গণভবনের রিসিপশন রুমে বিলাসবহুল সিল্কের শাড়ি পরনে লৌহকঠিন ব্যক্তিত্বের শেখ হাসিনা।৭৬ বছর বয়সী, রূপালী কেশের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন এক রাজনৈতিক চরিত্র যিনি গত এক দশকে গ্রামীণ পাট উৎপাদনকারী থেকে ১৭ কোটি মানুষের দেশকে এশিয়া-প্যাসিফিকের দ্রুততম প্রসারিত অর্থনীতিতে উত্থানের পথ দেখিয়েছেন।
প্রথম মেয়াদে ১৯৯৬ থেকে ২০০১, পরে ২০০৯ সাল থেকে একটানা অফিসে থেকে তিনি সরকারি পদে আসীন বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন নারী সরকার প্রধান হয়ে উঠেছেন। সেইসঙ্গে পুনরুত্থিত ইসলামপন্থী ও এককালে অনধিকারচর্চী সামরিক শক্তি উভয়কেই পরাস্ত করার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। ইতিমধ্যে মার্গারেট থ্যাচার কিংবা ইন্দিরা গান্ধীর চেয়ে বেশি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর হাসিনা জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে সেটা আরও দীর্ঘ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সেপ্টেম্বরে টাইম ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি আত্মবিশ্বাসী যে আমার জনগণ আমার সাথে আছে। তারা আমার প্রধান শক্তি।”
হাসিনার শাসনামলে কয়েক বছর ধরে ১৯টি গুপ্তহত্যার চেষ্টা হয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে, প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর সমর্থকরা নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, যার ফলে শত শত মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছে, পুলিশের গাড়ি এবং পাবলিক বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে এবং বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে। বিএনপি ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতোই নির্বাচন বয়কট করার ব্রত নিয়েছে যদি না হাসিনা নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। (তাদের এই দাবির ঐতিহাসিক নজির থাকলেও সংবিধান সংশোধনের পর সেটি আর বহাল নেই।)
হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের অধীনে বাংলাদেশ কর্তৃত্ববাদী রূপ নিয়েছে। ব্যালট বাক্স দখল এবং হাজার হাজার ভুয়া ভোটার সহ নানা উল্লেখযোগ্য অনিয়মের কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্যরা গত দুটি নির্বাচনের নিন্দা জানিয়েছিল।(যেগুলোতে তিনি যথাক্রমে ৮৪% এবং ৮২% ভোট পেয়ে জয়ী হন)।
দুই বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া সন্দেহ রয়েছে এমন দুর্নীতির অভিযোগে গৃহবন্দী এবং গুরুতর অসুস্থ। এরই মধ্যে, চল্লিশ লাখ (আশ্চর্যজনক) আইনি মামলায় বিপাকে পড়েছেন বিএনপির কর্মীরা। অন্যদিকে, স্বাধীন সাংবাদিকরা এবং নাগরিক সমাজের কাছ থেকেও প্রতিশোধমূলক হয়রানির অভিযোগ আসছে।
সমালোচকরা বলছেন, জানুয়ারির নির্বাচন হবে রাজ্যাভিষেকের সমতুল্য, আর হাসিনা স্বৈরশাসকের।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন ,”ক্ষমতাসীন দল পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাই হোক কিংবা বিচার বিভাগ। আমরা কথা বললেই তারা নিপীড়ন করে।” ভাঙচুর ও হত্যাসহ ৯৩টি মামলায় অভিযুক্ত মির্জা ফখরুল নয়বার কারাবরণ করেছেন।
