পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন প্রতিশ্রুতি ভেঙে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেওয়ার পর ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত আসে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে। বন্দি হিসেবে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৯৫১ সালের জানুয়ারিতে গভীর রাতে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগসহ রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষের নেতাদের পরপর দুই দিন বৈঠক হয়। সেখানেই ঠিক হয়, ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে।
সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭: গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয় এ মাসে। সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক কিছু প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু প্রস্তাবগুলো পাঠ করেন। এতে বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করার দাবি করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের ওপর ছেড়ে দেওয়ার দাবি করা হয়। এই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে ভাষার দাবি প্রথমবারের মতো উচ্চারিত হয়। বঙ্গবন্ধু ওই বছর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবির পক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানেও অংশ নেন।
ডিসেম্বর, ১৯৪৭: খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে চলাকালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অনুষ্ঠিত মিছিলে নেতৃত্ব দেন ৫ ডিসেম্বর।
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে সমকালীন রাজনীতিবিদসহ ১৪ জন ভাষা-বীর সর্বপ্রথম ভাষা-আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবি সংবলিত ২১ দফা ইশতেহার প্রণয়ন করেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই ইশতেহারের অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। ইশতেহারের দ্বিতীয় দফার দাবিটি ছিল রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত। ‘রাষ্ট্র্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার’ শিরোনামে তা ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশও হয়।
জানুয়ারি, ১৯৪৮: বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয় ওই বছরের ৪ জানুয়ারি। ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করা।
ফেব্রুয়ারি-মার্চ, ১৯৪৮: এ বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সংবিধান সভার বৈঠকে উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত আসে। এর প্রতিবাদ করে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সংখ্যাগুরুর ভাষা হিসেবে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করলে মুসলিম লীগ সদস্যরা রাজি হননি।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করে। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ তারা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। এই সংগ্রাম পরিষদ গঠনে বঙ্গবন্ধু সক্রিয় ছিলেন। তারা ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুসহ অন্যরা এর পক্ষে জনমত বাড়াতে জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু ফরিদপুর যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করেন। এ সময় কয়েকটি স্থানে তিনি বাধার মুখেও পড়েন।
১১ মার্চের কর্মসূচি সফল করতে ১৯৪৮ সালের ১ মার্চ গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রকাশ হয়। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য শেখ মুজিবুর রহমানও ওই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে প্রথম সফল হরতাল। এই হরতালে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দেন। তাকে লাঠিপেঠাও করা হয়। পরে বঙ্গবন্ধুসহ বেশ কয়েকজনকে কারাগারে নেওয়া হয়। স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই তাঁর প্রথম গ্রেফতার। পাঁচ দিন কারাবন্দি থেকে ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় মুক্তি পান তিনি।
১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তদানীন্তন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের আট দফা চুক্তি সই হয়। এই ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। চুক্তির শর্ত মোতাবেক বঙ্গবন্ধুসহ অন্য ভাষাসৈনিকরা কারামুক্ত হন।
জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরদিনই ১৬ মার্চ সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রসভায় বঙ্গবন্ধু সভাপতিত্ব করেন। সভাটি ছিল বিখ্যাত আমতলার সভা। ওই সভাতেই বঙ্গবন্ধু প্রথম সভাপতির দায়িত্ব পালন করে। সভা শেষে পূর্ববাংলা আইন পরিষদ ভবন অভিমুখে একটি মিছিল বের হয়।
১৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সভা হয়। তাতে বঙ্গবন্ধু অংশ নেন। এ সময় থেকে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য যুবনেতাদের ঐকান্তিক চেষ্টায় বাংলা ভাষার আন্দোলনটি পূর্ব বাংলায় গণআন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯ মার্চ জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণা দিলে বঙ্গবন্ধুসহ ৪-৫ শ’ শিক্ষার্থী তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেন। এতে জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করে ছিলেন। বেঁচে থাকতে পরে কখনোই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেননি তিনি।
সফর শেষে জিন্নাহ ফিরে যাওয়ার পর ফজলুল হক হলের সামনে ছাত্রসভায় পূর্ব বাংলার একজন ছাত্র নেতা জিন্নাহর রাষ্ট্রভাষা উর্দুর সিদ্ধান্ত মানতে হবে বলে ঘোষণা দিলে বঙ্গবন্ধু তার প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ৫৬ শতাংশ লোকের মাতৃভাষা বাংলা। সংখ্যাগুরুর দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন বলেও জানান তিনি।
সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮: ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য গ্রেফতার জন বঙ্গবন্ধু। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি মুক্তি পান তিনি। এ দফায় ১৩২ দিন কারাগারে কাটাতে হয় তাকে।
ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৯: মুক্তি পাওয়ার পরের মাসে, ১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি অনুষ্ঠানে যান বঙ্গবন্ধু। সেখানে শিল্পী আব্বাস উদ্দিনও ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে তারা নৌকায় করে আশুগঞ্জ ফিরছিলেন। নৌকায় বসে আব্বাস উদ্দিন ভাটিয়ালী গান গাইলেন। বঙ্গবন্ধু প্রাণভরে তা শোনেন। এ সময় বঙ্গবন্ধুকে আব্বাস উদ্দিন বলেছিলেন, ‘মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালোবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’
অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু নিজেই বিষয়টির বর্ণনা করেছেন। তিনি আব্বাস উদ্দিনকে এ প্রসঙ্গে কথা দিয়েছিলেন বলেও উল্লেখ করেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম।’
