অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পেতে- আগামী জুনের মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যা কার্যকর হলে- চলতি বছরে চতুর্থবারের মতো বিদ্যুতের দাম বাড়বে।
এতে নিম্নআয়ের মানুষের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে; ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির মধ্যে জীবনধারণে যাদের হিমশিম অবস্থা। তারপরও, আইএমএফ ঋণ প্যাকেজের শর্ত মেনে – ভর্তুকির চাপ কমাতে বাধ্য হয়েই কঠিন এ সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে সরকারকে।
এছাড়া সেপ্টেম্বর থেকে জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে বলেও আইএমএফ এর পর্যালোচনাকারী প্রতিনিধি দলকে নিশ্চিত করেছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
তবে রিজার্ভ হিসাবের পদ্ধতি নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিমত রয়েছে, যা আগামী দফার আলোচনায় সুরাহা হবে বলে তারা আশা করছেন।
৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণচুক্তির শর্তগুলো বাস্তবায়ন পরিস্থিতি প্রথমবারের মতো পর্যালোচনা করতে ঢাকা সফর করছে আইএমএফ প্রতিনিধি দল। তাদের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এসব অগ্রগতির বিষয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে নিশ্চিত করেন।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ভর্তুকির চাপ কমানোর জন্য বৈঠকে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। তবে কী পরিমাণ বাড়ানো হবে- তা নিয়ে সভায় আলোচনা হয়নি।
জুনে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে – তারপর আবার বাড়ানো হবে কি-না, সেটি আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দামের ওপর নির্ভর করবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
‘বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কমছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে জুনের পর আবার নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। তবে জ্বালানির দাম ঊর্ধ্বমুখী হলে তখন আবার নতুন করে ভাবতে হবে’- বলেন তিনি।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস, সার কিংবা কয়লার দাম বাড়লেও ভর্তুকি বাড়ানো যাবে না বলে আইএমএফ’র শর্ত রয়েছে। এছাড়া, জিডিপির অনুপাতে ভর্তুকির সর্বোচ্চ হার নির্ধারণ করে দিয়েছে সংস্থাটি। শর্ত অনুযায়ী, ভর্তুকির লাগাম টেনে ধরতে গত জানুয়ারি মাসে দু’বার এবং ফেব্রুয়ারিতে একবারসহ দু-মাসে মোট তিনবার ৫ শতাংশ হারে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার।
আগের তিন দফা দাম বাড়ার কারণে বিদ্যুতের ব্যবহার আগের বছরের সমান হলেও সরকারের সাশ্রয় হবে ৯,২০০ কোটি টাকা। জুনে ৫ শতাংশ হারে আরেক দফা দাম বাড়লে সরকারের অতিরিক্ত সাশ্রয় হবে প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা।
তবে সরকার ভর্তুকি কমাতে ‘পাস থ্রো’ পদ্ধতি অবলম্বন করার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের ওপর। আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়লে ব্যবসার খরচ বাড়বে। এতে পণ্যমূল্য আরও বাড়বে, যা বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দিতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, গত মার্চে গড় মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি পেয়ে ৯.৩৩ শতাংশ হয়েছে।
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই)- এর সভাপতি জসীম উদ্দিন গত ফেব্রুয়ারিতে বলেছিলেন, ‘গত এক বছরে সব ধরনের কাঁচামালের দাম বেড়েছে। এরমধ্যে বার বার বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। এতে আমাদের উৎপাদনের সক্ষমতা কমছে এবং বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতাও হারাচ্ছি’।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল জানান, জ্বালানির দাম বাড়ানোর প্রভাব ইতোমধ্যেই শিল্পখাতের মুনাফা সীমায় প্রভাব ফেলেছে। শেষপর্যন্ত এই দাম বৃদ্ধির বোঝা ভোক্তাকেই বইতে হবে।
২০২৬ সালের মধ্যে পুরোপুরি ভর্তুকি প্রত্যাহার
আইএমএফ’র সঙ্গে স্বাক্ষরিত ঋণচুক্তিতে ২০২৬ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাতে ভর্তুকি পুরোপুরি প্রত্যাহার করার অঙ্গীকার করেছে সরকার। এজন্য ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
তবে কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রেখে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষি ভর্তুকি কমানোর বিষয়ে আইএমএফের শর্তে সম্মতি দেয়নি সরকার।
চলতি অর্থবছরে সারে ১৬,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, সংশোধিত বাজেটে এটি বাড়িয়ে ২৬,০০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। কিন্তু, কৃষি মন্ত্রণালয় এ বছরের জন্য মোট ৫৬,২৪৭ কোটি টাকা ভর্তুকি চেয়েছিল।
