এই কথা বলার জো নেই যে বাংলাদেশে কিছুই হচ্ছে না। কিছু মানে হলো উন্নয়ন। একজন পুরকৌশলী হিসেবে দেখেছি বিগত কয়েক বছর ধরে দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ধাঁই ধাঁই করে বাড়ছে। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল তো জাতীয় ল্যান্ডমার্ক। এছাড়াও আরো বহু প্রকল্প চলমান এবং সমাপ্তির দিকে। বিগত দশ বছরে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। এত এগিয়েছে যে পূর্ববর্তী কোন সরকার তাদের আগের রেখে যাওয়া কাজের কোন কূল কিনারা খুঁজে পাবে না।
এখানে রূপকথার গল্পটা কোন জায়গায়? দেশ উন্নতি করছে, এক সময় রূপকথার দেশের মত দেখতে হবে সবকিছু এমনটা ভাবতে দোষ নেই। রাজ্যে থাকবে গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ। কিন্তু সব রূপকথার গল্পেই কি গোলাভরা ধানের সাথে হাসিখুশি প্রজার ছবি থাকে? বাংলাদেশের গল্পটা বোধহয় এমন একটা রূপকথার গল্পের মত। বাংলাদেশের মানুষ সামগ্রিকভাবে যে খুব একটা সুখে নেই, এমনটাও না। ঘরে ঘরে উদ্যোক্তা, স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট। অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। চাকার পরিধি বাড়ছে, বাড়ছে অতিক্রান্ত দূরত্ব। তাহলে এখানে বোকা মানুষ কারা? তারা বোকা হচ্ছে কিভাবে?
দেখুন বাংলাদেশের বোকারা খুবই চালাক। ছোট্ট একটা দেশে এতগুলো উন্নত প্রজাতির বানর সম্প্রদায়ের সাথে বসবাসের ফলে এখানকার বোকাদের মস্তিষ্ক বিবর্তিত হয়েছে। ফলে আদতে তারা বোকা হলেও বাহিরে বাহিরে তারা চালাক। আহমদ ছফা থেকে ফাহাম আব্দুস সালাম পর্যন্ত বাঙালিকে নিয়ে বিস্তর আলাপ আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এ দুজন ছাড়াও বাঙালিদের নিয়ে আরেকজনের অবজারভেশন আছে। তিনি হলেন হুমায়ুন আহমেদ। ‘ শুভ্র গেছে বনে ‘ বইয়ে হুমায়ুন লিখেছিলেন, এদেশের মানুষ বিপর্যয়েও হাসে। ঘুরে ফিরে তার বিভিন্ন চরিত্রে দেখিয়েছেন বাঙালিরা অদ্ভুত এক জাতি। এদের বিপদেও আনন্দ আবার আনন্দেও বেদনা। আবেগের ডিব্বা।
এত উন্নয়নের পরেও বাংলাদেশের মানুষ কেন দুঃখী প্রজা? একটা কারণ খুবই স্পষ্ট। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়া। উন্নয়ন মানেই কিন্তু দেশ এখন এগিয়েছে। আর এই এগিয়ে যাওয়া মানে একটা ভারি বোঝাও আমাদের ঘাড়ে চেপেছে। কারণ উন্নয়ন মুফতে আসে নি। আমাদেরই এর মূল্য বইতে হবে। হ্যা, এর উপকারিতাও আমরাই ভোগ করবো। হয়তো শীঘ্রই। হয়তো জাতি হিসেবে আমাদের আর কিছুদিন কষ্ট সইতে হবে। যদিও ৫০ বছর অনেক সময়। দিন দিন সবকিছুর দাম মারাত্মকভাবে বাড়ছে। ক্রয়ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়েছে বহু দিন আগে। আমাদের চোখ স্বপ্ন দেখা শিখে গেছে এই ৫০ বছরে, স্বপ্ন পূরণের সামর্থ্যও অর্জন করেছে। কিন্তু সীমাহীন দুর্নীতি আর দুর্বিনীত পুঁজিবাদ আমাদের পিঠে গজানো ডানাকে দুর্বল করে ফেলেছে। আমাদের সত্যিকারের ডানা ছিল। আমরা উড়তেও জানি। কিন্তু উন্নয়নের ফ্লাইওভারে ওড়ার জন্য দরকার যে বাহন, পিঠের ডানায় ভর দিয়ে সে বাহনে ওঠা দুস্কর।
অবকাঠামোগত উন্নয়নের বাইরেও আরো যে হরেক রকম উন্নয়ন আছে উন্নয়নের কল্পনা রাজ্যে আমরা সেটা যেন ভুলে না যাই। রকমারির মাহমুদুল হাসান সোহাগ ভাই বলেছিলেন, ভুটান সুখ দিয়ে উন্নতি মাপে, আমরা মাপি জিডিপি দিয়ে। শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানো, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা, সবার অধিকার নিশ্চিত করতে পারাও উন্নয়ন। ইট কাঠের দালানে যে উন্নয়ন সে উন্নয়ন তখন রূপকথাকেও ছাড়িয়ে যাবে। নয়তো আমরা বোকাই রয়ে যাব।
আবার আমরা চালাক বটে। হাজারো দুঃখ লুকিয়ে রেখে একের পর এক সাম্রাজ্য আমরা গড়েই যাচ্ছি। আমাদের দেশে মানুষ যেমন অনেক বেশি, গ্রাহকও তো তেমনই বেশি। ফলে আমাদের পণ্য কেনার লোকের অভাব হয় না। কিন্তু দুঃখের কথা হলো রূপকথার রাজ্যে চালাক সেজে থাকতে থাকতে কবে যে আমরা বোকা বনে গেছি, সে খেয়ালই নেই আমাদের।