বিএনপির ডাকে ঢাকায় সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি গণমিছিল শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। এই গণমিছিল থেকে সব বিভাগীয় শহরে ‘গণ-অবস্থান’ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও জোট। বিএনপি বলছে, সরকার হটানোর আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপের এই যুগপৎ গণ-অবস্থান কর্মসূচি ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে তাদের ‘দ্বিতীয় সতর্কবার্তা’।
১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ নিয়ে গ্রেপ্তার-প্রাণহানির পর সরকারবিরোধীদের যুগপৎ গণমিছিলের কর্মসূচি ঘিরে উৎকণ্ঠা ছিল। এর মধ্যে গতকাল শুক্রবার মালিবাগ এলাকায় মিছিলের সময় জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের একটি ঘটনা ছাড়া বিএনপি, এলডিপিসহ তিনটি জোটের গণমিছিল শান্তিপূর্ণ ছিল। ঢাকার বাইরে রংপুর মহানগরেও গণমিছিল হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনসহ ১০ দফা দাবিতে বিএনপিসহ ৩২টি দল এক জোটে রাজধানীর সাতটি স্থান থেকে এই কর্মসূচি পালন করে।
নয়াপল্টনে গণমিছিল-পূর্ব সমাবেশ থেকে আগামী ১১ জানুয়ারি ঢাকাসহ ১০টি বিভাগীয় শহরে সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত চার ঘণ্টার গণ-অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, ঢাকায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে তাঁরা গণ–অবস্থান করবেন।
বিএনপির পাশাপাশি গণমিছিলের সঙ্গে একাত্ম বিভিন্ন দল ও জোটও ‘যুগপৎভাবে’ এ কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলে আশা প্রকাশ করেন খন্দকার মোশাররফ। তিনি বলেন, ‘এই গণ-অবস্থান কর্মসূচিকে সফল করে আপনারা সরকারকে বিদায়ের দ্বিতীয় সতর্কবার্তা উচ্চারণ করবেন।’
গণমিছিলের কর্মসূচিকে ঘিরে গতকাল রাজধানীতে পুলিশের সতর্ক অবস্থান ছিল। বিএনপির নেতা-কর্মীরা বেলা দুইটার আগেই নয়াপল্টনে জমায়েত হন। একপর্যায়ে তা কাকরাইল থেকে ফকিরাপুল বাজার ছাড়িয়ে যায়। মিছিলে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ দলের নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবিসংবলিত ব্যানার, প্ল্যাকার্ড নিয়ে অংশ নিতে দেখা যায় নেতা-কর্মীদের। মিছিলে মুক্তিযোদ্ধা দল, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দল, শ্রমিক দল, মৎস্যজীবী দল, তাঁতি দল, ওলামা দল, জাসাস, ছাত্রদলসহ অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা অংশ নেন। গণমিছিল মগবাজার মোড়ে এসে শেষ হলেও নেতা-কর্মীরা ফিরতি মিছিল নিয়ে একই পথে আবার নয়াপল্টনে যান।
সরকারের পাত্তা থাকবে না
গণমিছিলের আগে সমাবেশে একমাত্র বক্তা ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। এর আগে গণমিছিল কর্মসূচির সমন্বয়ক ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এ জেড এম জাহিদ হোসেন এবং দলের ঢাকা মহানগর উত্তর কমিটির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান স্বাগত বক্তব্য দেন।
২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলের উল্লেখ করে খন্দকার মোশাররফ বলেন, দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে, জনগণ যদি নিজে ভোট দিতে পারে, এই সরকারের কোনো পাত্তা থাকবে না। এই নির্বাচনে সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। এর ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এই সরকার অনেক বড় বড় কথা বলে। একটা নির্বাচন (রংপুর) দেখেছেন, জামানত বাতিল হয়ে যায় নৌকার। এগুলো কিন্তু সরকারকে আসলে সিগন্যাল দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন এটাই অবস্থা।’
নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ছোট ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চে আয়োজিত এই সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, শাহজাহান ওমরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
‘গণ-অভ্যুত্থানের নমুনা গণমিছিল’
সরকারদলীয় নেতা ও মন্ত্রীদের বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘অনেকে বলে জনগণ নাকি আমাদের (বিএনপি) সঙ্গে নেই। জনগণ আছে কি নেই, আমি সরকারকে, তাদের যারা গোয়েন্দা সংস্থা তাদের বলব, আজকের গণমিছিলটা দেখে যান। আগামী দিনে এই জনগণই গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করে আপনাদের বিদায় করবে—তার নমুনা এই গণমিছিল।’
