ঢাকাশনিবার, ২৮শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

গণতন্ত্রের দিক দিয়ে বাংলাদেশ পেছনে যাচ্ছে, বাংলাদেশে সবার দৃষ্টি বাড়ছে : হার্ভার্ডের অধ্যাপক জেমস রবসন

নিউজ ডেস্ক | সিটিজি পোস্ট
ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৩ ১০:০১ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিচ্ছে। অন্যদিকে সরকারকে জোরালো সমর্থন দিচ্ছে ভারত। গতকাল শুক্রবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির এশিয়া সেন্টার আয়োজিত আলোচনায় এ কথা বলেছেন বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলেন, ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে তাদের কৌশলগতসহ বিভিন্ন স্বার্থে প্রতিযোগিতা করছে।

বাংলাদেশে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি এশিয়া সেন্টারের ফেলো আনু আনোয়ার, উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জেফরি ম্যাকডোনাল্ড।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হার্ভার্ডের অধ্যাপক জেমস রবসন বলেন, গণতন্ত্রের দিক দিয়ে বাংলাদেশ পেছনে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সবার দৃষ্টি বাড়ছে। আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ নতুন করে আলোচনায় আসতে পারে।

ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জেফরি ম্যাকডোনাল্ডও মনে করেন, বাংলাদেশ নিয়ে সমালোচনার কেন্দ্রে আছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আগামী নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ জানানোর কথা বলছে। তবে ওই নির্বাচন কতটা অবাধ, সুষ্ঠু হবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বিভিন্ন পশ্চিমা

দূতাবাস, এমনকি জাপান দূতাবাসও এখন বাংলাদেশের সমালোচনা করে। জেফরি ম্যাকডোনাল্ড বলেন, বাংলাদেশ রাশিয়ার সমালোচনা করতে চায় না। গণতন্ত্র সম্মেলনের বিরোধিতা করে ঢাকায় রাশিয়ার দূতাবাস নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। রাশিয়া অন্য দেশের হস্তক্ষেপের সমালোচনা করে, অথচ নিজেই হস্তক্ষেপ করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘পাকিস্তানপন্থী’, ‘ইসলামপন্থী’ তকমা আছে। ভারতের বিজেপি সরকারের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, ভারত শেখ হাসিনার সঙ্গে আছে। তিনি তাঁর বাবার মতো দেশ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

জেফরি ম্যাকডোনাল্ড আরো বলেন, বাংলাদেশে বলা হয়ে থাকে যে শেখ হাসিনার সরকারের পেছনে ভারতের সমর্থন আছে। ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়।

জেফরি ম্যাকডোনাল্ড মনে করেন, বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে ভারত উভয় সংকটে পড়েছে। কারণ এই সমর্থনের জন্য বাংলাদেশে ভারতবিরোধিতা বাড়ছে। বাংলাদেশে চীনের ভূমিকা প্রসঙ্গে জেফরি বলেন, চীন সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছে।

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি এশিয়া সেন্টারের ফেলো আনু আনোয়ার বলেন, অনেকেরই ধারণা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ভারতকে অনেক দিচ্ছে। জনগণ মনে করে, বাংলাদেশ সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে হলে ভারতের সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, দুটি বিতর্কিত নির্বাচনের পর পশ্চিমা জোট অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপ দিচ্ছে। অন্যদিকে সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে ভারত।

আনু আনোয়ার বলেন, ভারতের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছে। তবে স্বাধীনতার পর ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। বাংলাদেশ ভারতের জন্য বড় বাজার। বাংলাদেশ ভারতের চতুর্থ শীর্ষ রেমিট্যান্সের উৎস। তবে এখনো দুই দেশের মধ্যে পানি সমস্যা ও সীমান্ত হত্যার মতো অনেক ইস্যুর সুরাহা হয়নি।

বর্তমান সরকারের আমলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক প্রসঙ্গে আনু আনোয়ার বলেন, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই)’ বাংলাদেশের যোগ দেওয়া এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। তিনি বলেন, ভারত, চীন, জাপান কেউই মিয়ানমার নিয়ে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান দেয়নি।

উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন—এই তিনটি দেশই বাংলাদেশে প্রতিযোগিতা করছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের একই ধরনের স্বার্থ আছে।

কুগেলম্যান বলেন, কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশ সন্ত্রাসী হামলার জন্য আলোচনায় ছিল। চীনের বিআরআই প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ এখন শুধু চীন নয়, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র—তিন দেশেরই নীতিগুলোর কোনো না কোনো বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের উদ্বেগ আছে। বাংলাদেশ সরকার দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানো পছন্দ করে না। আবার কট্টর ইসলামপন্থীরা ভারতকে পছন্দ করে না।

কুগেলম্যান বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি ভারতের জোরালো সমর্থন আছে। কারণ আওয়ামী লীগ সরকার দেশে উগ্রপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ আছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হতাশা আছে।

কুগেলম্যান বলেন, চীন বাংলাদেশে নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের এত বড় প্রকল্প বাংলাদেশে নেই। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিকের আওতায় বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের ডেভেলপমেন্ট ফিন্যান্স করপোরেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সহযোগিতা দেওয়ার সুযোগ আছে।

মিয়ানমারের জান্তা প্রশ্নে কুগেলম্যান বলেন, এ ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশ অনেকটা একই অবস্থানে। যুক্তরাষ্ট্র জান্তারবিরোধী, অন্যদিকে চীন জোরালো সমর্থক।

কুগেলম্যান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের সমর্থন করার নীতি নিয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যু এখন যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ কূটনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিনি বলেন, নেপালে ভারত-চীন প্রতিযোগিতা করছে। আবার শ্রীলঙ্কায় চীন ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতা আছে।

কুগেলম্যান বলেন, ভারত, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ কোয়াড বাংলাদেশে প্রতিযোগিতা করছে। নিষিদ্ধ রুশ জাহাজকে বাংলাদেশ তার বন্দরে ভিড়তে না দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র খুশি হতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে রাশিয়া দূতাবাস যেভাবে অবস্থান জানিয়েছে তাও উল্লেখযোগ্য।

কুগেলম্যান বলেন, ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া দূতাবাসের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে টুইটারে রীতিমতো যুদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশে রাশিয়ার উপস্থিতি বাড়লে পরোক্ষভাবে চীনের উপস্থিতি বাড়বে। এটি নিশ্চয়ই ভারত চাইবে না।

আলোচনার দ্বিতীয় ধাপে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির এশিয়া সেন্টারের ফেলো আনু আনোয়ার বলেন, ‘লুক ইস্ট’ বা পূর্বমুখী কূটনীতির আওতায় ভারতের পূর্বদিকে যাওয়ার প্রথম ধাপ হলো বাংলাদেশ। তাই বাংলাদেশ ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিশেস্নষকদের উদ্দেশে হার্ভার্ডের অধ্যাপক জেমস রবসনের প্রশ্ন ছিল, এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে শক্তিশালী গণতন্ত্র এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কী করা প্রয়োজন?

জবাবে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জেফরি ম্যাকডোনাল্ড বলেন,  প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা। বিরোধী দলগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সেই সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনবে বলে তিনি মনে করেন না।