিত’ বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে হত্যা করেন। এই ঘটনাকে সাজানো সেটি ওই সময় জাতীয় দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনসহ বেশ কিছু দৈনিকে প্রচার হয়েছিল।
ঘটনার পর ওসি নেজাম উদ্দিন দাবি করেছিলেন, বন্দুকযুদ্ধে তিনিসহ চার পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। অথচ ওই ঘটনায় তাদের আহত হওয়ার কোন মেডিক্যাল সার্টিফিকেট চট্টগ্রাম পুলিশ সদর দপ্তরে জমা দেয়া হইয়নি বলে নিশ্চিত হয়েছে আমাদের প্রতিবেদক।
খোঁজ নেই কাউন্সিলর হারুনের
১৮ নং পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হারুনুর রশিদ মূলত ২০১৫ সালের চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ১৮ নং ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এর আগে বেশ কয়েকবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও হেরে গিয়েছিলেন তিনি। ২০১৫ সালে জেতার পর পূর্ব বাকলিয়ায় বিএনপি জামায়াতসহ সহ বিরোধী দলকে রীতিমতঁ কোনঠাসা করে ফেলেন এই কাউন্সিলর। এছাড়া আওয়ামী লীগের বাকি গ্রুপগুলোকেও নিজের সন্ত্রাসী বাহিনীকে দিয়ে নিজের অনুসারী বানিয়ে নেন।
ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সেক্রেটারি এবং সাবেক কাউন্সিলর জসিম উদ্দীন, সাবেক কাউন্সিলর ও প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতা আলহাজ্ব ইসহাকসহ প্রভাবশালী নেতারা চাপে পড়ে রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।
বাকলিয়া জুড়ে জায়গা দখল, স্বীকৃত সন্ত্রাসী ও ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগ নেতা এনামুল হক মানিকের মতো সন্ত্রাসীদেরকে দিয়ে দিয়ে প্রকাশ্যে ছত্রছাইয়া প্রদান করেন বিতর্কিত কাউন্সিলর হারুনুর রশীদ।
সবশেষ ২০২১ সালে অনুষ্টিত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন তিনি। তার ভয়ে ওয়ার্ডে তার বিরুদ্ধে কেউ নির্বাচনে অংশ নেবে এমন পরিস্থিতি ছিল না।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর সারা দেশের ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামেও বিক্ষুদ্ধ জনতা বিতর্কিত মেয়র ও কাউন্সিলরদের বাসা ও অফিসে হামলা চালিয়েছে।
চট্টগগ্রামের মেয়র রেজাউল করিমের বাসায় হামলার আগের তিনি পালিয়ে যান। পরবর্তীতে তাকে এবং আরেক বিতর্কিত কাউন্সিলর নুর মোস্তাফা টিনুকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেন হারুনুর রশিদ। নিজের আরেক ভাই বিএনপি নেতা আয়ুবের কারণে আপাতত জনরোষ আপাতত বেঁচে গেলেও আত্ন গোপনে আছেন কাউন্সিলর হারুনের।
ফেঁসে যাবেন ওসি নেজামও?
বাকলিয়া থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীনের অপকর্মের শেষ নেই। কাউন্সিলর হারুনের সাথে মিলে বাকলিয়ায় রীতিমত ত্রাসের রাজত্ব তৈরী করেছিলেন নেজাম উদ্দীন। এর আগে নগরীর কোতোয়ালী থানায়ও দায়িওত পালন করেন তিনি।
সবশেষ পটিয়া থানায় দায়িত্বে ছিলেন কিন্তু ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণে তাকে পটিয়া থেকে পিবিআইতে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে কাউন্সিলর হারুনের মতো পলাতক আছেন ওসি নেজাম উদ্দীনও।
শাহ আলমকে বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড এবং তার সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মদদদাতা হিসেবে ওসি নেজাম ও কাউন্সিল হারুন স্পষ্ট ফেঁসে যেতে পারেন।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুইজন সমন্বয়ক জানান, চট্টগ্রামে যেসব থানার ওসি এবং যেসব কাউন্সিলর খুন ও সন্ত্রাসের রাজত্ব তৈরী ও জমি দখলের সাথে জড়িত ছিলেন তাদের সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলোতে আসা ও সম্ভাব্য সব প্রতিবেদন আমলে নেয়া হবে বলে নিশ্চিত করেছেন একাধিক সমন্বয়ক।
এসব অভিযোগ ছাড়াও বাকলিয়া থানার কালা মিয়া বাজার এলাকায় গিয়াস উদ্দিন (৪০) নামে এক ব্যবসায়ী ও জামায়াত সমর্থককে খুনের ঘটনার বারবার কাউন্সিলর হারুনের নাম উঠে আসে। এটি নিয়ে বিস্তারিত থাকবে আমাদের দ্বিতীয় প্রতিবেদনে।
হারুনুর রশীদের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বারবার ছাড়িয়ে আনা ও ভূমি দস্যুতার অভিযোগ নিয়ে থাকবে তৃতীয় আরেকটি পর্ব।
- সব অভিযোগ ছাড়াও বাকলিয়া থানার কালা মিয়া বাজার এলাকায় গিয়াস উদ্দিন (৪০) নামে এক ব্যবসায়ী ও জামায়াত সমর্থককে খুনের ঘটনার বারবার কাউন্সিলর হারুনের নাম উঠে আসে। এটি নিয়ে বিস্তারিত থাকবে আমাদের দ্বিতীয় প্রতিবেদনে।
- হারুনুর রশীদের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বারবার ছাড়িয়ে আনা ও ভূমি দস্যুতার অভিযোগ নিয়ে থাকবে তৃতীয় আরেকটি পর্ব।