নিজ কার্যালয়ে দুষ্কৃতকারীদের হামলার শিকার হয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ডঃ গোলাম ইয়াজদানি। আজ রোববার বেলা পৌনে ৪টার দিকে নগরের টাইগারপাসে সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী কার্যালয় ভবনের চারতলায় প্রকল্প পরিচালকের কক্ষে এই হামলা হয়। এই সময় প্রকল্প পরিচালকের টেবিল ও নামফলক ভেঙে ফেলা হয়।
চসিকের সুত্রমতে, ২৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ ‘মাটট্রিক্স ‘ পদ্ধতিতে লটারীর মাধ্যমে দেবার বিষয়ে অনড় থাকার কারণে দূর্নীতিবাজ প্রকৌশলীদের ইন্দনে এই হামলার শিকার হয়েছেন তিনি। প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে দূর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠার কারণে প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানিকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। কাজে যোগ দেবার পর থেকে চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী জসিম উদ্দিনসহ দূর্নীতিবাজ প্রকৌশলীদের অসহযোগিতার কারণে প্রকল্পের ঠিকাদারির কাজে মাট্রিক্স পদ্ধতি চালুর ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হন তিনি।
হামলাকারী হিসেবে কংকন, সুভাষ, ফেরদৌস, লিটনের নাম বলছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। আক্রান্ত এই প্রকল্প পরিচালক বলেন, কাজ না দেওয়ায় একদল ঠিকাদার তাঁর ওপর এই হামলা চালিয়েছে।
এরআগে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন প্রকল্পের দরপত্রে অনিয়মের অভিযোগ উঠে। গেল বছরের অক্টোবর মাসে ২৫ লটের দরপত্রের বিপরীতে ১৩ টি কাজ লটারীর মাধ্যমে দেয়া হলেও, বাকী বারোটি কাজ বিক্রি করা হয়েছে চড়া কমিশনে। সুত্রমতে, ৭ শতাংশ ‘পার্সেন্টিজ’ নিয়ে পছন্দের বারোটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ বিক্রি করা হয়েছে।
ঠিকাদারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল আলম, প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, নির্বাহী প্রকৌশলী জসিমউদদীনসহ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পুরোনো সিন্ডিকেট গোপনে টেন্ডার বিক্রির কাজ চালু করেন । স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগকৃত নতুন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজধানীর সাথে ‘টেন্ডার বিক্রি’র নানা ইস্যুতে সিন্ডিকেটের সম্পর্কের টানাপোড়েনের কথা জানা গেছে।দরপত্রে অংশগ্রহণকারী ঠিকাদারদের সাথে কথা বলে জানা যায় দশ শতাংশ কম দরে দেয়া হয়েছে সবকটি কাজ। এরমধ্যে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ঠিকাদার সমিতিকে দেয়া হয়েছে একটি কাজ। সুত্রমতে, সেই কাজ অন্য ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে ঈদে মিলাদুন্নবীর খরচ যোগাবেন তারা।
প্রতিবেদকের হাতে আসা ভিডিওতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একজন ঠিকাদারকে টেন্ডার বিক্রি ও পার্সেন্টিজের বিষয়ে কথা বলতে দেখা যায়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ঠিকাদারদের একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
চসিকের প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, মেসার্স শাকিল এন্টারপ্রাইজ পেয়েছে ১১ নং ওয়ার্ডের কাজ, মেসার্স আবেদীন এন্টারপ্রাইজ পেয়েছে ১২ নং ওয়ার্ডের কাজ। মেসার্স এসএস এন্টারপ্রাইজ পেয়েছে ১৩ নং ওয়ার্ডের কাজ, মেসার্স নাজিম এন্ড ব্রাদার্স পেয়েছে পেয়েছে ৬ নং ওয়ার্ডের কাজ, মেসার্স এ কে সিন্ডিকেট পেয়েছে ৬ নং ওয়ার্ডের আরেকটি কাজ। মেসার্স এম হুদা কর্পোরেশনকে দেয়া হয়েছে ৩১ নং ওয়ার্ডের কাজ, মেসার্স ইসলাম এন্ড ব্রাদার্স পেয়েছেন ৩৬ নং ওয়ার্ডের কাজ। মেসার্স ব্রাদার্স এসোসিয়েটস ৩৪ নং ওয়ার্ডের কাজ পেয়েছেন। মেসার্স রাজ কর্পোরেশন পেয়েছেন ১০ নং ওয়ার্ডের কাজ। মেসার্স আরই- এফসি (জেবি) পেয়েছে ৩০ নং ওয়ার্ডের উন্নয়ন কাজ। মেসার্স রিদিকা এন্টারপ্রাইজকে দেয়া হয়েছে ৩০ নং ওয়ার্ডের উন্নয়ন কাজ। মেসার্স শাহ জব্বারিয়া ট্রেডিং পেয়েছেন ১১ নং ওয়ার্ডের কাজ। মেসার্স আরএম ইন্জিনিয়ারিং ‘কে দেয়া হয়েছে ২৬ নং ওয়ার্ডের কাজ।
