হাজিরা দিতে এসে হায়তুল্লাহ নামের একজন রডমিস্ত্রি বলেন, ‘আমি একজন সাধারণ মানুষ। আমি রডমিস্ত্রির কাজ করি। আমার সামনে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে বলল, ‘‘তুমি দাঁড়াও।’’ আমি দাঁড়ালাম। দাঁড়ানোর পর বলল, ‘‘নিচে চল।’’ নিচে কোথায়? কোথায় যেতে হবে? আমার অপরাধ? ‘‘নিচে যাইয়ে কথা বলে আবার আপনি চইলে আসবেন। স্যার কথা বলবেন। কিছু কথা আছে।’’ কী কথা আছে এখানেই বলেন, এ কথা বলার পরে আমাকে গাড়িতে তোলা হয়। আমাকে এক রাত আটকায়ে রাখা হয়। আমি নিজেও জানি না, আমাকে কিসের জন্য ধরা হলো। আমাকে ধরার সময় আমার কাছে কাজের হাতুর ছিল। বাটি ছিল, টেপ ছিল। আর সাইকেল ছিল। সব নিয়ে নিয়েছে। তারপর সামনে কিছু বই দিয়ে মামলা দিয়েছে। বইয়ের মামলা দিয়েছে। কেন আমাকে মামলা দিল? আমার কী অপরাধ? আমার কোনো অপরাধ নাই।’
কারা ধরল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যখন আমাকে ধরে নিয়ে আসে, তখন আমি দেখেছিলাম, সাধারণ মানুষ আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।’
আরেকজন টিউবওয়েলের বোরিং মিস্ত্রির বর্ণনা, ‘‘‘কাজ করাইয়ে লিবে স্যার। তাই আপনার সঙ্গে কথা বলবে।’’ যাওয়ার পরে এক জায়গাতে বসে চা খাইলাম। তারপর বলল, ‘‘এই দেখেন তো গাড়িতে লোক আছে চিনেন কি না’’। গাড়ির কাছে গেলাম। গাড়িতে কেউ নাই, ধাক্কা দিয়ে গাড়িতে তুলে নিল। যাওয়ার পরে এক সপ্তাহ আমার ওপরে অনেক টর্চারিং (নির্যাতন) করে। পরে ওখান থেকে রাত্রে বাহির করে নিয়ে আইসে। হলিদাগাছি বলফিল্ড, ওখানে এসে তিন রাউন্ড গুলি, দুইটা জিহাদি বই একটা পিস্তল দিয়ে আমাকে নাটক করে ফাঁসাইয়ে দিছে।’
জঙ্গি না হলে পুলিশ কেন এই নাটক করতে যাবে—এর জবাবে তিনি বলেন, ‘সে তো ওরাই জানে। আমি তো জীবনে কোনো দিন এ কাজ করি নাই। এখনো করি না। আমি একে ঘৃণা করি। ভালোবাসি না। সারাক্ষণ বোরিংয়ের ব্যস্ততার মধ্যেই সময় কাটাই। এই যে এখানে আসলাম। আজ আমার ৫০০ টাকার লেবার গেল। এত কষ্ট, এইভাবেই জীবন যাপন করছি।’
আরেকজন দোকানির বর্ণনা ছিল এ রকম—‘২০১৮। বগুড়া ডিবি আমাকে দোকান থেকে উঠাইয়ে নিয়ে গেছে বেলা ১১টার দিকে। নিয়ে যাইয়ে আমার ওপর টর্চারিং চলে। ৭৩ দিন পৃথিবীর কোনো মুখ দেখিনি। ৭০ দিন টর্চারিং করার পরে আমাকে ওয়ান সিক্সটি ফোর দেওয়া হয়। ওয়ান সিক্সটি ফোর দিলে তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কী বিষয়? রহমান জুট মিলের টাকা ছিনতাইয়ের মামলা। রহমান জুট মিলের টাকা ছিনতাইয়ের মামলার তো কিছু আমি জানি না। না আমাকে স্বীকার করতেই হবে। স্বীকারোক্তি দিতেই হবে। না হলে ক্রসফায়ার করবে।’
