একদা বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়ায় রাজনৈতিক কার্টুনের চল ছিল। পত্রপত্রিকায় হরেক রকম কার্টুন দেখা যেতো। রফিকুন নবী (রনবী), শিশির ভট্টাচার্যরা সেসব ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে রাজনৈতিক অসংগতি তুলে ধরতেন মজাচ্ছলে। সমাজে ঘটা অন্যায় অথবা বৈষম্যের প্রতিচ্ছবিও ফুটে উঠতো সেসব কার্টুনে। পত্রিকায় রাজনৈতিক কার্টুন দেখার জন্য পাঠকেরাও যেন অপেক্ষা করতো। ব্যঙ্গচিত্র হলেও তা নিছক মজার খোরাক যোগাতো না, আঘাত করতো সমাজ ও রাষ্ট্রের বেদিমূলে। জনগণের মতামত তৈরিতে সহায়ক ভূমিকাও পালন করতো এসব রাজনৈতিক কার্টুন।
ফলত শাসক কিংবা শোষকের কাছে কার্টুন হয়ে উঠতো আতঙ্কের নাম। তারা ভয় পেতো এসব ব্যঙ্গচিত্রকে। তাই সেসব কার্টুন প্রকাশিত হওয়ার পর নিজেদের ভুল সামলে নেয়ার চেষ্টা করতো শাসকগোষ্ঠী। তাতে আখেরে দেশেরই লাভ হতো। কিন্তু মাঝে কয়েক বছর পত্রিকায় তেমন কোনো রাজনৈতিক কার্টুন দেখা যায়নি। মনে হচ্ছিল, এই ব্যঙ্গচিত্রের হিউমার সহ্য করতে পারছেন না সরকারপক্ষ। মনে হচ্ছিল, এক অদৃশ্য আদেশে রাজনৈতিক কার্টুন আঁকায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কেউ যেন। তখন শুধুমাত্র রাজনৈতিক কার্টুন আঁকার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্যাতনের শিকার হতে হয় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকেও।
সম্প্রতি বাংলাদেশে শত মানুষের রক্তের বিনিময়ে একটি অভ্যুত্থান ঘটেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে ‘স্বৈরাচার’ পতনের ১ দফা আন্দোলনে রূপ নেয়ার পর গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছাত্র-জনতা যখন রাজপথে, তখন শহর সেজেছিল গ্রাফিতির মোড়কে। দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছিলো মিছিলের গান অথবা স্লোগান। রঙমশাল থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছিলো শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের কথা। নির্বিচার হত্যার বিচার বা ক্ষোভের কথা। শিক্ষার্থীদের তুলির আঁচড় যেন হয়ে উঠেছিল পায়রার ডানা। সেই ডানা ঝাপটানো দেখেই হয়তো কার্টুনিস্টরা সাহস পেয়েছেন, আবার রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র আঁকা শুরু করেছেন।
গত ৭ আগস্ট কার্টুনিস্ট মেহেদী হক একটি কার্টুন এঁকে ফেসবুকে পোস্ট করেন। সেটা ছিল জাপানিজ হরর ফিল্ম ‘দ্য রিং’-এর একটি আইকনিক দৃশ্য অবলম্বনে। রিং সিনেমায় দেখা যায়, এক অশরীরী বা প্রেতাত্মা টেলিভিশন সেট থেকে বের হয়ে বাস্তবিক পৃথিবীতে নেমে আসছে আর মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে। ২৩ বছরের বেশি সময় ধরে কার্টুন আঁকা মেহেদী সেই অশরীরীর জায়গায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বসিয়ে ব্যঙ্গচিত্রটি আঁকেন। কার্টুনিস্ট হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন– বহু বছর দেশের বাইরে থাকা তারেক এবার হয়তো ‘ফাঁকা মাঠ’ পেয়ে দেশে আসবেন এবং ভূত হয়ে অনেকের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারেন।
কিন্তু তারেক রহমান কোনো প্রকার বিরক্তি বা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ না দেখিয়ে যেন কার্টুনের হিউমার বা উইটিতে মজে যান। এ নিয়ে রোববার (১১ আগস্ট) সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে তার ভেরিফায়েড পেজ থেকে একটি পোস্ট শেয়ার করেন তিনি। সেখানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক কার্টুন আঁকার স্বাধীনতা নিয়ে আশাবাদী মন্তব্যও করেন।
কার্টুনের ছবিটি পোস্ট করে ক্যাপশনে তারেক রহমান লিখেছেন, আমি গভীরভাবে আনন্দিত যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক কার্টুন আঁকার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার হয়েছে। ২০০৬ সালের আগে বাংলাদেশি কার্টুনিস্ট বিশেষ করে শিশির ভট্টাচার্য প্রায়ই আমার মা (খালেদা জিয়া) ও আমাকে নিয়ে কার্টুন তৈরি করতেন।
তারেক রহমান লেখেন, গত ১৫ বছরে আমরা কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে জোরপূর্বক গুমের শিকার হতে দেখেছি। তার কাজের জন্য তাকে অকল্পনীয় নির্যাতন ও কারাবরণ করতে হয়েছে। এছাড়া, আরও অনেকে একই ধরনের নিপীড়নের মুখোমুখি হয়েছেন। শিশির ভট্টাচার্য অবশেষে কার্টুন তৈরি করা বন্ধও করে দেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরও লেখেন, আমি কার্টুনিস্ট মেহেদীর ভক্ত। শিশির ভট্টাচার্যের কাজও দারুণ উপভোগ করতাম। আন্তরিকভাবে আশা করি– তিনি (শিশির) শিগগিরই নিয়মিত রাজনৈতিক কার্টুন তৈরি শুরু করবেন।
তার এই সহনশীল মানসিকতার জন্য নেটিজেনদের প্রশংসা বৃষ্টিতে ভাসছেন তারেক। ফাতেহা নুর নামে একজন লিখেছেন, এটা (তারেক রহমানকে নিয়ে আঁকা কার্টুন) গ্রহণ করার জন্য আপনাকে জানাই ধন্যবাদ। এটাই বাকস্বাধীনতা, এটাই গ্রহণের স্বাধীনতা!
রাকিব হোসেন নামে আরেকজন লিখেছেন, বিএনপি বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলো, ভবিষ্যতেও থাকবে। আর কোনো ‘ফুডপান্ডা’ চাই না। বিএনপির জন্য রইলো শুভকামনা।
গ্রন্থনা: আল মাহফুজ