বাংলাদেশের মূল্য আছে। দেশটি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীবাহিনীতে একক বৃহত্তম শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী এবং নিয়মিতভাবে মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের সাথে অনুশীলন করে থাকে। দেশটির প্রাণবন্ত অভিবাসীরা এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকাজুড়ে ব্যবসায়ী এবং শিল্প সম্প্রদায়ের গভীরে প্রোথিত। বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এর সবচেয়ে বড় উৎস যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের রপ্তানির শীর্ষ গন্তব্যও যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেনে ভ্লাদিমির পুতিনের আগ্রাসনের নিন্দা করা (যদিও বিলম্বে) উন্নয়নশীল বিশ্বের কতিপয় নেতাদের একজন হাসিনা যিনি পশ্চিমাদের জন্য নিজেকে দরকারি হিসেবে তুলে ধরেছেন। প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে থাকতে দেয়ার বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু, স্বৈরতন্ত্রের দিকে বাংলাদেশের ঝুঁকে পড়া নিয়ে ওয়াশিংটন উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের আয়োজনে সর্বশেষ দুটি গণতন্ত্র সম্মেলনে হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র জানায়- নির্বাচনকে ব্যাহত করলে যে কোনো বাংলাদেশির ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। এর জবাবে, হাসিনা সংসদে বলেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে “গণতন্ত্র বাদ দেয়ার চেষ্টা করছে”। তার এমন অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে, বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি. হাস জোর দিয়ে বলেন, ওয়াশিংটন “কোনো পক্ষকে বেছে না নেয়ার ব্যাপারে সতর্ক”।
কিন্তু এটি এমন একটি সময় যখন যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক নীতি অনুযায়ী দেশটি প্রতিটি ক্ষেত্রে চীনের ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক পদচারণার ‘সম্পূর্ণ বিরোধী’ কিছু করতে মরিয়া। উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, “বিদেশে নিজের গণতন্ত্র-প্রচার নীতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে একটি ‘টেস্ট কেইসে’ পরিণত করেছে বলে মনে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বড় ঝুঁকিটা হলো এ সকল চাপ হিতে বিপরীত হতে পারে এবং তা সরকারকে দ্বিগুণ নীচে নামতে এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করতে প্ররোচিত করতে পারে।”
হাসিনার টানা চতুর্থ মেয়াদ বাংলাদেশের জন্য কী ভাগ্য বয়ে আনবে, এটা দুই ভাগে বিভক্ত করা প্রশ্ন। বেশিরভাগ আমেরিকানরা বাংলাদেশকে কেবলই তাদের প্যান্টশার্ট সেলাই করা লেবেল দেখে চিনলেও এটা এমন এক দেশ যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি মুসলিম জনসংখ্যার সাথে ১০% হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংখ্যালঘুর আবাস। সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হলেও ১৯৮৮ সালে জনৈক সামরিক স্বৈরশাসক ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বানান, যার ফলে (দেশটি) উগ্র মৌলবাদীদের উর্বর ভূমিতে পরিণত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
হাসিনার অর্থনৈতিক অর্জনগুলো চিত্তাকর্ষক। নিজ দেশের মানুষকে খাওয়াতে যেখানে সংগ্রাম করতে হতো, সেখানে এখন খাদ্য রপ্তানি করা হয়। ২০০৬ সালে যেখানে জিডিপি ছিল ৭১ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৪৬০ বিলিয়ন ডলার। ভারতের পর দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এখন বাংলাদেশ। সামাজিক সূচকগুলোতেও উন্নতি হয়েছে৷ বর্তমানে দেশের শতকরা ৯৮ ভাগ মেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। বাংলাদেশ হাই-টেক ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, স্যামসাং-এর মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো চীন থেকে সাপ্লাই চেইন সরাতে পারছে। ঢাকায় আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আরাফাত। তিনি বলছিলেন- ”গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের উন্নতি করতে হবে। তবে, আমরা অনেক পথ পেরিয়ে এসেছি।”
