জানা যায়, বিদ্যুৎ না কিনলেও আদানি পাওয়ার লিমিটেডকে দিতে হবে বিশাল ক্যাপাসিটি চার্জ। আদানির কেন্দ্রটির জন্য পিডিবিকে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ৩৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে ৪৭৩ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার। আর ২৫ বছরে এ চার্জ বাবদ ব্যয় হবে প্রায় ১১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ ২৬ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গড্ডা প্রকল্পের মতো পৃথিবীতে এ রকম আর কোনো নজির আছে কি না সন্দেহ। এর কারণ প্রকল্পটির কয়লা অস্ট্রেলিয়ার কয়লা খনি থেকে আসার কথা। জাহাজে এটি আসবে ওড়িশার ধামড়া সমুদ্রবন্দরে। এ বন্দরটিও আদানি গ্রুপের। সেখান থেকে কয়লা রেলগাড়িতে আনা হবে গড্ডায়। সেখানে উৎপাদন করা বিদ্যুৎ পশ্চিমবঙ্গ পার হয়ে আসবে বাংলাদেশে।
৯ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত ‘আদানি ওয়াচ’ নামক ওয়েবসাইটে ‘ইজ বাংলাদেশ’স ইলেকট্রিসিটি কন্ট্রাক্ট উইদ আদানিস লিগালি ভয়েড’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গড্ডা থেকে প্রায় তিন গুণ বেশি দামে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। এটি এরই মধ্যে বাংলাদেশ বুঝতে পেরেছে। এজন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) আদানির সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করতে চাইছে। ভারতের অন্য সংস্থা বা দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের চেয়ে অনেক বেশি দামে আদানির কাছ থেকে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে।
এ ছাড়াও চুক্তি অনুযায়ী আদানি পাওয়ারকে এসব বিদ্যুৎ বিল মার্কিন ডলারে দিতে হবে। চুক্তি সইয়ের সময় বাংলাদেশে এক ডলারের দাম ছিল ৮১ টাকা ১৯ পয়সা। এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১০৪ টাকা। আদানি ওয়াচের প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, গড্ডা প্রকল্পের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় আদানির নিজস্ব খনি থেকে কয়লা আনার কথা। কিন্তু আদানি পাওয়ার গত বছরের ১০ অক্টোবর এ প্রকল্পে ২৫ বছরে পাঁচ দশমিক ৯ মিলিয়ন টন কয়লা সরবরাহের জন্য দরপত্র আহ্বান করে, যা সন্দেহজনক।
সব মিলিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদানি গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের করা বিদ্যুৎ চুক্তিটি বৈষম্য ও প্রতারণামূলক। তারা বলছেন, আদানি গ্রুপ এ চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এ চুক্তিতে তারা কারচুপির আশ্রয় নিয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ‘আইনি দিক বিবেচনা করে আদানিকে অযোগ্য ঠিকাদার হিসেবে আমরা ঘোষণা করতে পারি। এর মাধ্যমে তাদের চুক্তি বাতিল করে বলতে পারি তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ নেব না। কারণ যে অর্থ দিয়ে আদানির কাছ থেকে আমরা বিদ্যুৎ নেব তার অর্ধেক পয়সায় আমরা নিজেরাই কয়লা কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি। জনস্বার্থে এ চুক্তি বাতিল করে আদানি থেকে বিদ্যুৎ না কিনে দেশের অন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা উচিত। সরকার যদি এ ক্ষেত্রে ছাড় দেয় তাহলে বুঝতে হবে যে সরকারের মধ্যে একটি ক্রিয়াশীল ও সুবিধাবাদী চক্রের এ চুক্তিটি তৈরির সময় সক্রিয় ভূমিকা ছিল। চক্রটি দেশের স্বার্থের ক্ষতি করে আদানির স্বার্থ দেখেছে। এ চক্রটিকে চিহ্নিত করে তাদের জ্বালানি অপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করতে হবে। আর তা না হলে দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে না।’
প্রসঙ্গত, ভারত থেকে বিদ্যুৎ নিতে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি) ও আদানি পাওয়ার লিমিটেডের মধ্যে চুক্তি হয়, যা গড্ডা চুক্তি নামে পরিচিত। এরই মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এ চুক্তি নিয়ে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পুঁজিবাজারবিষয়ক প্রতিষ্ঠান হিন্ডেনবার্গ আদানির শেয়ারবাজারে কারসাজি এবং অ্যাকাউন্টিং জালিয়াতির বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ সময় বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে গিয়ে আদানি গ্রুপের কারসাজির তথ্যও সামনে উঠে আসে। এরপর থেকে গড্ডা চুক্তির আইনি বৈধতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।