ঢাকাশনিবার, ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

হযরত মুহাম্মদ (সা) এর নেতৃত্ব ও রাজনীতি

মো. নিজাম উদ্দিন | রাজনৈতিক বিশ্লেষক
অক্টোবর ২, ২০২৩ ৯:৪৭ অপরাহ্ণ
Link Copied!

এক.

আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগে তিনি নারীর অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, কৃতদাসের অধিকারের কথা বলেছেন; এতিমের অধিকার, রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং মানবাধিকারের কথা বলে গেছেন। এক অন্ধকার সময়ে মরুর বুকে তিনি এসেছিলেন আলো হয়ে। পৃথিবীকে আলোকিত করতে। তিনি হজরত মুহাম্মদ (সা)। বিশ্ব মানবতার সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান। একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক। তিনি মদিনা রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তামাম দুনিয়ার শাসনব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য হযরত মুহাম্মদ (সা) এর পথ অনুসরণ যোগ্য- যেকোনো রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারকের জন্য। ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন বিশ্বাস, ভিন্ন গোত্রের মানুষ একটি রাষ্ট্র ও সমাজে কিভাবে শান্তিতে বসবাস করতে পারে তার শিক্ষা তিনি দিয়ে গেছেন স্পষ্ট ভাবে। তাঁর কথা ও কাজে। অন্ধকার যুগে তিনি ছিলেন আলোর দিশারী। মুক্তির মহানায়ক। ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আজ সারা দুনিয়ায় ইনসাফের কথা বলছে। ইসলামের পারিবারিক ব্যবস্থার কাছে আধুনিক যুগের পারিবারিক সব তত্ত্বই ভুল প্রমাণিত হচ্ছে।মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতের পরিপূর্ণ কল্যাণ একমাত্র আল্লাহ আদেশ এবং হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জীবনকে অনুসরণ করার মধ্যেই নিহিত। এখানে কোনো ‘যদি’ ‘এবং’ ‘কিন্তু’র জায়গা নেই!

 

আশ্চর্য জনক একটা বিষয় খেয়াল করে দেখবেন যখনই আপনি ইসলামের রাজনৈতিক দিকটা নিয়ে কথা বলবেন তখনই আপনাকে অন্য চোখে দেখা শুরু হয়ে যাবে। এই ইসলাম ফোবিয়ায় তামাম দুনিয়া আজ আক্রান্ত। এমনকি মুসলিম রাষ্ট্র গুলোও। কেউ এটা করছে তার চেয়ে প্রভাবশালীদের ভয়ে। কেউ আতংকে। কিংবা কেউ ইসলামের মহান শিক্ষার উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে। আপনি-আমি প্র্যাক্টিসিং মুসলিম না হলে সেই সীমাবদ্ধতা আপনার, আমার; ইসলামের নয়। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। অনু-পরমাণু পরিমাণ ভুল এখানে নেই। কোরআন আল্লাহর বাণী। হযরত মুহাম্মদ( সা.) আল্লাহর রাসুল।এই কথা তামাম দুনিয়ার সব মানুষের জন্য। কে, কী বেছে নিবে সেই সিদ্ধান্ত তাঁর। যে সমাজে মেয়ে শিশুদের জীবন্ত কবর দেয়া হত সেই সমাজে হযরত মুহাম্মদ (সা.) নারীর অধিকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। শিখিয়ে গেছেন রাষ্ট্র কীভাবে চালাতে হয় মদিনা সনদ এবং হুদাইবিয়ার সন্ধিটা পড়লে বুঝতে পারা যায় কত প্র্যাক্টিক্যাল ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর খলিফাদের খেজুর পাতার ছাউনিতে বসে অর্ধ পৃথিবী শাসন করার আদর্শিক শিক্ষা দিয়ে গেছেন তিনি। পঁচিশ বছরের যুবক হয়েও চল্লিশ বছরের এক বিধবা নারী হযরত খাদিজা (রা)কে বিয়ে করে যে সময়ে বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল সেই সময়ে নিজেই বিধবা নারীকে বিয়ে করে একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

 

দুই.

 

পাশ্চাত্য রাষ্ট্র দর্শনের বিপরীতে ইসলামের রাজনৈতিক দিক নিয়ে আলাপ আলোচনা কেন জানি তথাকথিত একটা সভ্য সমাজের অংশ সহ্য করতে পারেনা। এটা করলে তো জাতে উঠা যাবে না। সুযোগ মিলবে না। ঐ যে প্রভুরা নাখোশ হবে! দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাতেও ইসলামী রাষ্ট্র দর্শন, ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্র নায়ক হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে পাশ্চাত্য রাষ্ট্র দর্শন কিংবা তাত্ত্বিকদের তুলনায় খুব কমই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়।এটা খুব সচেতন ভাবেই করা হয়েছে। ভুল করে হয়েছে সে রকমটাও নয়। অথচ হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং চার খলিফার শাসন কিংবা পরবর্তী ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলন কী তুমুল ভাবেই না পরিবর্তনের ঝড় তুলেছে তামাম দুনিয়ায়। এই সব বিষয়ে তরুণদের জ্ঞান এবং চর্চাই একটা সভ্য দুনিয়ার একটা শক্ত পাটাতন নির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারে। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আগমন দুনিয়ার জঞ্জাল সাফ করতে যে ভূমিকা রেখেছে, কিয়ামত পর্যন্ত তা আর হবে না। হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর লাইফস্টাইল বা জীবন ব্যবস্থা মানবতার সকল সমস্যার সমাধান।

