চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের এক দশক পুরোনো কমিটি অবশেষে ভাঙার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে নতুন কমিটির জন্য জীবনবৃত্তান্তও চাওয়া হয়েছে নেতাকর্মীদের কাছে। তবে আগের কমিটিগুলো এমইএস কলেজ ও সিটি কলেজকেন্দ্রিক হলেও এবারের কমিটির ক্ষেত্রে ‘পরিবর্তন’ আনতে চায় কেন্দ্র। চেনাবৃত্তের বাইরে থেকে বড় পদ বাগিয়ে নিতে পারেন অন্যান্য কলেজের নেতাকর্মীরা—এমনটাই শোনা যাচ্ছে।
তবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে শিগগির কমিটি দেওয়ার যে ঘোষণা, তা বাস্তবায়ন হবে কিনা—সেটি নিয়ে কিছু শঙ্কায়ও আছে চট্টগ্রামের নেতাকর্মীরা। এর আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) কমিটির জন্য জীবনবৃত্তান্ত চাওয়া হলেও পরে আর কমিটি ঘোষণা হয়নি।
এর আগে বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের জন্য পদপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে জীবনবৃত্তান্ত চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এরপর থেকে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ কমিটি ভাঙনের কথা বেশিই শোনা যাচ্ছে। ২০১৩ সালের ২৯ অক্টোবর সরকারি সিটি কলেজের ইমরান আহমেদ ইমুকে সভাপতি এবং ওমরগণি এমইএস কলেজের নূরুল আজিম রনিকে সাধারণ সম্পাদক করে চট্টগ্রাম মহানগরের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়।
এদিকে বিংশ শতাব্দীর পর সবেমাত্র তিনটি কমিটি পেয়েছে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগ। এরমধ্যে একটি স্টিয়ারিং কমিটি ও বাকি দুটি পূর্ণাঙ্গ। সেই ২৩ বছরের হিসেবে দেখা গেছে, পদগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ কমিটির প্রধান পদগুলো ভাগাভাগি হয়েছে চট্টগ্রাম শহরের রাজনীতির আতুঁড়ঘর নামে খ্যাত ওমরগণি এমইএস কলেজ এবং সরকারি সিটি কলেজের নেতাকর্মীরা। তবে এই নতুন কমিটির বেলায় সেই চিরচারিত নীতি ভাঙার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে দুই কলেজের বাইরে তৈরি হয়েছে নেতৃত্বযোগ্য নেতা। তাই গ্রুপ লিডাররাও দুই কলেজের বাইরে গিয়ে নতুন চিন্তা করছেন—এমনটাই চর্চা হচ্ছে রাজনীতিপাড়ায়।
সেই নেতৃত্বের দৌড়ে এগিয়ে আছে চট্টগ্রাম কলেজ, ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ ও সরকারি কমার্স কলেজ ছাত্রলীগের নেতারা। নতুন নগর ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দৌড়ে এমইএস ও সিটি কলেজকে হারিয়ে এবার হয়তো নতুন ইতিহাস লেখা হতে পারে।
২০০০ সালের নগর ছাত্রলীগের স্টিয়ারিং কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘একটা সময় এমইএস ও সিটি কলেজের বাইরে তেমন কোনো নেতৃত্ব তৈরি হতো না। কিন্তু বর্তমানে যে নতুন ধারার জ্ঞান, তথ্যনির্ভর ছাত্রলীগের প্রচলন চলছে, তাতে এই দুই কলেজকে টেক্কা দিতে নগরে একাধিক শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী এবং কলেজ আছে।
দীর্ঘদিন ধরে কমিটি না হওয়ায় বিশেষ করে এমইএস কলেজকে নতুন কমিটিতে পদখরায় ভুগতে হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
জীবনবৃত্তান্ত চাওয়ার পর থেকেই এখনও পর্যন্ত অন্তত অর্ধশত ছাত্রনেতা নিজেদের নগর ছাত্রলীগের প্রার্থী দাবি করছেন। তবে ওয়ার্ড ও থানা পর্যায় চেয়েও কলেজকেন্দ্রিক ছাত্রনেতাদের পদে আনতে দেখা গেছে গত কয়েকটি কমিটিতে।
ওমরগণি এমইএস কলেজ
২০০৮ সালে এসএসসি পাস করা এমইএস কলেজের ছাত্র ও ডবলমুরিং থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সমম্পাদক রাকিব হায়দার এবার শীর্ষ পদের দাবিদার। একই কলেজের, একই ব্যাচের আরেক ছাত্রনেতা ও বর্তমান কমিটির সদস্য মোশারফ চৌধুরী পাবেল, বাকলিয়া থানা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মিজানুর রহমান ও চান্দগাঁও থানা ছাত্রলীগের সভাপতি নুরুন নবী সাহেদও আছেন এই তালিকায়।
সরকারি সিটি কলেজ
বর্তমান নগর কমিটির সদস্য, সিটি কলেজের এইচএসসি ২০১১ ব্যাচের আরাফাত রুবেল, সিটি কলেজের (নৈশ) শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক এমএইচ ফয়সাল ও নৈশ শাখার আহ্বায়ক আশীষ সরকার নয়ন চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের শীর্ষপদ পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন।
যদি আগের মতো সিটি কলেজ থেকেই নেতা বানাতে হয়, তাহলে এদের যে কোনো একজন থাকতে পারেন নতুন নগর কমিটির নিয়ন্ত্রণে।
চট্টগ্রাম কলেজ
