ঢাকারবিবার, ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

তাঁকে মনে রাখেনি কেউ… ভাষাশহীদ শিশু অহিউল্লাহ

মতামত ডেস্ক | সিটিজি পোস্ট
ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৩ ১২:৫৩ অপরাহ্ণ
Link Copied!

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছে ছাত্রসমাজ। শান্তিপূর্ণ মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায় পাক জান্তাদের মিলিটারি-পুলিশ। গুলিতে রফিক, আবদুল জব্বার, আবুল বরকত শহিদ হন। গুলিতে গুরুতর আহত আবদুস সালাম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পুরো ঢাকা শহর তখন থমথমে ও গুমোট পরিবেশ। শহরের সর্বত্র সেনাদের টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলনে শহিদ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে পুরো দেশে ছাত্র-জনতা উত্তাল হয়ে ওঠে। দেশের সর্বত্র চলে মিছিল-মিটিং-সমাবেশ।

পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে পুরান ঢাকার নবাবপুর রোডে পাকিস্তানি সৈন্যদের টহল চলছে। পুরো নবাবপুর রোড এলাকা সুনসান নীরবতা। লোকজনের মাঝে অজানা আতঙ্ক ভর করেছে। পারতপক্ষে কেউ বাড়িঘর থেকে বের হচ্ছেন না। মাঝে মাঝে দু-চারটা গাড়ি যাচ্ছে এদিক-ওদিক। আকস্মিক সুনসান নীরব নবাবপুর এলাকা উত্তপ্ত হয়ে উঠে। ভাষার দাবিতে পাক সৈন্যদের গুলিতে হত্যার শিকার রফিক, জব্বার, বরকতদের হত্যা নিয়ে শোক ও প্রতিবাদ মিছিল বের করেন ছাত্ররা। ছাত্রদের মিছিল আর সেøাগানে সেøাগানে নবাবপুর এলাকার আকাশ-বাতাশ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি সৈন্যরাও মিছিল প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

নবাবপুর এলাকা যখন সেøাগানে সেøাগানে প্রকম্পিত। ঠিক তখন ওই এলাকার খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে আনুমানিক ৯ বছর বয়সি একটি ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। তার সামনেই ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের গাড়ি। জলপাই রঙের পোশাক পরিহিত পাকিস্তানি সৈন্যরা ছিল ছেলেটির দেখা এলাকায় নতুন আগন্তুক। এমন বিচিত্র পোশাকের মানুষ ছেলেটি জীবনে প্রথম দেখেছে। ৯ বছর বয়সি ছেলেটি জানে না তারা কারা। তার আবার ছিল ছবি আঁকার শখ। ছেলেটি পকেট থেকে একটি সাদা কাগজ বের করে জলপাই রঙের পোশাক পরিহিত সৈন্যদের ছবি আঁকার প্রস্তুতি নেয়। মাত্র ছবি আঁকা শুরু করেছে ছেলেটি এরই মধ্যে ছাত্রদের মিছিলটি তার সামনে আসে। অবুঝ ছেলেটি মিছিল দেখামাত্র ছবি আঁকার কাগজ নিজের মুখে পুরে মিছিলে যোগ দেয়। মিছিলটি কয়েক হাত সামনে এগোতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা আকস্মিক গুলি ছুড়তে শুরু করে। সৈন্যদের গুলিতে শহিদ হন শফিউর রহমান, ২৬ বছর বয়সি আবদুল আউয়াল নামের একজন নিরীহ রিকশাচালক এবং সেই ৯ বছর বয়সি ছেলেটি। ঘাতকের বুলেটে সেই ৯ বছরের ছেলেটির মাথার খুলি উড়ে যায়। এ অবস্থায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিলটি। ঘাতকরা তিনটি লাশ নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালে নেওয়ার সময় শিশুটির পরিচয় নিশ্চিত হতে প্রচেষ্টা চলে। শিশুর লাশটির প্রত্যক্ষদর্শী ডা. মেজর (অব.) মাহফুজ হাসান লাশের বুক পকেটে প্রজাপতি, ফুল, পাখি, জীবজন্তু আঁকা কিছু কাগজ পান। তিনি প্রথমে শিশুটির নাম জানতে পারেন শফিউল্লাহ। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক পর নিশ্চিত হওয়া যায় নিহত ওই শিশুটির নাম শফিউল্লাহ নয়, তার নাম অহিউল্লাহ। নাম নিশ্চিত হওয়ার পর শিশুটির পিতা রাজমিস্ত্রি মো. হাবিবুর রহমানকে খবর দিয়ে আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিনি এসব ছবি দেখে তার ছেলে অহিউল্লাহর লাশ শনাক্ত করেন। অহিউল্লাহর পিতা হাবিবুর রহমান নিজ ছেলের লাশ নিতে চাইলেও পাক সৈন্যরা লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেনি। অহিউল্লাহর লাশ সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে অত্যন্ত গোপনে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করে।

বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিপছিপে গড়নের অহিউল্লাহ ছিল দুরন্ত প্রকৃতির। মাথাভর্তি ছিল ঝাঁকড়া চুল। সারা দিন ঢাকা শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়ানো আর ছকি আঁকাই ছিল তার কাজ। দরিদ্র ঘরে জন্ম নেওয়া অহিউল্লাহর পিতা তার একমাত্র সন্তানকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন সমাজের প্রকৃষ্ট মানুষ হিসেবে। তাই তিনি শত অভাবের সংসারেও ছেলেকে ভর্তি করিয়েছিলেন স্কুলে। মাত্র তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল অহিউল্লাহ। দরিদ্র রাজমিস্ত্রি পিতার অনেক স্বপ্ন ছিল একমাত্র ছেলে ঘিরে। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে পিতার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। ছেলে অহিউল্লাহ পাক সৈন্যদের বুলেটে শহিদ হওয়ার পর লাশটিও পাননি দরিদ্র পিতা।

ওই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় শহিদ অহিউল্লাহর মৃত্যুর ঘটনাটি প্রকাশিত হয়। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘সৈনিক’ নামের একটি পত্রিকা। ওই পত্রিকায় ভাষাশহিদদের তালিকায় অহিউল্লাহর নাম ছিল।

এরপর সময় বয়ে যায় সময়ের গতিতে। রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউর, সালাম প্রমুখরা ভাষাশহিদ হিসেবে আমাদের স্মৃতিতে অক্ষয়-অমøান হয়ে থাকে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে শিশু ভাষাশহিদ অহিউল্লাহ আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে থাকে। শুধুমাত্র পুরান ঢাকার প্রবীণদের কাছে ভাষাশহিদ অহি অক্ষয়-অমøান ছিল। একে একে পেরিয়ে যেতে থাকে দিন-মাস-বছর। ভাষা আন্দোলনের ৫৪ বছর পর ২০০৬ সালে অহিউল্লাহ বিষয়ক কিছু লেখা নজরে পড়ে ভাষা-গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘরের ট্রাস্টি এম আর মাহবুবের। তিনি বিভিন্নভাবে ভাষাশহিদ অহিউল্লাহ সম্পর্কে নানা তথ্য সংগ্রহ করেন। তথ্য সংগ্রহ করার একপর্যায়ে তিনি জানতে পারেন অহিউল্লাহর পরিবার ঢাকার নবাবপুর রোডস্থ ১৫২ লুৎফর রহমান লেনে বসবাস করে। বাড়ির ঠিকানা পেয়েই এম আর মাহবুব ছুটলেন সেই বাড়িতে। বাড়িতে পেলেন অহিউল্লাহর পরিবার-পরিজনদের। অনেক চেষ্টা করেও তিনি ভাষাশহিদ অহিউল্লাহর কোনো ছবি সংগ্রহ করতে পারলেন না। সেই বাড়ি থেকে বেরিয়েই তিনি ছুটলেন ঢাকা সিটি করপোরেশনে। সেখানে আজিমপুর কবরস্থানের নথিপত্র ঘেঁটে পেয়ে গেলেন অহিউল্লাহর নাম এবং শহিদ হওয়ার তারিখ। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কবরস্থানের ঠিক কোথায় তার কবর, তা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।

ভাষা-গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘরের ট্রাস্টি এম আর মাহবুব এত দ্রুত রণেভঙ্গ দেওয়ার মানুষ নন। তিনি অহিউল্লাহর কবর চিহ্নিত করতে না পারলেও তার একটি ছবি ইতিহাসের পাতায় থাকা প্রয়োজন বলে মনে করলেন। অহিউল্লাহর বাড়িতে তার কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। ফলে তার ছবি আঁকার বিষয়টি তিনি অধিক গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন। এ ব্যাপারে তিনি দায়িত্ব দিলেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শ্যামল বিশ্বাসকে। চিত্রশিল্পী শ্যামল বিশ্বাস ওই বছরই ভাষাশহিদ অহিউল্লাহর পরিবারের লোকজন, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী প্রবীণদের কাছে অহিউল্লাহর শারীরিক বর্ণনা শুনে ছবি আঁকার কাজ শুরু করেন। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি

মাসে ভাষাশহিদ অহিউল্লাহর ছবি আঁকার কাজ শেষ করেন চিত্রশিল্পী শ্যামল বিশ্বাস। এর আগে পরিবারের লোকজনদের কাছে বর্ণনা শুনে ভাষাশহিদ আবদুস সালামের ছবি এঁকেছিলেন ভাস্কর রাশা।

অহিউল্লাহর শহিদ হওয়ার বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছে দেশের প্রায় সব পত্র-পত্রিকায়। ২০০৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ‘দৈনিক ইনকিলাব’ পত্রিকায় উল্লেখ করা হয় ‘শহিদ অহিউল্লাহ ভাষা আন্দোলনের সময় ছিল মাত্র ৯ বছরের টগবগে কিশোর। তার বাবার নাম হাবিবুর রহমান। পেশায় রাজমিস্ত্রি। একুশে ফেব্রুয়ারির পরদিন শোক মিছিলে অহিউল্লাহ অংশগ্রহণ করেন এবং সেই মিছিলের ওপর তৎকালীন পুলিশ বর্বরোচিতভাবে গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুকোলে ঢলে পড়েন অহিউল্লাহ। কিশোর অহিউল্লাহর মৃতদেহ কোথায় সমাধিস্থ করা হয়, তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তার লাশ পুলিশ গোপনে সরিয়ে ফেলে।’ বাংলা ১৩৬২ সনের ১১ ফাল্গুন ‘সাপ্তাহিক নতুন দিন’ পত্রিকার সংবাদে উল্লেখ করা হয় ‘১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নবাবপুর রোডে খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে অহিউল্লাহ গুলিবিদ্ধ হন, গুলি লাগে তার মাথায়। পুলিশ অতি দ্রুত তার লাশ ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে ফেলে এবং গায়েব করে দেয়।

আমাদের মাতৃভাষা শহিদ হিসেবে রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, শফিউরদের নাম সর্বত্র উচ্চারিত হয়। প্রতি বছর তাদের স্মরণ করে পুরো বিশ্বের বাংলা ভাষাবাসী। কিন্তু শিশু অহিউল্লাহ ও আবদুল আউয়াল হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির আড়ালে। ভাষাশহিদ রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, শফিউরদের পাশাপাশি অহিউল্লাহ ও আবদুল আউয়ালকে স্মরণ করতে হবে আমাদের।