এছাড়া, আকিল এন্টারপ্রাইজ, মার্মা এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স জেএন এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স এএন কর্পোরেশন, মেসার্স এআলী-পি (জেবি), মেসার্স এবি-হক ব্রাদার্স, মেসার্স ই এন্ড পি (জেবি), মেসার্স ব্রাদার্স এসোসিয়েটস, মেসার্স ডিআর ট্রেডিং, মেসার্স আবির এন্টারপ্রাইজ, আবির এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স রাঙামাটি ট্রেডার্স এসএসই (জেভি), মেসার্স তানজিল এন্টারপ্রাইজ পেয়েছেন বাকী তেরটি দরপত্রের কাজ।
ঠিকাদারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গোপনে পার্সেন্টিসের মাধ্যমে কাজ দেওয়া হলে প্রতিযোগিতামুলক দর, অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান যেমন নিশ্চিত করা যায় না, তেমনিভাবে নিম্মমানের কাজ করা ছাড়া ঠিকাদারদের কোন উপায় থাকেনা। বর্তমানে দশ শতাংশ কম মুল্যে কাজ নেয়ার সাথে সাথে সাত শতাংশ পার্সেন্টিজ (ঘুষ) , সরকারি ভ্যাট-ট্যাক্স, অফিস খরচ ( ঘুষ) মিলিয়ে প্রকল্পের বাজেটের ৩৪ শতাংশ বাদ দিয়ে কাজ করতে হবে। এছাড়া নির্মান সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির বর্তমান পরিস্থিতিতে নিম্মমানের কাজ করা ছাড়া কোন উপায় নেই।
ইজিপিতে অভিনব জালিয়াতি করে ৯ শতাংশ বেশি দরে একটি প্রকল্পের কাজ দেবার বিষয় জানাজানি হলে উপ প্রকল্প পরিচালক জসিম উদ্দিনের স্বাক্ষরে গত বছরের ১৯শে সেপ্টেম্বর ‘রি টেন্ডার ‘ আহবান করে চসিক। সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে গোপনে সিডিউলের দর পরিবর্তনের অভিযোগ উঠে। ফলে, দরপত্রে অংশ নেয়া সব ঠিকাদারদের দেয়া দর নন রেসপনসিভ হয়ে যায়।
পিপিআর-২০০৮ এর বিধি ১২৭ এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে যদি কোন দুর্নীতি, প্রতারণা চক্রান্ত বা জবরদস্তিমুলক কার্যে কোন ব্যক্তি জড়িত হয় তাহা হইলে ক্রয়কারী উক্ত কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়া বা থাকার বিষয়ে লিখিতভাবে ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নির্দেশ প্রদান করিবে। কাজ দেবার ক্ষেত্রে লটারী কিংবা টেন্ডার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার তদারকির নেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি সাড়া দেন নি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের কোন কর্মকর্তাও এই বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। তবে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে দরপত্রের কাজ বিক্রির টাকা পৌঁছে যায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে। তখন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানী বলেছিলেন , ‘অনিয়মের মাধ্যমে কোন দরপত্রের কার্যাদেশ ইস্যু করবেন না তিনি। ‘
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন প্রকৌশলী জানান, ‘ লটারী ছাড়া অনিয়মের মাধ্যমে দেয়া কাজের বিষয়ে দায়িত্ব না নেবার কারণে প্রকল্প পরিচালক ইয়াজদানীর উপর হামলা চালানো হয়েছে। হাবিব, ফেরদৌস, কংকন, লিটন দাশ, সুভাষসহ ২৫/৩০ হামলায় অংশ নিয়েছেন। তাদের সাথে প্রকৌশলী জসিম উদ্দিনের অংশীদারত্বের ব্যবসা রয়েছে। ‘
এদিকে, ঘটনার পরপরই পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তারা হামলার আলামত সংগ্রহ করেছেন। এরআগে ২৯ শে ডিসেম্বর অস্থায়ী কর্মচারীদের দ্বারা আক্রান্ত হন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল আলম। সেসময় তার কাছে থেকে ২৫ জনের (শ্রমিক) পদোন্নতিতে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়া হয়, যাদের মধ্যে তিনজনই নতুনভাবে শ্রমিক পদে নিয়োগ পেয়েছেন চসিকে। সুত্রমতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামের আপন ভাগিনাও শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে সড়ক সুপারভাইজার হিসেবে পদোন্নতির তালিকায় নাম উঠান।