বাংলাদেশ এখন জলবায়ু সংকটেরও ফ্রন্ট লাইনে। একসময় পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত দেশটি ১৯৭১ সালের গৃহযুদ্ধের আঘাত কাটিয়ে উঠলেও পানি সমস্যা সহস্রাব্দ ধরে এখানকার মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছে। সুউচ্চ হিমালয় থেকে তুষার গলিত প্রতি বছর ১৬৫ ট্রিলিয়ন গ্যালন পানি বাংলাদেশের নদীগুলোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। ঘূর্ণিঝড় নিয়মিতভাবে নীচু ব-দ্বীপকে আঘাত করে কারণ, দেশের ৮০%ই প্লাবনভূমি। এর ফলে বছরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। ক্রমবর্ধমানভাবের সাগরের পানির স্তর বৃদ্ধি ক্যালিফোর্নিয়ার চারগুণ বেশি জনসংখ্যার দেশটির (আয়তনে ইলিনয়ের চেয়ে ছোট) মানুষের জীবন ও জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। হাসিনা উন্নয়নশীল দেশগুলোর হয়ে জলবায়ু স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তনের জন্য উন্নত দেশগুলোর কাছে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের দাবি রেখেছেন, যে দাবি এখনও পূরণ হয় নি। এ বিষয়ে তিনি বলছিলেন, ”আমরা কেবল প্রতিশ্রুতি শুনতে চাই না, উন্নত দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।”
বাংলাদেশের জীবন যদি পানি শাসিত বলা যায়, তবে তার রাজনীতিকে বলতে হবে রক্তস্নাত। গত অর্ধশতাব্দী ধরে দুটি পরিবার এবং এখন তাদের নেতৃত্ব দেয়া নারীরা তিক্ত দ্বন্দ্বে আবদ্ধ। একদিকে রয়েছেন, শেখ হাসিনা যার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি শেখ মুজিব নামে সমধিক পরিচিত। তিনি এবং তার ১৭ জন নিকটাত্মীয়কে ১৯৭৫ সালে এক সেনা অভ্যুত্থানে হত্যা করা হয়। (সম্ভবত ইউরোপে থাকার কারণেই হাসিনা বেঁচে যান)। অন্যদিকে, সাবেক সেনাপ্রধান এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী খালেদা জিয়া। মুজিব হত্যার পর থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত জিয়াউর দেশের নেতৃত্বে ছিলেন।
এই উভয় ‘ডাইনাস্টিক ম্যাট্রিয়ার্ক’ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে একে অপরকে ছোট করে নিজেদের পরিবারের ভূমিকাকে বৈধতা দেবার চেষ্টা করে। স্বৈরশাসকের হাতে জন্ম এই বলে হাসিনা বিএনপিকে’ সন্ত্রাসী দল’ বলে উপহাস করেন, যে দল ‘কখনও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেনি’। স্পষ্টতই বিষমাখা কণ্ঠে তিনি বলেন, “খালেদা জিয়া” সামরিক স্বৈরশাসকের মতো দেশ চালিয়েছেন”। ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে বিএনপি সমর্থকরা যে সহিংসতা করেছে হাসিনা তা বড় করে দেখান। এর বিপরীতে, বিএনপি তাদের দলের উপর পদ্ধতিগত নিপীড়নের দিকে ইঙ্গিত করে এবং তার (হাসিনার) নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে। প্রকৃতপক্ষে, রক্তারক্তির বিষয়টি দুঃখজনকভাবে সব পক্ষ থেকেই ঘটছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উপ-পরিচালক (এশিয়া) মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেন, “বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রায়ই রাস্তায় সহিংসতা হয়ে থাকে। এটি প্রধান সব রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই সত্য”।
নিজ সরকার কর্তৃক স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, আইডি কার্ড এবং বায়োমেট্রিক ডেটার সাথে যুক্ত রেজিস্ট্রেশন পেপার প্রবর্তনকে হাসিনা অবাধ নির্বাচনের প্রতি তার অঙ্গীকারের প্রমাণ হিসেবে দেখান। নিজের ডিএনএতে গণতন্ত্র রয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন। পিতৃ হত্যার পর হাসিনা এবং তার বোন শেষ পর্যন্ত ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার আগ পর্যন্ত পশ্চিম জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। (১৯৬৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানী এম. এ. ওয়াজেদ মিয়ার সাথে তার বিয়ে হয়েছিল যিনি ২০০৯ সালে মারা যান, এই দম্পতির দুই সন্তান রয়েছে।) হাসিনাকে ১৯৮১ সালেই বাংলাদেশে ফিরে আসার অনুমতি দেয়া হয়েছিল, যখন হাজার হাজার আওয়ামী লীগ সমর্থকরা তাকে ঘিরে ধরেছিল। পরবর্তী বছরগুলো তিনি সামরিক শাসনের অবসান এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করে কাটিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ”আমাদের স্লোগান ছিল- ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার।”
কিন্তু, পরের চার দশকে অনেক কিছু বদলে গেছে। এখন বাংলাদেশের বিরোধীরা গ্রেপ্তার, হামলা বা আইনি চ্যালেঞ্জের ভয়ভীতি ছাড়া রাস্তায় প্রচারণা চালাতে কিংবা মিডিয়াতে নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারছেন না বলে অভিযোগ করছেন। রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, “অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কেবল নির্বাচনের দিনটিই গুরুত্বপূর্ণ নয়। এর জন্য সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া এবং পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ।”
১৯৯১ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছিল এবং ক্ষমতাসীন (দলের) বিরোধিতার মানে সুষ্ঠু নির্বাচনে হাসিনার পরাজিত হওয়ার সকল সুযোগ রয়েছে। ঢাকার একজন রিকশা চালক টাইম এর কাছে অভিযোগ করে বলেন, “মানুষ এখন কষ্ট পাচ্ছে”। তিনি জানান, দিনে যে ৪০০ টাকা (সাড়ে তিন ডলার) আয় করেন তা দিয়ে স্ত্রী এবং দুই সন্তানের জন্য রান্নার তেল আর মসুর ডাল জোগাড় করা-ই কঠিন হয়ে যায়। তার বক্তব্য, “(হাসিনা) বড় পরিবার থেকে আসলেও তার পিতা এখন আমাদের সাহায্য করতে পারেন না।”
হাসিনার জন্য বড় সমস্যা হলো তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হলে তিনি সম্ভবত একই ধরণের দমনমূলক প্রতিশোধের সম্মুখীন হবেন যেমনটি তার সরকার এখন করছে। ঢাকা-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক- সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) এর নির্বাহী পরিচালক এবং টকশো হোস্ট জিল্লুর রহমান বলছিলেন, “আওয়ামী লীগ খুব ভয়ে আছে। তাদের কোনো ‘সেইফ এক্সিট’ নেই।”
বাংলাদেশের নিপীড়নমূলক সিকিউরিটি ল্যান্ডস্কেপ মূলত ২০১৬ সালের পহেলা জুলাইয়ের ঘটনাগুলো দিয়ে বড় রূপ লাভ করেছিল। সেদিন রাত ৯:৪০ টায় পাঁচ ব্যক্তি বোমা, পিস্তল, অ্যাসল্ট রাইফেল, রামদা দিয়ে ঢাকার জনপ্রিয় গুলশানের হলি বেকারিতে প্রবেশ করে যেটি আশেপাশের দূতাবাস কর্মী এবং বাংলাদেশের অভিজাতদের প্রিয় এক জায়গা। “আল্লাহু আকবর” বলে তারা প্রধানত বিদেশি ক্রেতাদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায় এবং গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। কাস্টমাররা টেবিলের নীচে আর আতঙ্কিত স্টাফরা ছাদে পালিয়ে যায়, কেউ কেউ রেস্টরুমে নিজেদের লক করে রেখেছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, হামলাকারীরা অভিযোগ করেছিল যে, পশ্চিমাদের ছোটখাটো খোলামেলা পোশাক এবং অ্যালকোহল স্থানীয়দেরও একই কাজ করতে উৎসাহিত করছে। তারপর তারা কোরআন তেলাওয়াত করতে পারেন না এমন জিম্মিদের অত্যাচার ও হত্যা করে। পুলিশি অভিযানের মাধ্যমে অবরুদ্ধ দশার সমাপ্তি হলে প্রধানত স্থানীয়, ইতালীয় ও জাপানি নাগরিক, পাঁচ সন্ত্রাসী এবং দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়া যায়। আহত হয়েছিলেন আরও ৫০ জন, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন পুলিশ।
আইএসআইএস-অনুপ্রাণিত ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধির মধ্যে ওই ঘটনা ছিল নিকৃষ্টতম ঘটনা যা বাংলাদেশকে ঘিরে ধরেছিল, এর আগের ১২ মাসে হিন্দু, শিক্ষাবিদ, ধর্মনিরপেক্ষ লেখক এবং ব্লগারদের লক্ষ্য করে ৩০ টিরও বেশি সহিংস হামলা হয়েছিল। ভয়ের সংস্কৃতি এতোটাই বিস্তৃত হয়ে উঠে যে নিজেরা টার্গেট হওয়া থেকে বাঁচতে অনেক রেস্তোরাঁ বিদেশী কাস্টমারদের নিষিদ্ধ করে। পাতাভরা রাস্তায় যেখানে সেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল আজ সেখানে কেবলই বিলাসবহুল ভবন আর একটি মেডিকেল ক্লিনিক রয়েছে। তবু, সহিংসতার সেই স্মৃতি এখনও হাসিনার সিকিউরিটি ক্র্যাকডাউনকে বৈধতা দেয় যা অদ্যাবধি অব্যাহত রয়েছে।
১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে বাংলাদেশ ‘ইসলামিফিকেশন’ শুরু করে। তার বিএনপি এখনও অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল দলগুলোর সাথে জোটবদ্ধ, যেখানে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। উইলসন সেন্টারের কুগেলম্যান বলছিলেন, “বিরোধীদের ইসলামপন্থী অংশকে কঠোরভাবে দমন করার অজুহাত হিসেবে ঢাকা সন্ত্রাসবাদ নির্মূলকে ব্যবহার করেছে।” সন্ত্রাস দমন আজ রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিস্তৃত অংশ হয়ে উঠেছে। বিএনপির সাম্প্রতিক সমাবেশগুলোতে পুলিশের একশনকে মীনাক্ষী গাঙ্গুলি “উস্কানিমূলক” বলে অভিহিত করেন যা “নি:সন্দেহে প্রতিশোধ গ্রহণের পথে ঠেলে দিচ্ছে।”
তবে এটি কেবল রাজপথে ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি কিংবা লাঠিচার্জের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; বাংলাদেশের বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলো হাসিনার কথিত শত্রুদের সামান্য সমালোচনাকেও ক্রমবর্ধমানভাবে টার্গেট করেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের ঘটনা ট্র্যাক করেছেন এমন দুজন বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মীকে ১৫ সেপ্টেম্বর অস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে দু’বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সহ বিদেশি সরকারগুলো কথা বলেছে। সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট এবং শিক্ষার্থীরাও টার্গেট হয়েছেন।
গত আগস্টে, বারাক ওবামা সহ ১৭০ জনেরও বেশি বিশ্বনেতা এবং নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশের মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে “লাগাতার বিচারিক হয়রানি” বন্ধ করার জন্য হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়ে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ইউনূস দারিদ্রতা কমানো ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তক।
ইউনূসের বিরুদ্ধে হাসিনা শ্রম আইন লঙ্ঘন, দুর্নীতি এবং মানি লন্ডারিং সহ ১৭৪ টি মামলা করতে প্রেরণা যুগিয়েছেন। ইউনূসকে তিনি “রক্তচোষা” বলে বিদ্রূপ করে থাকেন।
এ এক উদ্ভট প্রতিহিংসা যা ‘ফেস্টারিং প্যারানয়া’র অভিযোগে ইন্ধন জোগায়। হাসিনা জোর গলায় বলতে পারেন যে তার রেকর্ড অনুকরণীয়- “খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, চাকরির সুযোগ,” তিনি একটানা বলতেই থাকেন। “আমি এটা করছি, আমি ওটা করেছি” – তবে ঠিকমতো খতিয়ে দেখলে বিষয়গুলো খুব বেশি সুখকর দেখাবে না। ফ্রিডম হাউস (ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা) বাংলাদেশকে “আংশিক স্বাধীন” বলে মনে করে। দেশটির অর্থনীতি এখনও কৃষি, সস্তায় পোশাক রপ্তানি এবং ১ কোটি ৪০ লাখ অভিবাসীর প্রতি বছর দেশে পাঠানো প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের উপর নির্ভরশীল। এই রেমিটেন্স অর্থনৈতিক চাপ কমাতে সাহায্য করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, বিশেষ করে যখন ইউক্রেনে আক্রমণের পর থেকে জ্বালানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) এ বিশ্বব্যাপী ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ইরানের সাথে ১৪৭ তম স্থানে এবং তালেবান শাসিত আফগানিস্তান থেকে এক স্থান উপরে রয়েছে। হাসিনা গর্ব করেন যে বাংলাদেশে প্রত্যেক ব্যক্তির কাছেই এখন মোবাইল ফোন আছে এবং ২০২৬ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) ক্যাটাগরি থেকে পরবর্তী ধাপে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। কিন্তু, যে কোন পরিমাপ বিচারেই এটি একেবারে নিম্নমানের নিচে। ততদিনে এশিয়া থেকে (এলডিসি) সদস্য হিসেবে থাকবে কেবল মিয়ানমার, আফগানিস্তান এবং কম্বোডিয়া।
হাসিনা যখন ঢাকার বস্তির মানুষদের উপেক্ষা করে দেশের গ্রামগুলোর “ভিন্ন দৃশ্যকল্প” তুলে ধরেন তখন প্রশ্ন ওঠে যে, কেন প্রতিদিন ২,০০০ মানুষ গ্রামাঞ্চল ত্যাগ করে জনাকীর্ণ রাজধানীতে ছুটে আসেন। দুই অঙ্কের মুদ্রাস্ফীতিতে সাধারণ বাংলাদেশিরা কষ্ট পাচ্ছে যেখানে বৈদেশিক রিজার্ভ কমে যাওয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বাণিজ্য করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করেছে। দুর্নীতি এখানে ব্যতিক্রম নয় স্বাভাবিক, এর পাশাপাশি শ্রম সমস্যা এবং মুদ্রা সংকটের কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত হাস বলেন “ব্যবসা করার জন্য এটা কঠিন এক জায়গা। আমাদের কোম্পানিগুলি তাদের সম্ভাব্য বিনিয়োগের জন্য আরও ডজনখানেক দেশের দিকে নজর রাখছে … তাই বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক থাকাটা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।”
রোহিঙ্গা সঙ্কটের দ্বারা বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা মূর্ত হয়েছে। কক্সবাজারের সমুদ্রতীরবর্তী হোটেল থেকে গাড়িতে করে এক ঘন্টা গেলে প্লাস্টিকের চাদরে আচ্ছাদিত বাঁশের কুঁড়েঘরগুলি নজরে পড়বে। কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের অভ্যন্তরে, সরকারের কারণে পশ্চিম মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় দশ লাখ রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা শরণার্থী সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন, ওইসময় আনুমানিক ২৪,০০০ মানুষের প্রাণ হারিয়েছিল। শিশুরা ফুটবল খেলছে, মহিলারা বোরকা পরে সমুচা আর টক বরই জাতীয় পণ্য বিনিময় করছে।