এপ্রিল, ১৯৪৯: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালনের সময় ১৯ এপ্রিল গ্রেফতার হয়ে ওই বছর ২৮ জুন মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু। এরপর ৩১ ডিসেম্বর আবারও গ্রেফতার হয়ে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ছাড়া পান। এই দফায় টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে ছিলেন তিনি।
জানুয়ারি, ১৯৫২: খাজা নাজিম উদ্দিন ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর উল্টে যান। পূর্ব বাংলায় এসে ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে তিনি উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে বলে ঘোষণা দেন। ওই সময় বঙ্গবন্ধু বন্দী হিসেবে হাসপাতালে চিকিৎসায় ছিলেন। ওইদিন সন্ধ্যায় অলি আহাদ ও তোয়হা বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলে তিনি আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে নিয়ে রাত ১টায় আসতে বলেন। হাসপাতালের বারান্দায় বসে তারা কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু এ সময় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পরামর্শ দেন। এতে ছাত্রলীগ রাজিও হয়। যুবলীগকেও সম্পৃক্ত করার কথা হয়। আরও দুই ছাত্রলীগ নেতা এবং শওকত মিয়াসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকে নিয়ে পরের দিন রাতেও তাদের আসতে বলেন। পরের রাতে অনেকেই আসেন। সেখানেই ঠিক হয় ২১ ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগকে রাষ্ট্রভাষা পরিষদের কনভেনার করতে বলেন। তিনি ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টির করার কথাও বলেন। এছাড়া তিনি নিজেও মুক্তির দাবিতে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট করবেন বলে তাদের অবহিত করেন। ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মুক্তি না দিলে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘটনার করার ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু ও মহিউদ্দিন অনশনে সরকারের কাছে আবেদন করেন। তাদের আল্টিমেটারের শেষদিনই ১৫ ফেব্রুয়ারি অন্য জেলে পাঠানোর হুকুম হয়। পরে অনশন ধর্মঘট অবস্থায়ই তাদের তাদের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে ফরিদপুর কারাগারে পাঠানো হয়।
ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২: সালে ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরক সময়কালে জেলে আটক থাকায় স্বাভাবিক কারণেই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা সম্ভব ছিল না বঙ্গবন্ধুর পক্ষে। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। পরামর্শ দিতেন। ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছেন।
একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ ফরিদপুর জেলে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। দিনটি উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে কাটিয়েছিলেন বলে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন। রাতে সিপাহিদের থেকে ঢাকায় ভীষণ গোলমালের খবর পান। জানতে পারেন কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। ফরিদপুরে ছাত্র-ছাত্রীরা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, ‘বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’ এসব স্লোগান দিচ্ছিলেন।
ঢাকার খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু চিন্তিত হয়ে পড়েন। ২২ তারিখের খবরের কাগজ পড়ে বিস্তারিত জানতে পারেন তিনি। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর বর্ণনা ছিল, “মাতৃভাষার আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলনের গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেও, গুলি না করে গ্রেফতার করলেই তো চলতো। আমি ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই। মানুষের যখন পতন আসে তখন পদে পদে ভুল হতে থাকে।”
অনশনরত অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকলে ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তির হুকুম জারি হয়। মুক্তি পেয়ে পাঁচ দিন পর বাড়ি পৌঁছান বঙ্গবন্ধু। বাড়ি পৌঁছানোর পরের ঘটনা বঙ্গবন্ধু বর্ণনা করেন এভাবে, “হাসু (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) আমার গলা ধরে প্রথমেই বলল, “আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই। একুশে ফেব্রুয়ারি ওরা ঢাকায় ছিল, যা শুনেছে তাই বলে চলেছে।”
এপ্রিল, ১৯৫২: ২৭ এপ্রিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান।
জুন, ১৯৫২: জাতীয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিবৃতি দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার মত পরিবর্তন করিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে সমর্থন আদায় করেন। পরে সোহরাওয়ার্দী রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন। ১৯৫২ সালের ২৯ জুন বিবৃতিটি সাপ্তাহিত ইত্তেফাকে প্রকাশ হয়।
১৯৫৩: এ বছর একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। সে দিন সব আন্দোলন, মিছিল এবং নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন তিনি। আরমানিটোলা মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন।
১৯৫৪: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চেতনায় ১৯৫৪ সালে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্ট সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু সমকালীন রাজনীতি এবং বাংলা ভাষার উন্নয়নে অবদান রাখেন। পরেও তিনি বাংলাভাষা ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অধিকারের এই দাবি ও আরও জোরালোভাবে জাতির সামনে তুলে ধরেন।
১৯৫৬: এ বছরের ১৭ জানুয়ারি আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু সংসদের দৈনন্দিন কার্যসূচি বাংলা ভাষায় মুদ্রণের দাবি জানান।
একই বছর ৭ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে তিনি খসড়া শাসনতন্ত্রের অন্তর্গত জাতীয় ভাষা সংক্রান্ত প্রশ্নে পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ ভাগ লোকই বাংলা ভাষায় কথা বলার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনও ধোকাবাজি করা যাবে না। পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি বাংলা রাষ্ট্রীয় ভাষা হোক। ১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখের সংসদের বৈঠকে তিনি আবারও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।
২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমৃত্যু বাংলা ভাষার বিকাশ ও সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনে কাজ করে গেছেন। এই মহান নেতা বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায় এবং বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষীদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি।
১৯৭৫: এ বছরের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা প্রচলনের প্রথম সরকারি নির্দেশ জারি করেন।
(বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ভাষা সৈনিক গাজীউল হকের ‘আমার দেখা আমার লেখা’, ড. মোহাম্মদ হান্নানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে আন্তর্জাতিক’সহ একাধিক বইয়ে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানের এসব তথ্য পাওয়া গেছে)