১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবিতে এই গণমিছিল কর্মসূচির ঘোষণা হয়। এর উল্লেখ করে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এই গণমিছিল ১০ দফা আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি। প্রায় ৩৩টি দল এবং গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক ব্যক্তি-গোষ্ঠী এর সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, ঢাকায় গণমিছিল করছে। এই ১০ দফার একটিই কথা—এই ব্যর্থ, দুর্নীতিবাজ, লুটেরা সরকারকে বিদায় করতে হবে।
‘তারা সমাজে ভারসাম্য আনতে পারবে না’
সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-লুটপাটের অভিযোগ করে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, জনগণ বুঝতে পেরেছে যারা গণতন্ত্র হত্যা করেছে, তারা গণতন্ত্র ফেরত দেবে না। যারা অর্থনীতিকে লুটপাট করেছে, তারা অর্থনীতিকে মেরামত করতে পারবে না, যারা বিচারব্যবস্থাকে দলীয়করণ করেছে, তারা বিচার বিভাগকে স্বাধীন করতে পারবে না। তারা সমাজে ভারসাম্য আনতে পারবে না, দেশে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করতে পারবে না।
এসবের জন্য ‘এই সরকারের বিদায় প্রয়োজন’ মন্তব্য করে বিএনপির এই নেতা বলেন, সহজে কোনো স্বৈরাচার সরকার ক্ষমতা ছাড়ে না। তাদের বিদায় করতে হয়। জনগণ যখন রাস্তায় নেমেছে, তারাও টিকে থাকতে পারবে না।
আড়াই কিলোমিটার পথে আড়াই ঘণ্টার মিছিল
নয়াপল্টন থেকে মগবাজার চৌরাস্তা পর্যন্ত দূরত্ব আড়াই কিলোমিটার। সমাবেশ শেষে বেলা সাড়ে তিনটায় নয়াপল্টন থেকে গণমিছিল শুরু হয়। কাকরাইল, শান্তিনগর, মালিবাগ হয়ে মগবাজার মোড়ে গিয়ে মিছিল শেষ হয় সন্ধ্যা ছয়টার পর। ৬টা ১০ মিনিটে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সেখানে সমাপনী বক্তব্য দেন।
বিএনপির পাশাপাশি গতকাল জামায়াতে ইসলামী ও অলি আহমদের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) পৃথক মিছিল বের করে। রাজধানীর মালিবাগ ও রামপুরা বাজার এলাকা থেকে দুটি মিছিল বের করে জামায়াত। এলডিপি তেজগাঁওয়ে এফডিসি-সংলগ্ন দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে বেলা তিনটায় মিছিল বের করে মগবাজার হয়ে মালিবাগ হয়ে আবার দলীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে শেষ করে। অলি আহমদ মিছিল-পূর্ব সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন।
এ ছাড়া সাতদলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করে গণমিছিল বের করে পুরানা পল্টন মোড় ঘুরে বিজয়নগর হয়ে কাকরাইলে গিয়ে শেষ করে। মিছিলে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, ভাসানী অনুসারী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, নাগরিক ঐক্যের শহীদুল্লাহ কায়সার, জেএসডির শহীদ উদ্দিন মাহমুদ ও গণ অধিকার পরিষদের রাশেদ খান ছিলেন।
বেলা তিনটায় বিজয়নগর পানির ট্যাংকের সামনে থেকে মিছিল বের করে ১২-দলীয় এই জোট। মিছিলটি পুরানা পল্টন মোড় ঘুরে নাইটিঙ্গেল মোড়ে গিয়ে শেষ হয়। মিছিলে মোস্তফা জামাল হায়দারের জাতীয় পার্টি (জাফর), সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, মোস্তাফিজুর রহমানের বাংলাদেশ লেবার পার্টি, শাহাদাত হোসেন সেলিমের বাংলাদেশ এলডিপি, মহিউদ্দিন ইকরামের জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, জুলফিকার বুলবুল চৌধুরীর বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, আবদুর রকিবের ইসলামী ঐক্যজোটসহ শরিক দলের নেতা-কর্মীরা অংশ নেন।
১০–দলীয় ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’ বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে পুরানা পল্টন এলাকায় মিছিল বের করে। মিছিলে জোটের সমন্বয়ক এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, বিকল্পধারা বাংলাদেশের (একাংশ) অধ্যাপক নুরুল আমিন, ডেমোক্রেটিক লীগের সাইফুদ্দিন আহমেদ, গণদলের এ টি এম গোলাম মাওলা চৌধুরীসহ শরিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরা অংশ নেন।
গতকালের গণমিছিলে একাত্মতা প্রকাশ করে অংশ নেওয়া সব দল ও জোট ১১ জানুয়ারি পৃথক গণ-অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করে।