যারা পালিয়েছিল তারা নিজেদের সাথে হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং ধর্ষণের গল্প ছাড়া সামান্যকিছুই সাথে নিয়ে এসেছিল।
রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের সহানুভূতিশীল প্রতিক্রিয়া দেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অন্যান্য মানবাধিকারের উদ্বেগ উত্থাপন করতে অস্বস্তি বোধ করেছে। মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলছিলেন, এই দেখেও অন্ধ হয়ে থাকাটা ‘চলতে থাকতো যদি না অভ্যন্তরীণ নির্যাতন অতি তীব্র না হয়ে উঠতো”। কিন্তু এখন, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার প্রেক্ষিতে নিরাপত্তা এবং মানবিক অবস্থার অবনতির সাথে সাথে পশ্চিমাদের চাপও ক্রমবর্ধমান।
৫৪ বছর বয়সী শরণার্থী শরিফ হোসেন বলেন, “এখন আমাদের মানুষদের ফিরে যাওয়ার জন্য আরও বেশি চাপ দেয়া হচ্ছে। আমরা মরে যাই বা যা কিছুই হোক না কেন, তাতে বাংলাদেশের কিছু যায় আসে না। তারা শুধু চায় আমাদের মানুষকে তাদের ভূমি থেকে সরিয়ে দিতে।”
রোহিঙ্গাদের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে, হাসিনা বিশ্বকে মনে করিয়ে দেন, “ছয় বছর আমার বোন এবং আমি দেশের বাইরে শরণার্থী হিসেবে বাস করেছি, তাই, আমরা তাদের দুঃখ এবং বেদনা বুঝতে পারি।” কিন্তু তার সরকার শরণার্থীদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং জীবিকা অর্জনের বৈধ উপায়ের অনুমতি দেয়ার দাবিতে কর্ণপাত করে নি। বরং, রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানানোটাই বন্ধ হয়ে গেছে। হাসিনা বলছিলেন, “এটা আমাদের জন্য বড় এক বোঝা। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য সংস্থা যারা এখানে [রোহিঙ্গাদের] সাহায্য করছে তারা মিয়ানমারের অভ্যন্তরেও একই কাজ করতে পারে।”
অবশ্যই রোহিঙ্গা সঙ্কট বাংলাদেশের পক্ষে একা সমাধান করা কখনই সম্ভব ছিল না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও দায় রয়েছে। তাদের দুর্দশা ঢাকায় আমেরিকান প্রভাব নিয়ে নতুন করে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। ঐতিহাসিক ভূমিকাও রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, তারা পাকিস্তানি জান্তার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েছিল।
বাংলাদেশ তার আকার এবং ভৌগোলিক পরিবেশের কারণে ভারত, চীন এবং রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শৈল্পিকভাবে ভারসাম্য রেখেছে।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে জনগণের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাশিয়ার উল্লেখযোগ্য ইতিহাস রয়েছে, রাশিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশী শিক্ষার্থী এবং সুশীল সমাজকে পৃষ্ঠপোষকতা করতো। ঝুঁকি হলো যে অনবরত চাপ দেয়া ঢাকাকে ওয়াশিংটন থেকে দূরে এবং মস্কো ও বেইজিংয়ের কাছাকাছি ঠেলে দেয়। এখন পর্যন্ত, ইউক্রেন থেকে রাশিয়াকে প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাবগুলোতে হাসিনা বিরত থেকেছেন এবং রাশিয়াকে সমর্থনও করেছেন। হাসিনা বিদ্রুপের ইঙ্গিত না করেই বলেন “কিছু ইস্যুতে আমরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দিইনি; আবার অন্য কিছু বিষয়ে আমরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছি। আমাদের অবস্থান খুবই পরিষ্কার।”
