ঢাকাশনিবার, ৩০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

সাড়ে ছয়শ কোটি টাকা লোপাট বাপেক্সে

নিউজ ডেস্ক | সিটিজি পোস্ট
জানুয়ারি ২৯, ২০২৩ ১১:২১ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাটে জর্জরিত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স)। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। আর এ অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অডিট অধিদপ্তরের ২০২১-২২ অর্থবছরের নিরীক্ষায় দুর্নীতি ও অর্থ লোপাটের এ চিত্র উঠে এসেছে।

২১টি পৃথক খাতে এসব দুর্নীতি হয়েছে, যার মধ্যে ১৪টি গুরুতর আর্থিক অনিয়ম। আর সাতটি অপেক্ষাকৃত কম আর্থিক অনিয়ম। গুরুতর আর্থিক অনিয়মের বিপরীতে ৬২৭ কোটি ২ লাখ ৪৮ হাজার ৭৯৯ টাকা এবং অপেক্ষাকৃত কম আর্থিক অনিয়মের বিপরীতে ১৪ কোটি ৭৭ লাখ ৬ হাজার ২১৩ টাকার দুর্নীতি হয়েছে। যার মোট পরিমাণ ৬৪১ কোটি ৭৯ লাখ ৫৫ হাজার ৬ টাকা।

চলতি মাসের শুরুতে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির জবাব চেয়ে চিঠি দিয়েছে অডিট অধিদপ্তর। এসব জবাব জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের মাধ্যমে দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আলী হোসেন বলেন, এসব অডিট আপত্তি না বুঝে দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি আছে। আমরা সেই কমিটির কাছে জবাব দিয়েছি।

জানা গেছে, সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির (এসজিসিএল) কাছে গ্যাস বিক্রির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নির্ধারিত হারের চেয়ে কম হারে ওয়েলহেড মার্জিন দেওয়ায় বাপেক্সের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯ সালের জুনে বিইআরসি বাপেক্সের ওয়েলহেড মার্জিন ঘনমিটারপ্রতি ৩ দশমিক ০৪১৪ টাকা নির্ধারণ করে। কিন্তু এই আদেশ না মেনে এসজিসিএল বাপেক্সেকে ঘনমিটারপ্রতি ওয়েলহেড মার্জিন শূন্য দশমিক ৬৭ এবং শূন্য দশমিক ৬ হাজার ২৯৭ টাকা পরিশোধ করছে। ফলে প্রতি ঘনমিটারে যথাক্রমে ২ দশমিক ৩ হাজার ৭১৪ টাকা ও ২ দশমিক ৪ হাজার ১১৭ টাকা করে লোকসান হয়েছে। এতে বাপেক্সের ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ৩১৩ কোটি ৬৭ লাখ ১৫ হাজার ১৪ টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩৯ কোটি ৪১ লাখ ৮৮ হাজার ৩৬২ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতির মোট পরিমাণ ৪৫৩ কোটি ৯ লাখ ৩ হাজার ৩৭৬ টাকা।

একইভাবে বাপেক্সের গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে গ্যাসের হিসাবে অমিল ধরা পড়েছে। বাপেক্সের সরবরাহকৃত গ্যাসের পরিমাণ কম দেখিয়ে মার্জিন মূল্য বাবদ ৪৪ কোটি ৯ লাখ ৪৫ হাজার ৩১৩ টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে সরবরাহ ও বিতরণের দায়িত্বে থাকা দুই সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত বলে জানা গেছে।

নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাপেক্সের সালদা নদী, শ্রীকাইল ও ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাস ফিল্ড থেকে ১৭১ কোটি ১৬ লাখ ৭৮ হাজার ৩০৬ ঘনমিটার গ্যাস জিটিসিএলের সঞ্চালন লাইনে সরবরাহ করা হয়। জিটিসিএল সালদা নদী ও শ্রীকাইলের গ্যাস তিতাস গ্যাস কোম্পানি এবং ফেঞ্চুগঞ্জের গ্যাস বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানির বিতরণ লাইনে সরবরাহ করে।

বিতরণ কোম্পানির হিসাব অনুযায়ী, বিতরণ লাইনে প্রাপ্ত গ্যাসের পরিমাণ ১৫৭ কোটি ৬৬ লাখ ৯৭ হাজার ২৭৩ দশমিক ২১ ঘনমিটার। সরবরাহের চাইতে ১৪৪ কোটি ৯৮ লাখ ১ হাজার ৩২ দশমিক ৭৯ ঘনমিটার কম। এই পরিমাণ গ্যাসের মার্জিনের পরিমাণ ৪৪ কোটি ৯ লাখ ৪৫ হাজার ৩১৩ টাকা।

পাশাপাশি অনুসন্ধান ও উৎপাদন ভাতা (এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন অ্যালাউন্স) প্রদানের নামে ৩ কোটি ৯২ লাখ ৪৮ হাজার ৭৮০ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের এক নির্দেশনায় কারা কোন ধরনের ভাতা পাবে, এর একটি তালিকা (রেশনাল তালিকা) করা হয়। সে অনুসারে অনুসন্ধান ও উৎপাদন ভাতা বলে কিছু নেই। তালিকাবহির্ভূতভাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে কর্মকর্তাদের ৩ কোটি ৯ লাখ ২২ হাজার ৭০৮ টাকা এবং কর্মচারীদের ৮৩ লাখ ২৬ হাজার ৭২ টাকা দেওয়া হয়, যা সরাসরি আইন লঙ্ঘন। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ টাকা ফেরত নিয়ে বাপেক্সের কোষাগারে জমা করার সুপারিশ করা হয়েছে।

পিপিআর-২০০৮-এর বিধি লঙ্ঘন করে বিজয় ১০, ১১ ও ১২ আইডিকো রিগ মেরামত প্রকল্পের অধীনে বেশ কিছু মালপত্র সরবরাহের জন্য ওসিএন কনস্ট্রাকশন এসডিএন বিএইচডির সঙ্গে চুক্তি করে। নিরীক্ষায় উল্লেখ করা হয়, পিপিআর ২০০৮-এর বিধি ১০২(১১) তপশিল-২ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক দরপত্রের ক্ষেত্রে চুক্তি সম্পাদন নোটিশ ইস্যুর ২৮ দিনের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের নিয়ম থাকলেও তা না মেনে ৩৯ দিন পর অনিয়মিতভাবে চুক্তি সম্পাদন করা হয়। বাপেক্স সূত্রে জানা গেছে, ১১ দিন পর চুক্তির করার পেছনে ছিল কমিশন বাণিজ্য। চুক্তির মূল্য ছিল ৪ কোটি ৪২ লাখ ৫৪ হাজার ৯১৪ টাকা। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই চুক্তির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

শরীয়তপুর-১ গ্যাস কূপ খনন প্রকল্পের জন্য প্রকিউরমেন্ট অব সিমেন্ট (এপিআই ক্লাস জি), সিমেন্ট এডিটিভিস ইনক্লুডিং সিমেন্ট অ্যানালাইসিস সিমেন্ট সার্ভিসেস সরবরাহের জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি মেসার্স হ্যালিবাটন ইন্টারন্যাশনাল জিএমবিএইটের সঙ্গে একটি চুক্তি করে বাপেক্স। তৃতীয় পক্ষীয় সেবা নিতে এই চুক্তি করা হয়। চুক্তির মূল্য ১ কোটি ৯৫ লাখ ৯৮ হাজার ৬৫৮ টাকা।

চুক্তি অনুযায়ী হ্যালিবাটনের আমদানি করা মালপত্রের বিপরীতে শিপিং ডকুমেন্ট দাখিল করা হয়নি। পাশাপাশি বিলম্বে খালাসের কারণে পোর্ট চার্জ বাবদ ৫৫ লাখ ৬৩ হাজার ৮০০ টাকা এবং শিপিং এজেন্ট চার্জ বাবদ ৪১ লাখ ৬৮ হাজার ৭৪২ টাকা জরিমানা করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এর মোট পরিমাণ ৯৭ লাখ ৩২ হাজার ৫৪২ টাকা। চুক্তি অনুযায়ী এই টাকা সরবরাহকারীর দেওয়ার কথা থাকলেও বাপেক্স তা পরিশোধ করে।

এ ছাড়া অলাভজনক ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্পে বিনিয়োগ করে ঋণ ও সুদ বাবদ বছরে ২০ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে বাপেক্সকে। প্রকল্প খাত থেকে প্রাপ্য সম্মানীর টাকা বাপেক্সের নিজস্ব তহবিল থেকে পরিশোধ করায় ১ কোটি ৮ লাখ ৯৭ হাজার ৭৪২ টাকা, পরামর্শকদের চুক্তির বাইরে বাড়তি সুবিধা দেওয়ায় ৬ লাখ ২৯ হাজার ৯৬৪ টাকা, কর্মকর্তাদের গাড়ি সরবরাহের কারণে ৩ লাখ ২৪ হাজার ৩২৩ টাকা, অস্থায়ী শ্রমিকরেদর প্রাপ্যতা বহির্ভূতভাবে ওয়ার্কওভার সম্মানী প্রদানে ৫২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রদানকৃত আর্থিক সম্মানীর ওপর উৎসে কর না কাটায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি ১ কোটি ৪২ লাখ ৮১ হাজার ৫২২ টাকা, প্রাপ্য না হলেও অনিয়মিত শ্রমিকদের উৎসব বোনাস ও আর্থিক সহায়তা ভাতা প্রদানে ক্ষতি ৮২ লাখ ৪৬ হাজার ৫৮৯ টাকা, ভোজন ভাতা ও মেস ভাতা প্রদানে ৭৮ লাখ ৯৩ হাজার টাকা, বাপেক্সের গ্যাস ক্রোমাটোগ্রাফি যন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি ছাড়া বেসরকারি কোম্পানি থেকে সেবা গ্রহণে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা, ব্যবহার অযোগ্য মালপত্র নিলাম না করায় ৫ লাখ ৪১ হাজার ৩৫০ টাকা, চিকিৎসাসেবার সুযোগ থাকলেও কর্মকর্তাদের হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ায় ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৩৮২ টাকা এবং কূপ খনন ও ওয়ার্কওভার কার্যক্রমের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রণোদনা প্রদানে ১৪ কোটি ৬৩ লাখ ৬০ হাজার ৫৮১ টাকার অনিয়ম হয়েছে।