খন্দকার মোশতাকের ৮১ দিনের শাসনামলে সঙ্গী ছিলেন বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার ২১ সদস্য। মোশতাকের উপরাষ্ট্রপতি হলেন মোহাম্মদউল্লাহ। আর মন্ত্রীসভার সদস্যরা হলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর, পরিকল্পনামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী, অর্থমন্ত্রী ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, শিক্ষামন্ত্রী ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবদুল মান্নান, কৃষি ও খাদ্যমন্ত্রী আবদুল মোমিন, এলজিআরডি মন্ত্রী ফণিভূষণ মজুমদার, নৌপরিবহনমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, গণপূর্ত ও গৃহায়নমন্ত্রী সোহরাব হোসেন। প্রতিমন্ত্রীরা হলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী কে এম ওবায়দুর রহমান, ভূমি ও বিমান প্রতিমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, রেল ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, শিল্প প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলাম চৌধুরী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডল, পশু ও মৎস্য প্রতিমন্ত্রী রিয়াজউদ্দিন আহমদ ভোলা মিয়া, যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আলতাফ হোসেন ও মোমিনউদ্দিন আহমদ (বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভায় ছিলেন না)।
মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী রাষ্ট্রপতি মোশতাকের প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা হয়েছিলেন মন্ত্রীর সমমর্যাদায়। খন্দকার মোশতাক সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের পথ উন্মুক্ত করে দেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মহিউদ্দীন আহমদ বিশেষ দূত হয়ে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৫ আগস্ট সংঘটিত হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে ৮ আগস্ট দেশে ফিরে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের আরেক রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহর স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে প্রবর্তন হয়েছিল বাকশালব্যবস্থা। বাকশালব্যবস্থার অধীনে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হলে মোহাম্মদউল্লাহ মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে শপথ নেন। ১৫ আগস্টের পর মোশতাকের উপরাষ্ট্রপতি হন মোহাম্মদউল্লাহ। পরে বিএনপিতে যোগ দেন তিনি।
মোশতাক জাতীয় সংসদ বহাল রেখেছিলেন। স্পিকার ছিলেন আবদুল মালেক উকিল। স্পিকার হওয়ার আগে ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি স্পিকার হিসেবে বিদেশে স্পিকারদের একটি সম্মেলনেও যোগ দেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর মোশতাকেরও আইনমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। তিনি কুখ্যাত ইনডেমনিটি নামক বিলটির রচয়িতা। মোশতাকের পতনের পর ফণিভূষণ মজুমদার, আবদুল মান্নান, আবদুল মোমিন, সোহরাব হোসেন, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, আবদুল মালেক উকিল, আসাদুজ্জামান খান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। মালেক উকিল আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন শেখ হাসিনা নেতৃত্বে আসার আগ পর্যন্ত। অধ্যাপক ইউসুফ আলী মোশতাকের পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন। পরে তিনি আওয়ামী লীগের (মিজান) সাধারণ সম্পাদক হন। পরে যোগ দেন জিয়ার মন্ত্রীসভায়। জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদেরও মন্ত্রী হন তিনি।
আবু সাঈদ চৌধুরী আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে না এলেও মহিউদ্দীন আহমদ ফিরে আসেন। ১৯৮৩ সালের ৮ আগস্ট তিনি বহিষ্কার হলে বাকশাল গঠন করে তার চেয়ারম্যান হন। ১৯৯৩ সালে বাকশাল আওয়ামী লীগে অন্তর্ভুক্ত হলে তাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়। বেঁচে নেই তিনিও। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হলেও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজিত হন। আবদুল মান্নান ও আবদুল মোমিনও বেঁচে নেই। ২০০২ সাল পর্যন্ত দুজনই আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। খন্দকার আসাদুজ্জামান আওয়ামী লীগে সক্রিয় ছিলেন।
মোশতাক মন্ত্রীসভার সদস্য দেওয়ান ফরিদ গাজী আওয়ামী লীগের এমপি ও উপদেষ্টা পরিষদেরও সদস্য ছিলেন। ১৯৯৬ সালেও এমপি ছিলেন। সৈয়দ আলতাফ হোসেন বাকশাল প্রবর্তনের পর (ন্যাপ মোজাফফর) থেকে প্রতিমন্ত্রী হন। পরে মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী। মোশতাকের পতনের পর আবার ন্যাপের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। মোমিনউদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভায় না থাকলেও মোশতাক তাকে প্রতিমন্ত্রী করেন। পরে তিনি বিএনপি হয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। রিয়াজউদ্দিন আহমদ ভোলা মিয়াও বিএনপি হয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হন। ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডলও জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হন। মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী। তিনি সামরিক বাহিনীর সমর্থন আদায়ে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি মোশতাকের সরকারের প্রতি সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে আনুগত্য প্রকাশ করতে খুব একটা দেরি হয়নি কে এম শফিউল্লাহর। বিমানবাহিনী প্রধান এ কে খন্দকার ও নৌবাহিনী প্রধান এম এইচ খানকে নিয়ে প্রথম দিনেই মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন তিনি। পরে অবশ্য কয়েক দিনের মধ্যেই কে এম শফিউল্লাহ ও এ কে খন্দকারকে যথাক্রমে জিয়াউর রহমান ও এম জি তায়েবের কাছে সেনা ও বিমানবাহিনী প্রধানের পদ ছেড়ে দিতে হয়। এর কয়েক দিন পরই কে এম শফিউল্লাহ রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়ে চলে যান বিদেশে। জিয়া ও এরশাদ সরকারের পুরোটা সময় তিনি বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। সেই কে এম শফিউল্লাহ পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ১৯৯৬ সালে এমপি নির্বাচিত হন। প্রায় একইভাবে এ কে খন্দকারও বিদেশে বাংলাদেশের মিশনে দায়িত্ব নেন। প্রথমে অস্ট্রেলিয়া ও পরে ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনের দায়িত্ব পালন করেন। ফিরে এসে এরশাদ সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে কিছু দিন কাজ করে দায়িত্ব নেন পরিকল্পনামন্ত্রীর। পরে বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রথম মেয়াদের সরকারে পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব পান এ কে খন্দকার।
অন্যদিকে, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে পরিবারসহ হত্যার পর ২৩ আগস্ট মোশতাক সরকার গ্রেপ্তার করে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, শেখ আবদুল আজিজ, আবদুস সামাদ আজাদ, এম কোরবান আলী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, হাশেম উদ্দিন পাহাড়িসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে। ৩ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গ্রেপ্তার অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে। এর আগে ৬ সেপ্টেম্বর জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ এবং কয়েক দিনের ব্যবধানে আমির হোসেন আমু, গাজী গোলাম মোস্তফা, এম এ জলিল, এম এ মান্নান, সরদার আমজাদ হোসেন, নুরুল হক, এম শামসুদ্দোহা, এম মতিউর রহমানসহ বেশ কিছু নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।