সাভারের ট্যানারি শিল্পের প্লট বরাদ্দ পাওয়ার পরও যেসব প্রতিষ্ঠান লিজ চুক্তি সম্পাদন করেনি এবং হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী কমপ্লায়েন্স অর্জন করেনি, তাদের বরাদ্দ সাময়িক বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ১৪০টি চালু কারখানার মধ্যে ১০০টির লিজ চুক্তি নেই। তাই বরাদ্দ বাতিলের পরিণতি খুব ভালো সিদ্ধান্ত হবে না।
বিশ্লেষকদের মতে, দেশের চামড়া খাতের প্রধান সমস্যা কমপ্লায়েন্সের অভাব। এ সমস্যার কারণে এ খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ফলে একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় বাজারেও চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। চামড়া শিল্পের উন্নয়নে সাত বছর আগে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সব ট্যানারি কারখানা সরিয়ে নেওয়া হয় সাভারের বিসিক চামড়া শিল্পনগরীতে। কিন্তু যে প্রত্যাশা নিয়ে চামড়া নগরী স্থাপন করা হয়, তা এখনও পূরণ হয়নি, বরং বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে এই খাতে।
গত মাসে অনুষ্ঠিত পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই বৈঠকে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিবসহ বিশেষ আমন্ত্রণে শিল্প সচিব, বাণিজ্য সচিব, বিসিক চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চামড়া শিল্পনগরীতে মোট প্লট সংখ্যা ২০৫টি। এর মধ্যে ১৬২টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে উৎপাদনে রয়েছে ১৪০টি প্রতিষ্ঠান। উৎপাদনে থাকা সব ট্যানারিই পরিবেশগত ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছে। বরাদ্দ দেওয়া ১৬২টি প্লটের মধ্যে মাত্র ৩২টি প্লটের জমি রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়েছে। ১০০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ নেওয়ার নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও লিজ চুক্তি করেনি। কারণ ট্যানারি মালিকরা বলছেন, অর্থাভাবে তারা চুক্তি সম্পাদন করতে পারছেন না। চুক্তির আগে তাদেরকে হাজারীবাগের জমি ফিরিয়ে দিতে হবে।
এ বিষয়ে রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিয়া সংস্থাটির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। আশরাফুল ইসলাম বলেন, আগামী এক মাসের মধ্যে এ সমস্যার সমাধন হচ্ছে। হাজারীবাগের ওই স্থানে ‘ঢাকা আরবান রি-জেনারেশন প্রজেক্ট’ নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের বিস্তারিত পরিকল্পনা এক মাসের মধ্যে প্রকাশ করা হবে। এ প্রকল্পের আওতায় হাজারীবাগের ওই জমিতে খেলার মাঠ, আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা থাকবে। বেড়িবাঁধ পর্যন্ত একটা প্রশস্ত রাস্তা নির্মিত হবে। পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে প্রকাশের পরেই ট্যানারি মালিকরা তাদের জমির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এ প্রকল্পের বাইরে যাদের জমি থাকবে তারা নিজেদের ইচ্ছায় জমি ব্যবহার করবেন। আর যাদের জমি প্রকল্পের মধ্যে পড়বে, তারা ক্ষতিপূরণ পাবেন।
পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই অনেকের
সংসদীয় কমিটির বৈঠকের কার্যপত্রে বলা হয়েছে, চালু কারখানার মধ্যে আদালতের নির্দেশনা শতভাগ পালন এবং অভ্যন্তরীণ কমপ্লায়েন্স সন্তোষজনক সাপেক্ষে এ পর্যন্ত ৮৯টি ট্যানারিকে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। একই বিবেচনায় ৪৩টি ট্যানারির পরিবেশগত ছাড়পত্র নবায়ন করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় পরিবেশগত ছাড়পত্র ফি এবং কাগজপত্র জমা না দেওয়ায় বাকিদের পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়া সম্ভব নয়। এতে আরও বলা হয়, পরিবেশগত ছাড়পত্রের জন্য আবেদন না করা এবং আদালতের নির্দেশনা অমান্য করায় জহির ট্যানিং ইন্ডাস্ট্রিজ, ইসমাইল লেদার, এসঅ্যান্ডএস ট্যানারি, মেসার্স মমতাজ ট্যানারি, মেসার্স লিয়েন এন্টারপ্রাইজ– এই ৫টি ট্যানারি প্রতিষ্ঠানের সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। শর্ত পূরণ করায় পরবর্তী সময়ে তাদের পরিবেশগত ছাড়পত্রও দেওয়া হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদ জানান, চলতি বছর ২৫ জুলাই পর্যন্ত ১২৫টির বেশি ট্যানারি পরিদর্শন করা হয়েছে। এর মধ্যে আলেয়া ট্যানারির সেবা সংযোগ (পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ) বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
কমপ্লায়েন্স অর্জন ও সিইটিপি নিয়ে কমিটির উদ্বেগ
ওই বৈঠকে সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এর আগে ট্যানারি শিল্পের কমপ্লায়েন্স অর্জনে নেওয়া সিদ্ধান্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চেয়ে বলেন, যথার্থ মান অর্জিত না হওয়ায় সম্ভাবনাময় একটি খাত রপ্তানির ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছে। শুধু পরিবেশ আইনের বিষয় নয়; কমপ্লায়েন্স অর্জিত না হওয়ায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজার হারাচ্ছে।