আইএমএফ’র সঙ্গে বৈঠকে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ভর্তুকি পরিস্থিতি এবং আগামী অর্থবছর কোনখাতে কতো ভর্তুকি প্রাক্কলন করা হবে, তার বিস্তারিত আলোচনা করেছে অর্থ বিভাগ। একইসঙ্গে আইএমএফ এর শর্ত অনুযায়ী প্রতি প্রান্তিকের জিডিপির তথ্য প্রকাশে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কাজ করছে বলে সংস্থাটির পর্যালোচক টিমকে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, গত অর্থবছর বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ১১,৯৬৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে ১৭,০০০ কোটি টাকা করা হয়। কিন্তু, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিদ্যুৎখাতে অতিরিক্ত ৩২,৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দাবি করে বিদ্যুৎ বিভাগ।
আইএমএফের শর্ত না থাকলেও এতো বিপুল পরিমাণ ভর্তুকির ভার বহন করার সক্ষমতা সরকারের নেই। তাই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি সরকারের জন্য অপরিহার্য ছিল।
‘তবে দাম বাড়ানোর প্রভাব যাতে শিল্প ও ভোক্তাদের জন্য সহনীয় হয়, সেজন্য একসঙ্গে অনেক বেশি দাম না বাড়িয়ে ৫ শতাংশ হারে বাড়ানো হচ্ছে’ বলে জানান অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা।
তারপরেও জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ভর্তুকি বাবদ ১৯,৩৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে।
আইএমএফ আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করে নির্ধারণের শর্তারোপ করেছে, যা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কার্যকর করতে হবে। আগামী সেপ্টেম্বর মাস থেকেই এটি কার্যকর করা হবে বলে বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধিদের জানিয়েছেন অর্থ সচিব।
রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয়
আগামী জুনের মধ্যে আইএমএফ ২৪.৪৬ বিলিয়ন ডলারের নেট বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের যে শর্ত দিয়েছে – তা পূরণ করা বেশ চ্যালেঞ্জিং বলে স্বীকার করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ৩১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। সেখান থেকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলসহ বিভিন্নখাতে ঋণ বিতরণ ও বিনিয়োগের অর্থ বাদ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৩ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
কিন্তু, এ হিসাব মানতে নারাজ আইএমএফ। তারা বলছে, এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন (আকু) পেমেন্টসহ বাংলাদেশের যেসব বৈদেশিক অর্থপ্রদান বকেয়া রয়েছে, সেগুলো বাদ দিয়ে নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাব করতে হবে। আইএমএফ এর হিসাব অনুযাযী, নেট রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা বেশি।
কিন্তু, আইএমএফ’র এই হিসাব পদ্ধতি মানতে রাজী হয়নি বাংলাদেশ- জানান ওই কর্মকর্তা।
আইএমএফকে অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগামী জুনের মধ্যে বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়া যাবে এবং তা রিজার্ভে যোগ হবে। এছাড়া, জুনের শেষে ঈদুল আযহা ঘিরে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে রিজার্ভের পরিমাণও বাড়বে।
রিজার্ভ গণনার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, জুলাই থেকে BPM6 অনুযায়ী রিজার্ভ (নেট রিজার্ভ) গণনা করা হবে, পাশাপাশি গ্রস রিজার্ভের হিসাবও দেওয়া হবে।
রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন মাত্র এপ্রিল চলছে। সামনে আরো সময় আছে। এই মূহুর্তে আমি এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না’।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোর কী অবস্থা মূলত সেটাই দেখছে আইএমএফ প্রতিনিধি দল।
‘আমাদের দেশের বিভিন্ন সূচক নিয়ে আইএমএফ পূর্বাভাস দেয়, সেগুলো সংশোধন করার জন্যই এ সফর। আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়ন তারা দেখবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সঙ্গে তারা কথা বলবেন। এর সঙ্গে ঋণের কোনো সম্পর্ক নেই’ – তিনি দাবি করেন।
বাংলাদেশ মুদ্রার একক বিনিময়ের হারের দিকে এগিয়ে চলেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার বিক্রির রেট এখন ১০৩ টাকা।ডলারের দরের পার্থক্য কমিয়ে আমরা একে বাজার-ভিত্তিক করার চেষ্টা করছি’।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরো বলেন, আইএমএফ এর নিয়মিত ‘স্টাফ ভিজিট’ শুরুর অংশ হিসেবে ৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এসেছেন। তাদের সঙ্গে আবাসিক প্রতিনিধিও আছেন।
সূত্র: টিবিএস