দেশে বিদ্যমান দুটি এলএনজি টার্মিনালের দৈনিক সরবরাহ সক্ষমতা ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার আরেকটি এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে বেসরকারি খাতের সামিট গ্রুপ। অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে এক্সিলারেট এনার্জির দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার আরেকটি টার্মিনাল। প্রস্তাবিত এ দুই টার্মিনাল প্রস্তুত হলে দেশে এলএনজি টার্মিনালগুলোর দৈনিক সরবরাহ সক্ষমতা ২ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ছাড়িয়ে যাবে।
মজুদ সক্ষমতা বাড়লে এর সঙ্গে সংগতি রেখে আমদানি বাড়াতে হবে এলএনজির। অন্যথায় অব্যবহৃত সক্ষমতার বিপরীতে পেট্রোবাংলাকে গুনতে হবে বাড়তি ক্যাপাসিটি চার্জ। আবার সংস্থাটির ঋণের বোঝাও এখন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। পেট্রোবাংলার ক্রমবর্ধমান লোকসান ও ঋণচাপ এবং দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এ আমদানি কতটা বাড়ানো সম্ভব হবে, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন সংশ্লিষ্টরা। জ্বালানি বিভাগসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান নিয়ে এখন পর্যন্ত স্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
দেশে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়া গ্যাসের প্রায় ৭৫ শতাংশই সরবরাহ হয় স্থানীয়ভাবে। বাকি ২৫ শতাংশের সংস্থান হয় এলএনজি আমদানির মাধ্যমে। এজন্য প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন পড়ছে পেট্রোবাংলার। গত পাঁচ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে সংস্থাটিকে ব্যয় করতে হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটিরও বেশি টাকা। বর্তমানে এলএনজির আমদানি আরো বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গত জুনে কাতার ও ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি দুটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে জ্বালানি বিভাগ। এছাড়া স্পট মার্কেট থেকেও আমদানি হচ্ছে এলএনজি।
পেট্রোবাংলার আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রিগ্যাসিফিকেশন চার্জসহ সংস্থাটির এলএনজি আমদানি বাবদ ব্যয় হয় ১১ হাজার ৮১২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৬টি কার্গো এলএনজি আমদানি করে পেট্রোবাংলা। এর জন্য সংস্থাটিকে গুনতে হয় ১৭ হাজার ৫০২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে ৭২টি কার্গো আমদানির বিপরীতে ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যয় হয় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে জ্বালানি পণ্যটি আমদানিতে পেট্রোবাংলার ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ৩৮ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। গত দুই অর্থবছরের চূড়ান্ত আর্থিক প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ করেনি পেট্রোবাংলা। তবে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) এলএনজির আমদানি ব্যয় ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার অন্তত চার কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্যাসের সরবরাহ ঠিক রাখতে জ্বালানি বিভাগ বদ্ধপরিকর। এজন্য স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেয়ার পাশাপাশি এলএনজি আমদানির বিষয়গুলোও চূড়ান্ত করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে স্থানীয় গ্যাসের বড় কোনো উৎস না পাওয়া গেলেও যাতে আমদানির মাধ্যমে ঘাটতি সামাল দেয়া যায়, সেজন্য এলএনজির সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গ্যাসের সরবরাহ ঠিক রাখায় সবচেয়ে বড় বাধা হলো ডলার সংকট।
তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী বাড়তি এলএনজি আমদানি করতে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান কীভাবে হবে জানতে চাইলে স্পষ্ট কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
পেট্রোবাংলার দাবি, এলএনজি আমদানি চুক্তির পাশাপাশি এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান নিয়েও নিশ্চিতভাবেই সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে পেট্রোবাংলাও পরিকল্পনা করবে। নতুন চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানিতে এখনো অনেক সময় বাকি। তার আগেই সমাধান পাওয়া যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী কামরুজ্জামান খান বলেন, ‘দেশে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর জন্য কাতার ও ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে চুক্তি করা হয়েছে। এছাড়া একটি এলএনজি টার্মিনালও অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সবকিছুই হলো নির্বিঘ্নে গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনার অংশ। আর গ্যাস যেহেতু কিনতে হবে, সেহেতু অর্থসংস্থানের বিষয়টি নিয়েও পরিকল্পনার দরকার আছে। পেট্রোবাংলার সে পরিকল্পনা রয়েছে।’
দেশে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে স্থানীয় পর্যায়ে উত্তোলনকারী দেশী-বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কিনছে পেট্রোবাংলা। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি সরবরাহ করছে কাতারের রাস লাফফান লিকুইফায়েড ও ওমানের ওকিউ ট্রেডিং। এছাড়া স্পট মার্কেটে সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকেও এলএনজি কেনা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে এরই মধ্যে পেট্রোবাংলার বিপুল পরিমাণ দেনা জমা হয়েছে। গত জুন পর্যন্ত এ দেনার পরিমাণ ৪৬ কোটি ৭০ লাখ ডলারের বেশি ছিল বলে জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে কিছু পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি অর্থ পরিশোধের জন্য পেট্রোবাংলাকে নতুন করে ঋণ নিতে হচ্ছে।
অর্থসংস্থানের জন্য মে মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ৭ হাজার ১৮১ কোটি টাকা ঋণ চায় পেট্রোবাংলা। এ-সংক্রান্ত আবেদনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে ২০১৮ সালের পর থেকে প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার কোটি টাকা লোকসান করেছে পেট্রোবাংলা। দিন দিন এ বোঝা বেড়েই চলেছে। বিশ্ববাজারে উচ্চমূল্যের কারণে কেবল ২০২২ সালের মে থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত জ্বালানিটি আমদানি করতে ৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি লোকসান গুনতে হয়েছে সংস্থাটিকে।
এলএনজি সরবরাহ বাড়ানোর জন্য কাতারের সঙ্গে পেট্রোবাংলার নতুন চুক্তি সই হয় ১ জুন। এ চুক্তি অনুযায়ী বছরে ১ দশমিক ৮ থেকে আড়াই মিলিয়ন টন পর্যন্ত বাড়তি এলএনজি সরবরাহ করবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠান রাস লাফফান লিকুইফায়েড। ১৫ বছর মেয়াদি এ চুক্তির আওতায় এলএনজি আসার কথা ২০২৬ সাল থেকে। চুক্তির মেয়াদকাল ২০৪০ সাল পর্যন্ত। গত ১৯ জুন ওমানের ওকিউ ট্রেডিংয়ের সঙ্গে নতুন চুক্তি সই করে পেট্রোবাংলা। ১০ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় বছরে এলএনজি আসার কথা সর্বোচ্চ দেড় মিলিয়ন টন। এর আওতায় এলএনজি আমদানি শুরু হওয়ার কথা ২০২৬ সাল নাগাদ।
এলএনজি টার্মিনালের ক্ষেত্রে সক্ষমতার নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ ব্যবহার না করলেও বিদ্যুতের মতোই ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাড়তি সক্ষমতা স্থাপনের পরেও যদি উচ্চমূল্যের কারণে এলএনজি আমদানি করা না যায়, পেট্রোবাংলাকে তখন টার্মিনালগুলোর সক্ষমতা বাবদ বিপুল অংকের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে।
অর্থ সংকটের কারণে এখন বিদ্যমান টার্মিনালেই পূর্ণ সক্ষমতায় এলএনজি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত অর্থবছরে এলএনজি আমদানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন টন। চাহিদা বেশি থাকায় চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সরবরাহ হয় ৩ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন টনের মতো। যদিও বিদ্যমান দুটি এলএনজি টার্মিনালের বার্ষিক সরবরাহ সক্ষমতা ৭ দশমিক ২ মিলিয়ন টন।
খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দেশে সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে গিয়ে গ্যাস সরবরাহকারীদের কাছে এরই মধ্যে দায়গ্রস্ত হয়ে পড়েছে পেট্রোবাংলা। বিপুল পরিমাণ এ দেনার অর্থ নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে সক্ষমতা ও আমদানি বাড়ানোর পরিকল্পনা জ্বালানি বিভাগকে আরো সংকটে ফেলে দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম এ বিষয়ে বলেন, ‘এলএনজি আমদানির জন্য আমাদের দুটি রিগ্যাসিফিকেশন টার্মিনাল রয়েছে। অর্থ সংকটের কারণে পর্যাপ্ত এলএনজি আমদানি করতে না পারায় টার্মিনালগুলোর পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এগুলোর বার্ষিক সরবরাহ সক্ষমতা প্রায় সাড়ে সাত মিলিয়ন টন। দুটি দেশ থেকে দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি আমদানির চুক্তি রয়েছে সাড়ে তিন মিলিয়ন টনের কিছু বেশি। বাকি সক্ষমতার এলএনজি স্পট মার্কেট থেকে কেনার পরিকল্পনা ছিল জ্বালানি বিভাগের। কিন্তু স্পট মার্কেটের অস্থিতিশীল মূল্য পরিস্থিতির কারণে পরবর্তী সময়ে আর এলএনজি কেনা যায়নি। যে কারণে প্রায় অর্ধেক সক্ষমতা বসেই থাকছে।’