 

ঘৃণার বিপরীতে ভালোবাসার মহান শিক্ষা দেয় ইসলাম। জালিমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোরও শিক্ষা দেয় ইসলাম। অশান্তির দুনিয়ায় শান্তির মহান বার্তা দেয় ইসলাম। আর হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন দুনিয়ার মানুষের সামনে একমাত্র সফলতা ও মুক্তির পথ। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন হচ্ছে পরিপূর্ণ ইসলামের একটা রিফ্লেকশন। জীবন সুন্দর একমাত্র হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর জীবনকে অনুসরণের মাধ্যমেই। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের আবেগ অনুভূতি বিশ্বাস শর্তহীন ভালোবাসার নাম হযরত মুহাম্মদ (সা.)। যিনি উম্মতের জন্য কাঁদেন। যাঁর সুপারিশ ছাড়া কেউ জান্নাতে যাবে না। যার রওজা মোবারক জিয়ারতের স্বপ্ন প্রতিটি মুসলমান লালন করে। অন্ধকার এক সময়ে আলোর মশাল নিয়ে এসেছিলেন তিনি। একজন নবী, একজন রাসুল, একজন মানুষ হিসেবে সারা দুনিয়ার জন্য তিনি রহমত স্বরূপ।

 

হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কাছেই বিশ্বমানবতার মুক্তির সনদ পবিত্র আল কোরআন নাজিল হয়। আল কোরআন শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও শুধু মুসলমানদের জন্য নন, সারা পৃথিবীর মানুষের মুক্তির জন্য।

 

তাঁর জন্মস্থান মক্কা থেকে মদিনায় চলে যাওয়ার যে রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং ইনসাফ ভিত্তিক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাংখা সেটা সব রাজনৈতিক নেতাদের এক মহান শিক্ষা। সত্য ও ন্যায়ের পথ বড় কঠিন- হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

 

তিন.

 

ইসলাম একটি বৈপ্লবিক ধর্ম। হযরত মুহাম্মদ (সা)পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী এবং সমাজ সংস্কারক। দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ একমাত্র তাঁর জীবন দর্শনে। তাঁর বিদায় হজ্জের ভাষণ এখনো বিভক্ত পৃথিবীতে চিরন্তন শান্তির বাণী। অনেক বিশ্বনেতাদের বক্তব্য পড়েছি কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিদায় হজ্জের ভাষণে মানবাধিকার, মানুষের অধিকার, শান্তির বাণী, ইনসাফের কথা যেভাবে আছে এত সুন্দর বক্তৃতা আর একটিও নেই। তখন থেকে এখনও। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। হযরত মুহাম্মদ(সা.) সেই পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সমস্যা হচ্ছে আমরা শুধু রাসুল (সা) এর ধর্মীয় জীবনটা নিয়ে আলোচনা করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি কিন্তু তিনি যে মদিনা রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, প্রধান বিচারপতি ছিলেন, সমাজ সংস্কারক ছিলেন, সেই সব বিষয় গুলো এড়িয়ে যাই। কারণ এসব বিষয়ে কথা বললে ঝুঁকি বেশি, তাই! হযরত মুহাম্মদ (সা) মদিনায় মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টান এবং পৌত্তলিকদের নিয়ে যে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এমন ইনসাফ ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই মানুষের আকাংখা।

 

অথচ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কেও তাঁর দেশে তাঁর কাছের, গোষ্ঠীর, রক্তের সম্পর্কের মানুষ গুলো থাকতে দেয় নাই। চলে যেতে হয়েছে মক্কা ছেড়ে মদিনায়। ছাড়তে হয়েছে দেশ,মাটি, মাতৃভূমি। মুখোমুখি হতে হয়েছে সশস্ত্র যুদ্ধের। অচেনা মানুষ আপন হয়েছে। চেনা মানুষ গুলো হয়েছে চরম পর্যায়ের শত্রু। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি আল্লাহর বাণী প্রচার করতেন, মানুষকে সত্য এবং ন্যায়ের কথা বলতেন, ইনসাফ ভিত্তিক একটি সমাজের দিকে ডাকতেন। তিনি যে পথ দেখিয়েছেন একমাত্র সেই পথেই মানুষের মুক্তি।

 

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক