ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ুর স্বাভাবিক আচরণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য। অতি সম্প্রতি কালের গবেষণায় দেখা গেছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত কুমেরু ও হিমালয়ের বরফ গলে বাড়ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা, জলবায়ুর সাম্যাবস্তা ভেঙে যাওয়ায় অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ভূমিকম্প, জলকম্পের ঘটনাও বাড়ছে, নষ্ট হচ্ছে স্থল ও জলজ জীববৈচিত্র্য। জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব পড়ছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর, যেমন- শুষ্ক এবং প্রায় শুষ্কভূমির পরিবেশ, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় পরিবেশ, কৃষি পরিবেশ, বন পরিবেশ, দ্বীপ পরিবেশ, পর্বত পরিবেশ, মেরু পরিবেশ প্রভৃতি।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন দিক :
১৯৮০’র দশক থেকে গ্রিন হাউস গ্যাসের প্রভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে প্রতিবছর গড়ে ০.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রতিনিয়ত এই উষ্ণায়নের ফলে সুমেরু অঞ্চলে বরফ গলার পরিমাণ আগের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, জলবায়ুর এ পরিবর্তন রোধ করা না গেলে অচিরেই সর্বনাশা ক্ষতি হবে, যেমন- সাগরের উচ্চতা কয়েক মিটার বেড়ে গিয়ে তালিয়ে যাবে উপকূলবর্তী অনেক শহর-বন্দর। গ্রিনল্যান্ডের বরফের ছাদ গলে যাবে, প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের প্রায় ২৫ ভাগ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে দেখা দিতে পারে খরা, তাপপ্রবাহ ও অনাবৃষ্টি, ফলে ফসল উৎপাদন ও জীবন ধারন অসম্ভব হয়ে পড়বে। অরণ্য সম্পদ ও ধ্বংস হয়ে যাবে অনেকাংশে। ইতোমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের এসব প্রভাবের কিছু কিছু ঘটতে শুরু করেছে। ফলে সারা বিশ্বেই জলবায়ু সংরক্ষণের জন্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশ : সাম্প্রতিককালে সাতজন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের আশঙ্কা সত্যি হলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ এলাকা সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। ফলে কোটি কোটি মানুষ হবে পরিবেশ শরণার্থী। খাদ্যশস্যের উৎপাদন ব্যাহত হবে, দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর প্রকোপ বাড়বে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ দেশের জীববৈচিত্র্য। জলবায়ু পরিবর্তনের যে সম্ভাব্য প্রভাব বাংলাদেশে ঘটতে পারে।
তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :
(১) সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের প্রায় ১২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হতে পারে।
(২) সুন্দরবনের অনেকাংশ সমুদ্রে তলিয়ে গিয়ে জীববৈচিত্র্য ও উদ্ভিদ প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে।
(৩) অতিবৃষ্টির কারণে বন্যার প্রকোপ বাড়বে। অপরদিকে গ্রীষ্মের সময় প্রচণ্ড তাপদাহে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খরার প্রকোপ দেখা দেবে। আবহাওয়ার এ প্রকট তারতম্যের কারণে ফসল উৎপাদন বিপুলাংশে ব্যাহত হবে।
(৪) শুকনো মৌসুমে দেশের প্রধান প্রধান নদীর প্রবাহ হ্রাস পাবে। নদীর ক্ষীণপ্রবাহের কারণে সমুদ্রের লোনা পানি দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নদ-নদীর পানিতে লবণাক্ততা বাড়িয়ে দেবে। এতে একদিকে বৃষ্টিতে সেচের জন্যে ও পানযোগ্য পানির অভাব দেখা দেবে, অপরদিকে স্বাদুপানির মৎসসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
(৫) দেশের দক্ষিণাঞ্চল বহুলাংশে প্লাবিত হলে সামুদ্রিক লোনা পানি ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ভূগর্ভস্ত পানির লবণাক্ততা বাড়িয়ে দেবে। ফলে দেশে তীব্র খাবার পানির সংকট দেখা দেবে।
(৬) জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সমুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা ও পৌনঃপুনিকতা বাড়বে। ফলে বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ধ্বংস হবে বহু সম্পদ।
(৭) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ভূমিকম্প প্রবণ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। অচিরেই বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটার আশঙ্কা রয়েছে, যার মূলে রয়েছে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন। দেশের রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোতে ভূমিকম্পের ফলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে, মারা যেতে পারে লক্ষ লক্ষ মানুষ।
জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব : সমগ্র বিশ্বে ইতোমধ্যেই জলবায়ুর ভারসাম্য নষ্টের কুপ্রবাহ লক্ষ করা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মেরু অঞ্চলের বরফের সামগ্রিক আয়তন হ্রাস। শুধু মেরু অঞ্চলেই নয়, সুইজ্যারল্যান্ডের জমাটবদ্ধ বরফের পরিমাণও কমেছে, কমেছে কেনিয়া পর্বতমালা ও ফিলিমাজ্যারো পর্বতের বরফের পুরুত্ব। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যান্য প্রভাবের মধ্যে আছে:
(১) নাইজার নদী, শাদ হ্রদ এবং সেনেগাল নদীর পানি হ্রাস।
(২) বিশ্বের ৭০% বালুকাময় তটরেখার বিলুপ্তি।
(৩) আলাস্কার উত্তরাঞ্চলের বনভূমির স্থানচ্যুতি।
জলবায়ু সংকট রোধে করণীয় : জলবায়ু সংকট রোধে বিশ্বের সকল মানুষকেই সচেতন হতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববাসীর প্রধান প্রধান করণীয় হতে পারে-
(১) ওজোন বান্ধব গ্যাস ব্যবহার। ফ্রিজ, এসি ইত্যাদি এবং অ্যারোসল, এয়ারফ্রেশনারে ব্যবহৃত সি এস সি গ্যাস ওজোন স্তরকে ধ্বংস করে, ফলে গ্রিন হউজ প্রভাবের কারণে বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে যায়। তাই সি এস সি গ্যাস পরিত্যাগ করা ও সে স্থলে ওজোন বান্ধব গ্যাস ব্যবহার করা জরুরি।
(২) উপযুক্ত বর্জ্যব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা নেয়া যেন বায়ু, পানি দূষণ এবং স্থল দূষণের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনা যায়।
(৩) ভূমণ্ডলের ক্রমউষ্ণায়ন প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে সাধারণ বৃক্ষ নিধন রোধ ও পর্যাপ্ত পরিমাণ বনায়নের পদক্ষেপ অব্যাহত রাখা।
(৪) প্রাকৃতিক জলাশয় উষ্ণায়ন প্রতিরোধ করে এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার সহায়ক ভূমিকা রাখে। তাই প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট প্রতিরোধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
(৫) বিশ্বের সামগ্রিক ভূমি ব্যবহার পরিবেশসম্মত করা।
(৬) পরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন নিশ্চিত করা।
(৭) যানবাহনের কালো ধোঁয়া পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে। এছাড়া প্রাকৃতিক জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহার রোধ কল্পে ও বিষাক্ত কালো ধোঁয়ার ক্ষতি কমাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করাও দরকার।
বাংলাদেশে জলবায় পরিবর্তনের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে দেখা যাচ্ছে। আইলা ও সিডরের মত ঘূর্ণিঝড় মুহুমুর্হু আঘাত হানছে। ফলে বহু মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন দ্বীপ পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। ফসলের জমি, চিংড়ির ঘের তলিয়ে যাচ্ছে ।
লেখক: মুজিব উল্ল্যাহ্ তুষার (সাংবাদিক, সংগঠক ও মানবাধিকার কর্মী)