সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ চেয়ে এবং সরকারের বিরুদ্ধে ‘কুৎসা রটনা করে আপত্তিকর স্ট্যাটাস’ দেয়ার অভিযোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সহযোগী অধ্যাপক মাইদুল ইসলামকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) চিঠি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে এবং শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধান পরিপন্থি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে শিক্ষক মাইদুল দাবি করেছেন, তার ব্যক্তিগত মতামতের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির সম্পর্ক নেই।
জানা গেছে, শোকজ চিঠিতে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে লিখিত জবাব দিতে বলা হয়েছে। বুধবার (২৪ আগস্ট) বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষর করা চিঠি ই-মেইল ও স্থানীয় ঠিকানায় পাঠানো হয়। এর আগে গত রোববার ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে উপাচার্যকে চিঠি দেয় চবি শিক্ষক সমিতি।
মাইদুল ইসলাম সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। বর্তমানে তিনি গবেষণা ছুটি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ার পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। সেখানে থাকা অবস্থায় এ বিষয়ে মতামত জানতে চেয়েছিল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। পরে তিনি লিখিতভাবে মতামত জানিয়েছেন।
মাইদুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আমাকে ১৫ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর জন্য নোটিশ দিয়েছে। যে জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে, এটি কোন আইনের বলে দিয়েছে, আমি তা জানতে আগ্রহী। ইমেইলে আমাকে পাঠানো চিঠির ভাষ্যমতে, আমি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়েছি এবং সরকারের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রটনা করেছি, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুণ্ণ হয়েছে। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি আমার রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করেছি। এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার কোন সম্পর্কই নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমি জানতে আগ্রহী কোন নিক্তি দিয়ে শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়া পরিমাপ করলেন এবং ভাবমূর্তি রক্ষার এই কর্তৃত্ত্ব তাঁদের ওপর কে অর্পণ করলেন? তাছাড়া কোথায় কুৎসা রটনা করলাম, চিঠিতে তার কোনো সংযুক্তি নেই। মনগড়া অভিযোগে বেআইনিভাবে আমার প্রতি আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে চায় শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষক সমিতি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উভয়ের কাছে আমি জানতে চাই, কেন আমি আমার সাংবিধানিক অধিকার চর্চা করতে গিয়ে বাধার শিকার হব?’
মাইদুল ইসলামের ভাষ্য, ‘একেবারে সহজ কথা হল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বা সরকারের পদত্যাগ চাওয়া কোনো অপরাধ নয়, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের চর্চা মাত্র। আর এ চাওয়াটা আমার রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক অধিকার। এটি কুৎসা হবে কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে কেন? কীভাবে, কখন, কোথায় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হল? কার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হল?’
তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা যখন আতংকে বাস করে, শিক্ষার্থীদের হলগুলো যখন সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের আখড়ায় পরিণত হয়, হলের মানহীন থাকার পরিবেশ, ডাইনিং এ মানহীন খাদ্য পরিবেশন করা হয়, যখন অর্থের বিনিময়ে অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য হয়, টেন্ডারবাজি হয়, ছাত্র-শিক্ষককে নিপীড়ন করা হয়, কোন শিক্ষককে হত্যার উদ্দেশ্যে বিভাগে, বাসায় আক্রমণ করা হয়, কারাগারে এবং রিমান্ডে নিক্ষেপ করা হয়, শিক্ষক সমিতি ট্রেড ইউনিয়ন না হয়ে যখন সরকার দলীয় সংগঠনে পরিণত হয়, তখন কী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় না?’
এই শিক্ষক বলেন, ‘আমাদের চোখের সামনেই জলজ্যান্ত একজন শিক্ষার্থী দিয়াজকে হত্যা করা হল টেন্ডারের টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে, তাঁর কি বিচার হয়েছে? দিয়াজের মা ছেলের শোকে কান্না করতে করতে পাগল হয়ে গেছে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি কোথায় থাকে? বিরুদ্ধমত দমনের যে পদ্ধতি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি নজিরবিহীনভাবে তা আত্মস্থ করার মধ্য দিয়ে শিক্ষাঙ্গনের স্বাধীনতাকে অনেক নিচে নামিয়ে আনল। শিক্ষক সমিতি এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাক স্বাধীনতার প্রতি চূড়ান্ত অসহিষ্ণুতা দেখালো, যা আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট।’
এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নুর আহমেদ বলেন, ‘আমরা দেখেছি তিনি সরকারবিরোধী বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণা করেছেন। এতে আমরা মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের মান-সম্মান ক্ষুন্ন হয়েছে। তাই আমরা তাকে শোকজ করেছি। তিনি এখনো আমাদের কোনো জবাব দেননি। জবাব দিলে সেটার ওপর ভিত্তি করে আমরা ব্যবস্থা নেব। কি ব্যবস্থা নেব, সেটি পরে সিদ্ধান্ত হবে। শিক্ষক সমিতি আবেদন না করলেও আমরা তাকে শোকজ করতাম। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান-সম্মানের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। না হলে বিশ্ববিদ্যালয় তাকে শোকজ করতো না।’