বৈঠকে বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, পরিবেশ আইনে যেসব প্যারামিটার অনুযায়ী কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পরিচালিত হওয়ার কথা, তা হয়নি। এ ছাড়া লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের মান অনুযায়ীও হয়নি। ফলে চামড়া রপ্তানিতে দেশ পিছিয়ে যাচ্ছে। তৈরি পোশাক বাদে চামড়াসহ অন্য সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চীন বা যেসব দেশ কমপ্লায়েন্সের বিষয়টি খুব ভালোভাবে দেখে না, সেখানে হয়তো রপ্তানি করা যাচ্ছে। কিন্তু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে চামড়া রপ্তানি করা যাচ্ছে না। শুধু কিছু চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে।
সিনিয়র সচিব আরও বলেন, কমপ্লায়েন্স অর্জন বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তবে ট্যানারি মালিকদের দাবি অনুযায়ী, হাজারীবাগে তাদের জমির বিষয়টি সুরাহা হওয়া দরকার। রাজউক থেকে উক্ত জমি বুঝিয়ে দেওয়া বা সেখানে কী করবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। দীর্ঘ ৭-৮ বছর ধরে তারা সেখান থেকে কোনো আয় করতে পারছে না। ট্যানারি মালিকদের হাজারীবাগের জমি রাজউক রিলিজ করে দিলে তারা এত অজুহাত দিতে পারবে না। এ ছাড়া সিইটিপিকে নতুনভাবে স্থাপন বা এটি সংশোধনযোগ্য হলে কোনো কোম্পানিকে দিয়ে তা করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ১৪০টি চালু কারখানার মধ্যে যদি ১০০টির লিজ চুক্তি না থাকে, এই ১০০টির বরাদ্দ বাতিল করার পরিণতি খুব ভালো নয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চায় কারখানা চালু রেখে কমপ্লায়েন্স অর্জিত হোক। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে, রাজউক চেয়ারম্যান, লেদার গুডস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট, শিল্প সচিব এবং পরিবেশ সচিবের সমন্বয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।
বৈঠকে উপস্থিত বিসিক চেয়ারম্যান মুহ. মাহবুবর রহমান বলেন, চামড়া শিল্পের জন্য প্রায় ২০০ একর জমি রয়েছে। এখানে সিইটিপির জন্য ১৭ একর জমি রাখা হয়েছিল। ২০৫ প্লটের মধ্যে ১৬২টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হলেও মাত্র ৩২টি প্লটের জমি রেজিস্ট্রি করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। প্রায় ১০০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান কোনো টাকাই পরিশোধ করেনি। ফলে লিজ চুক্তি করা সম্ভব হয়নি। ৫ বছরের মধ্যে লিজ চুক্তির টাকা পরিশোধ করার বিধান রয়েছে। পাঁচ বছর পার হলেও কেউই টাকা পরিশোধ করছে না। শিল্প মালিকদের কমপ্লায়েন্স অর্জনের জন্য অর্থ প্রয়োজন। কিন্তু লিজ চুক্তি না থাকার কারণে ব্যাংক থেকে তারা ঋণ নিতে পারে না।
বৈঠকে বিশেষ আমন্ত্রণে অংশ নেওয়া শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা বলেন, ট্যানারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কমপ্লায়েন্স অর্জন এবং লিজ চুক্তি বিষয়ে সময় বেঁধে দেওয়া হলেও তাদের বক্তব্য– টাকার অভাব। তারা হাজারীবাগের জমি ফেরত চায়। সেখানে তাদের অনেক ঋণের দায় রয়েছে। এগুলোর সমাধান হলে তারা ধীরে ধীরে টাকা দিতে পারবে। তিনি নির্ধারিত তারিখের মধ্যে টাকা পরিশোধ না করলে বরাদ্দ বাতিলের পক্ষে মত দেন।
সিইটিপি সম্পর্কে শিল্প সচিব বলেন, সিইটিপি বিষয়ে অনেক বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি কোম্পানি সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট এবং সিইটিপি নবায়নের কাজ করতে আগ্রহী। সম্পূর্ণ অর্থায়ন তারা করবে, শুধু সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তারা প্রতি বর্গমিটারের জন্য ১৭৫ টাকা নেবে।
বৈঠকে উপস্থিত বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) জিএম (প্ল্যানিং) জানান, বর্তমানে প্রতি বর্গফুট চামড়ায় ৭০ থেকে ৮০ সেন্ট মূল্য পাওয়া যায়। কমপ্লায়েন্স সিলভার অর্জন করলে এটি আড়াই ডলারে যাওয়া সম্ভব। প্রতি বর্গমিটারে ১৭৫ টাকা প্রতিবেশী দেশের তুলনায় অনেক কম। বর্তমানে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বিসিককে প্রতি বর্গমিটারের জন্য মাত্র ২৫ টাকা পরিশোধ করে। এই ২৫ টাকা দিলে কখনও কমপ্লায়েন্স অর্জিত হবে না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং সিইটিপিতে উন্নতি না করলে কখনও লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সনদ পাওয়া যাবে না।
বৈঠকে পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, কমিটির প্রস্তাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয় একমত হতে পারছে না। তবে এ বিষয়ে পরিষ্কার একটি ঘোষণা থাকা প্রয়োজন। কারণ এ শিল্পের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে এবং দেশ চামড়া শিল্পে বিশ্ববাজারও হারাচ্ছে।