দীর্ঘদিন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিষিদ্ধ থাকা ক্যাম্পাসটি ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে আসে ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এরপর নানা নাটকীয়তার পর কমিটি পায় কলেজ ছাত্রলীগ। কলেজের বর্তমান কমিটির সভাপতি মাহমুদুল করিমকে নগর কমিটির জন্য এগিয়ে রাখছেন অনেকে।
এছাড়া মাহমুদকে টেক্কা দিতে রয়েছেন একই কলেজের তরুণ ছাত্রনেতা ও বর্তমান কলেজ কমিটির সহ-সভাপতি হাসমত খান আতিফ। ক্রিয়েটিভ ও ক্লিন ইমেজের নেতা হিসেবে কেন্দ্রীয় নেতাদের স্নেহভাজন তিনি। তাই বয়সে ছোট হলেও এই আতিফই অনেক সিনিয়র প্রার্থীর ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে আরও আছে সহ-সভাপতি মনিরুল ইসলাম মনিরের নাম।
‘সিটি-এমইএস’ বলয়ের বাইরে যদি কমিটি হয়, তাহলে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে একজন হতে পারে এবারের কমিটির সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক—এমনটাই আলোচনা হচ্ছে ছাত্রলীগ নেতাদের আড্ডার আঁতুরঘর খ্যাত মধুর ক্যান্টিনে।
ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
কলেজ ছাত্রলীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মীর মোহাম্মদ ইমতিয়াজ আলোচনায় আছেন ভালোভাবেই। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার দৌড়ে অনেকের চাইতে এই তরুণ ছাত্রনেতাকে এগিয়ে রাখছেন অনেকে। তিনি এসএসসি ২০১২ ব্যাচের ছাত্র।
এছাড়াও আলোচনায় আছেন কলেজটির ছাত্রসংসদের জিএস সৈয়দ ইবনে জামান ডায়মন্ড। ক্লিন ইমেজের ছাত্রনেতা হিসেবে সবার প্রিয়ভাজন ডায়মন্ড। তিনিও ইমতিয়াজের ব্যাচের।
কমার্স কলেজ ও হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ মহসিন কলেজের দুই যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার পলাশ এবং মায়মুন উদ্দিন মামুনও আছেন এই আলোচনায়। এছাড়াও কমার্স কলেজের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আলভী হয়েছেন কলেজের পদপ্রার্থী। তবে সম্প্রতি অস্ত্র ও মদের বোতল হাতে ছবিতে বিতর্কিত হয়েছেন তিনি।
কমিটির দৌড়ে সরব নাছির গ্রুপও
চট্টগ্রামের রাজনৈতিক কমিটিগুলোতে বরাবরই হতাশ হতে হয়েছে সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীদের। গত তিন নগর ছাত্রলীগের কমিটিতেও প্রধান দুই পদসহ অধিকাংশ পদ বাগিয়ে নেয় এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীরা। সর্বশেষ হওয়া নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও যুবলীগের বেলায়ও একই চিত্র দেখা গেছে। তাই শীর্ষপদ বাগিয়ে নিতে নাছির গ্রুপের কর্মীরা ছুটছেন সমানতালে। এই গ্রুপের পক্ষ থেকে আলোচনায় আছেন বাকলিয়া সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও নগর ছাত্রলীগের উপসম্পাদক রাশেদ চৌধুরী এবং নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক শৈবাল দাশ, উপসম্পাদক ইমরান আলী মাসুদ, নাছির উদ্দিন কুতুবী, হুমায়ুন কবির আজাদ, সহসম্পাদক অরভিন সাকিব ইভান, ওসমান গনি, ফাহাদ আনিস ও কোতোয়ালী থানা ছাত্রলীগের সভাপতি অনিন্দ্য দেব।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক মিফতাহউল ইসলাম প্রান্ত বলেন, ‘৬ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জীবনবৃত্তান্ত জমা নেওয়া হবে। এর মধ্যে অনেকে সশরীরে এবং ফোনে যোগাযোগ করছেন।’
কবে কমিটি ঘোষণা হতে পারে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিনের একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছে চট্টগ্রামে নগর কমিটি নিয়ে। যেসব জীবনবৃত্তান্ত জমা পড়বে, তা যাচাই-বাছাই করতেও সময় দরকার। কেন্দ্রীয় কমিটি চাইছে, সম্মেলনের মাধ্যমেই চট্টগ্রাম নগর কমিটি উপহার দিতে।’
১৯৮৮ সালের চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জিএম সাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘আমাদের সময় যেরকম ব্যানার লেখা হতো, বক্তৃতার প্রচলন ছিলো, তা এখন নেই। এখন মেধাবীদের মূল্যায়ন করা হয় না। আমি চাই, নতুন কমিটিতে যাতে কোনোভাবেই বিবাহিত, ব্যবসায়ীদের জায়গা দেওয়া না হয়। নিয়মিত ও মেধাবী ছাত্ররাই যাতে নতুন কমিটির পদে আসে।’
২০০২ সালের চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সভাপতি এম আর আজিম বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগর কমিটিতে নতুন নেতৃত্বে যাতে যোগ্যরাই আসে। তারাই আগামীর স্মাট বাংলাদেশ গড়বে।’