সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি আদায়ে আগামীকাল শনিবার নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনেই মহাসমাবেশ করতে বদ্ধপরিকর বিএনপি। এই স্থান থেকে তারা কোনোক্রমেই সরবে না। নিজেদের এই অনড় অবস্থানের কথা পুলিশকে লিখিতভাবে জানিয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে একই দিনে একই সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে শান্তি সমাবেশ করবে। তারাও ঐ স্থান থেকে নড়বে না বলে জানিয়ে দিয়েছে পুলিশকে। অন্যদিকে পুলিশ এই বড় দুই দলকে রাস্তায় সমাবেশ না করে জনসভার বিকল্প স্থান নির্ধারণের আহ্বান জানিয়ে আসছে। বিএনপি নয়াপল্টন নিয়ে অনড় অবস্থান নেওয়ার আগে জনসভার জন্য বিকল্প স্থানে যেতে নমনীয় ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তবে বিএনপি নয়াপল্টনেই সমাবেশের ঘোষণা দেওয়ায় আওয়ামী লীগও বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট থেকে না সরার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। মাত্র দেড় কিলোমিটারের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পালটাপালটি বড় সমাবেশ ঘিরে টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। সংঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি না দিলেও আগামীকাল শনিবার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে জামায়াত।
সংগঠনের নেতারা গতকাল জানিয়েছেন, যে কোনো মূল্যে তারা শাপলা চত্বরে সমাবেশ করবেন। অন্যদিকে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম-কমিশনার (অপারেশনস) বিপ্লব কুমার সরকার গতকাল সাফ জানিয়েছেন, পুলিশ কোনো রাজনৈতিক দলকে রাস্তায় সমাবেশের মতো কর্মসূচি পালন করতে দেবে না। রাস্তায় কোনো সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না। মাঠ কিংবা খোলা স্থান নির্বাচন করে সেটি উল্লেখ করে আবেদন করতে হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার ডিএমপি সদর দপ্তরে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।
সমাবেশের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছে বিকল্প দুইটি ভেন্যুর নাম প্রস্তাবের অনুরোধসহ সাতটি তথ্য জানতে চেয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) গত বুধবার রাতে যে চিঠি দিয়েছিল, তার জবাবে দুই দলই ভেন্যু পরিবর্তন করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটেই সমাবেশ করবে বলে জানিয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেট, অনলি ওয়ান ভেন্যু আই ম্যানশন। যেটা বলেছি সেটাই। আর দ্বিতীয় কোনো কথা নয়।’ অন্যদিকে, বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘নয়াপল্টনেই হবে মহাসমাবেশ। সেখানেই আমরা সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। আমরা কোনোক্রমেই এই ভেন্যু থেকে সরব না।’
একই দিনে শাপলা চত্বরে জামায়াতে ইসলামীর ডাকা সমাবেশের অনুমতির বিষয়ে জানতে চাইলে বিপ্লব কুমার বলেন, ‘জামায়াতের বিষয়ে ডিএমপির অবস্থান লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। জামায়াতকে ঢাকা শহরের কোথাও সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না। জামায়াত স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত দল। দলটির নিবন্ধন হাইকোর্টের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন বাতিল করেছে। সুতরাং জামায়াতকে কোনো ধরনের স্পেস দেওয়ার সুযোগ নেই। তাদের বিষয়ে সহযোগিতা নয়, জিরো টলারেন্স নীতি। এরপরও যদি তারা অনুমতি ছাড়া সমাবেশ করতে চায়, তাহলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। জামায়াতের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, সব রাজনৈতিক দলকে অর্থাত্ যারা সভা-সমাবেশ করার অনুমতি চেয়েছে, তাদের বলা হয়েছে জনদুর্ভোগ কমাতে। রাস্তা বাদ দিয়ে খোলা স্থান দেখতে বলা হয়েছে। সেটা খোলা মাঠ হতে পারে। সবাইকে বলা হয়েছে নিজেরটা নিজেরাই পছন্দ করে ডিএমপিকে জানাতে। কারণ আমাদের ঢাকা শহর মেগাসিটি। এখানে যদি লাখ লাখ মানুষের সমাগম হয়, তাহলে দুই-আড়াই কোটি নগরবাসীর জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে নিতে সমস্যা হয়। সব দিক বিবেচনা করেই নগরবাসীর স্বার্থে নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য এই বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ডিএমপি কমিশনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সমাবেশ করতে চাওয়া দলগুলোকে রাস্তা বাদ দিয়ে ভিন্ন স্থান নির্বাচন করতে। বিকল্প স্থান ঠিক করে আবেদন করলে কমিশনার চিন্তা করে দেখবেন তারা অনুমতি পাবে কি না— যোগ করেন বিপ্লব।
বিএনপি যদি নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে তখন ডিএমপি কী করবে জানতে চাইলে যুগ্ম-কমিশনার বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতারা কর্মীদের চাঙ্গা রাখার উদ্দেশে অনেক সময় অনেক কিছুই বলেন। আমরা সেটিকে বিচার-বিবেচনায় নিচ্ছি না। আমরা আইনে কী আছে, সেটা বিবেচনা করব। ডিএমপির যে অর্ডিন্যান্স আছে সেখানে বলা আছে, ঢাকা শহরে কোনো সভা-সমাবেশ করতে হলে অবশ্যই কমিশনারের অনুমতি নিতে হবে। কেউ যদি অনুমতি না নেয়, সেটি আইন অমান্য হবে। তবে আমি আশা করব, রাজনৈতিক দলগুলো আইনের প্রতি বাধ্য থেকে পুলিশের প্রতি সহযোগিতা করবেন। আমরাও সবাইকে সহযোগিতা করতে চাই।’
বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে তাদের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির এই যুগ্ম-কমিশনার বলেন, এটি মিথ্যা কথা। কোনো রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ ঘিরে ডিএমপি কাউকে গ্রেফতার করে না। আমাদের ক্রাইম ডিভিশনের প্রত্যেক থানার ওসি ও ডিসিকে বলা আছে, যারা ওয়ারেন্টের আসামি, সন্দেহজনক আসামি, মামলা বা তদন্তভুক্ত আসামি, নাশকতা হতে পারে—এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাদের গ্রেফতার করার জন্য বলা হয়েছে। এর বাইরে অন্য কাউকে হয়রানি বা গ্রেফতার করার সুযোগ নেই।
বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, মহাসমাবেশ ঘিরে এখন পর্যন্ত নাশকতার হুমকির কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে থ্রেট (হুমকি) যে আসবে না, সেটি তো বলতে পারছি না। আমাদের গোয়েন্দা ইউনিটগুলো কাজ করছে। প্রতিটি ঘটনার সময় আমরা পর্যালোচনা করছি।
আওয়ামী লীগের সমাবেশ ১০টা থেকে ৭টা, লোক আসবে ২ লাখ
ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আগামীকাল শনিবার জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ করাসহ সাতটি বিষয়ে পুলিশকে লিখিতভাবে অবহিত করেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ জানিয়েছে, শনিবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এই সমাবেশ চলবে। সমাবেশে প্রায় ২ লাখ লোকসমাগম ঘটাবে তারা। সমাবেশটি বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেট থেকে পল্টন মোড়, জিপিও মোড়, শিক্ষা ভবন, গোলাপ শাহ মাজার, নগর ভবন, নবাবপুর সড়ক, মহানগর নাট্যমঞ্চ সড়ক, দৈনিক বাংলা মোড় এবং মতিঝিল সড়ক, স্টেডিয়াম সড়ক পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজের সই করা এ সংক্রান্ত চিঠি পল্টন মডেল থানার ওসির কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, ২৮ অক্টোবর সমাবেশ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আয়োজনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি (মঞ্চ নির্মাণ ও প্রচার প্রচারণার কার্যক্রম) ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এমতাবস্থায়, স্বল্প সময়ের মধ্যে অন্য কোনো ভেন্যুতে নতুনভাবে সমাবেশের প্রস্তুতি গ্রহণ করা দুরূহ ব্যাপার। সমাবেশে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হবে।
সমাবেশ পল্টনেই, লোক হবে সোয়া লাখ: বিএনপি
বিএনপি আগামীকাল শনিবার মহাসমাবেশ রাজধানীর নয়া পল্টনে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই করতে অনড়। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পল্টন থানার ওসি মো. সালাউদ্দিন মিয়াকে দেওয়া চিঠিতে বিএনপির পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী চিঠিতে জানিয়েছেন, নয়া পল্টনে সমাবেশের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে এবং সেখানে সোয়া লাখের মতো লোকসমাগম হবে। সমাবেশ বেলা ২টায় শুরু হবে এবং মাগরিবের আজানের আগে শেষ হবে। সমাবেশে এক লাখ থেকে সোয়া লাখ লোক হতে পারে। সমাবেশটি পশ্চিমে বিজয়নগর মোড় ও পূর্বে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। সমাবেশে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা অংশ নেবেন না। সমাবেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দলের নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবকরা দায়িত্ব পালন করবেন, যার সংখ্যা হবে ৫০০ জন। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ নয়া পল্টনে বিএনপির প্রধান কার্যালয়ের সামনেই আয়োজনের সব প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। অন্য কোনো ভেন্যুতে যাওয়া সম্ভব হবে না।
অনুমতি মেলেনি তবুও অনড় জামায়াত
আগামীকাল শনিবার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে জামায়াত। যদিও প্রশাসনের তরফে এই কর্মসূচি পালনের অনুমতি মেলেনি এখনো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন নিবন্ধনহীন জামায়াত সমাবেশের অনুমতি পাবে না। সরকারের তরফে অনুমতি না দিলেও সমাবেশ সফল করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে জামায়াত। দলটির নেতারা জানিয়েছেন, যে কোনো মূল্যে সমাবেশ হবে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কিছু নেতাকর্মী ঢাকায় চলে এসেছেন। সমাবেশের আগে আরো আসবেন। জামায়াত নেতারা জানিয়েছেন, সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে চান তারা। সরকার বাধা দিয়ে পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করতে চাইছে। ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে অন্তত ৪ থেকে ৫ লাখ লোকের সমাগম ঘটানোর চিন্তা করছে জামায়াত। গতকাল বৃহস্পতিবার ভার্চ্যুয়ালি এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান এ মহাসমাবেশ সর্বাত্মকভাবে সফল করার জন্য দেশবাসীকে সার্বিক সহযোগিতার আহ্বান জানান। ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুলের উপস্থাপনায় সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আজাদ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসাইন, কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের ভারপ্রাপ্ত আমির আবদুর রহমান মুসা ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি রাজিবুর রহমান পলাশ। এদিকে এই মহাসমাবেশ সফল করতে গতকাল রাজধানী ঢাকাসহ জেলায় জেলায় বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ করেছে ইসলামী ছাত্রশিবির।