এটি এমন এক পন্থা যা ঢাকাকে প্রকাশ্যে কোনো পক্ষেরই বিরোধিতা না করার সুযোগ করে দিয়েছে। হাসিনা স্যাংশনপ্রাপ্ত ৬৯টিরও বেশি রাশিয়ান জাহাজকে বাংলাদেশে ডক করতে দেন নি। সেপ্টেম্বরে রাশিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ প্রথম কোনো শীর্ষ রাশিয়ান কর্মকর্তা হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা রোসাটম ঢাকার ৯০ মাইল পশ্চিমে দেশের প্রথম পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণ করছে। ৬ অক্টোবর, বাংলাদেশ ওই প্ল্যান্টের জন্য রাশিয়ান ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান পেয়েছে, যা আগামী জুলাই মাসে চালু হওয়ার কথা। ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য কাকে দোষারোপ করবেন জানতে চাইলে হাসিনার সপ্রতিভ উত্তর, “তাদের সকলেরই যুদ্ধ থামানো উচিত। পুতিনের উচিত যুদ্ধ থামানো। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত যুদ্ধে প্ররোচিত না করা এবং অর্থ সরবরাহ বন্ধ করা। তাদের ওই অর্থ শিশুদের পেছনে খরচ করা উচিত।”
বাংলাদেশের কঠোর নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে, হাসিনা ফের রক্ষণাত্মক, “আপনি যা কিছুই করবেন, কিছু লোক সর্বদা এর বিরোধিতা করবে।” এটি যে কোনও সমালোচনার অভ্যাসগত প্রতিফলন, যদিও এটি কম স্বস্তিদায়ক নয়। আমাদের কথোপকথনের সময়, উদ্বেগের জায়গাগুলো সাথে সাথেই অস্বীকার করা হয় এবং আত্মদর্শনের সুযোগগুলোর পরিবর্তে ‘ফ্যামিলি ট্রমা’র সেই অতল কূপে ঘুরিয়ে দেয়া হয়। টাইমের সাথে সাক্ষাৎকারে দুই ঘণ্টা সময়ের মধ্যে হাসিনা অনাহূতভাবে ডজনখানেকবার তার খুন হওয়া বাবার কথা তুলে আনেন।
অভ্যন্তরীণভাবে, তিনি মুজিবকে ঘিরে ব্যক্তিত্বের একটি শ্বাসরুদ্ধকর ‘কাল্ট’ প্রচার করেছেন। আমাদের সামনে ছিল “জাতির পিতা”র একটি বিশাল প্রতিকৃতি এবং প্রত্যেক সরকারি অফিস এবং ওয়েবসাইটে তার গোঁফওয়ালা মুখ শোভিত। ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডিপার্চার লাউঞ্জের অভ্যন্তরে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত প্লাজমা স্ক্রীন থেকে তার বক্তৃতা অনন্যোপায় শ্রোতামন্ডলির সামনে তুলে ধরা হয়। হাসিনা বলেন, “আমি এখানে এসেছি কেবলই আমার বাবার স্বপ্নপূরণ করতে।”
কিন্তু, সেই স্বপ্ন অবশ্য গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ছিল না। বিদ্রোহী সেনাদের দ্বারা নিহত হওয়ার প্রায় ছয় মাস আগে, ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মুজিব সমস্ত রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করেন এবং নিজেকে বাকশাল নামে পরিচিত একদলীয় রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন, জাতি ছিল দৃশ্যত জরুরি অবস্থার মধ্যে।
গণতন্ত্র কখনও পুনরুদ্ধার হবে কিনা তা একটি বিভাজনকারী প্রশ্ন, যদিও সমালোচকরা ইতিমধ্যেই হাসিনার রেজিমকে “বাকসাল ২.০” বলে অভিহিত করেছেন। এমনকি হাসিনার কথায়ও বাংলাদেশ এখন ‘গ্রে জোন’ এ রয়েছে, “গণতন্ত্রের বিভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে যা দেশভেদে পরিবর্তিত হয়।”
নির্বাচনের দিকে যাচ্ছেন এমন কারো কাছ থেকে এটা খুব কমই আশ্বস্ত করার বক্তব্য। হাসিনা জানেন, তিক্ত ও ক্ষতবিক্ষত বিরোধিতার অর্থ ব্যর্থতা কোনো বিকল্প নয়। তিনি বলেন, “গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে আমাকে উৎখাত করা অতোটা সহজ নয়। আমাকে নির্মূল করাই একমাত্র বিকল্প। আর, আমি আমার জনগণের জন্য মরতে প্রস্তুত।”
[বিশ্বের প্রভাবশালী টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ শীর্ষক প্রতিবেদনের লেখক টাইম-এর প্রতিনিধি চার্লি ক্যাম্পবেল। ২রা নভেম্বর এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। ]