ওই দোকানির দাবি অনুযায়ী, তারপর তাঁকে বগুড়া থেকে ট্রেনে রাজশাহীতে আনা হয়। রাজশাহীতে ছিলেন ৭১ দিন। সেখানেও নির্যাতন করা হয়। একসময় উপায় না পেয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে রাজি হন। আদালতে তোলার আগে একটা কাগজে লেখা পড়িয়ে রিহার্সাল করা হয়। আদালতে সেভাবে না বলে সত্য কথা বললে ক্রসফায়ারের হুমকি দেওয়া হয়। উপায় না পেয়ে তিনি সেভাবেই বলেন।
ওই দোকানি বলছিলেন, ‘এরপর আমাকে নিয়ে চলে গেল জেলখানায়। ওখানে আমাকে কোনো সংস্থার লোক ডাকে। আমি যেভাবে ওয়ান সিক্সটি ফোর দিয়েছি সেইভাবে বললাম। তো বলছে, সত্য কথা বলেন ভাই। তখন কান্না চোখে বললাম যে আমি সত্য বলি আপনারা সত্য মানবেন না। তারা বলেন, না মানবেন। তখন আমি সত্য কথা বললাম। দেখেন স্যার আমাকে দোকান থেকে উঠায়ে নিয়ে গেছিল। এভাবে টর্চারিং করার পরে আমি ওয়ান সিক্সটি ফোর দেওয়ার পরে কোর্টে চালান দেওয়া হয়। কোর্ট থেকে জেলখানায়।’
আবু তালাহা নামের একজন যুবক বললেন, ‘রাতে বাড়িতে শুয়ে ছিলাম। করোনার সময়। দুই বছর জেলে ছিলাম। আসার পরে একটা ভয় কাজ করত যে আমাকে আবার ধরবে নাকি পুলিশে। পরে জামিনে আসার পরে সপ্তাহে থানায় ডাকে। এখন থানায় হাজিরা দিতে আসার পরে ভালো লাগছে। হয়তো পুলিশের আর ধরবে না। আমি কোনো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না।’
বেলপুকুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুজ্জামান জানান, জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগে তার থানা এলাকার ৩৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা আছে। তাঁদের মধ্যে ৩৩ জন থানায় নিয়মিত হাজিরা দেন। একজন বর্তমানে কারাগারে। বাকি চারজনের ঠিকানা নিয়ে তদন্ত চলছে। তারা চারঘাট থানায় পড়বে নাকি বেলপুকুরে পড়বে।
ওসি বলেন, এসব আসামি জঙ্গিবাদ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার অঙ্গীকার করছেন। তাই তাদের ব্যাপারে সব সময় নজরদারি রাখা হয়। এর অংশ হিসেবেই থানায় হাজিরা নেওয়া হয়। তবে এর সঙ্গে আদালতের বিচারাধীন মামলা কিংবা বিচারের কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁরা সাংবাদিকদের কাছে জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন, এ বিষয়ে বক্তব্য চাইলে ওসি বলেন, অপরাধী কখনো নিজের অপরাধ স্বীকার করে না।
নগর পুলিশের কমিশনার আনিসুর রহমান বলেন, রাজশাহীতে জঙ্গি মামলার জামিনপ্রাপ্ত আসামিদের প্রতি সপ্তাহে থানায় হাজিরা দেওয়ার ব্যাপারটি প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমেরই অংশ। মডেল হিসেবে বেলপুকুর থানায় নিয়মিত হাজিরার ব্যবস্থা করেছেন। জামিনে মুক্ত জঙ্গি মামলার আসামিরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার অঙ্গীকার করেছেন এবং পুলিশও চায় তাঁরা জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক।